প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২২, ০০:০০
শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রজনী ‘শবে বরাত’ নামে পরিচিত। ফারসি ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্য। আরবিতে বলে ‘লাইলাতুল বরাত’, অর্থাৎ সৌভাগ্যের রজনী। অনেকের অভিযোগ-শবে বরাত কুরআন ও হাদীসের কোথাও নেই। এ কথার জবাব হলো-কুরআন ও হাদিসের কোথাও শবে বরাত থাকবে কেন, শবে বরাত কুরআন ও হাদীসের পরিভাষা নয়। যেমন : নামাজ, রোজা, ফেরেস্তা এগুলো কুরআন ও হাদিসের পরিভাষা নয়। কুরআনে ‘লাইলাতুম মুবারকা’। হাদিসে ‘লাইলাতুন নিসফী মিন শা’বান’। পবিত্র কোরআন ও প্রসিদ্ধ তাফসীরের আলোকে শবে বরাত।
আল্লাহ এরশাদ করেন, হা-মীম, এ স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে বণ্টন করে দেয়া হয় প্রত্যেক হিকমতের কাজ। (সূরা দুখান, আয়াত : ১-৪)।
এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বিশ্ববরেণ্য মুফাস্সিরগণের মতামত : মালেকী মাযহাবের আল্লামা শেখ আহমদ ছাভী বলেন, ঐ বরকতময় রজনী হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত্রি (মোফাসসিরীনে কেরামের অন্যতম মোফাসসির) বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্যান্য তাফসীরকারকদের একদলের অভিমত। তারা এর কয়েকটি কারণও উল্লেখ করেছেন। শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত্রির চারটি নামে নামকরণ করেছেন। যেমন : ১। লাইলাতুম মুবারাকাহ-বরকতময় রজনী। ২। লাইলাতুল বারাআত-মুক্তি বা নাজাতের রাত্রি। ৩। লাইলাতুর রহমাহ-রহমতের রাত্রি। ৪। লাইলাতুছ ছাক- সনদপ্রাপ্তির রাত্রি ইত্যাদি। (তাফসীরে ছাভী, খ--৪, পৃষ্ঠা-৪০)।
তাফসীরে জালালাইন শরীফে রয়েছে, নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর বরকতময় রাত হল লাইলাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) অথবা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত)। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব (কোরআন শরীফ) ৭ম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে (১ম আসমান) নাজিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। (তাফসীরে জালালাইন শরীফে ৪১০ পৃষ্ঠা)।
তাফসীরে তাবারী শরীফে রয়েছে- আল্লাহ তা’য়ালার বাণী এর তাফসীরে বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজীদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে একজনও কম-বেশি হয় না। (তাফসীরে তাবারী শরীফ, পৃষ্ঠা ২২, খ- ১০)
প্রসিদ্ধ তাফসীরে কুরতুবী রয়েছে- ইমাম কুরতুবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এ রাতের ৪টি নাম আছে-(ক). লাইলাতুম মুবারাকা, (খ). লাইলাতুল বারাআত, (গ). লাইলাতুছ্ ছাক (ঘ). লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান। (তাফসীরে কুরতুবী, খ--১৬ পৃষ্ঠা-১২৬)
তাফসীরে বাগভী শরীফে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শবে বরাতের রাতে সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবে ক্বদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন। (তাফসীরে বাগভী, খ--৭, পৃষ্ঠা ২২৮)
এ রকম ৬৫টি তাফসীর গ্রন্থে লাইলাতুম মোবারাকা বলতে শবে ক্বদরের পাশাপাশি মধ্য শাবান অর্থাৎ ১৪ শাবানের রাতের কথাও গুরুত্বসহকারে বলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিতাবসমূহের নাম-
(১). তাফসীরে ইবনু আবি হাতেম, খ--১২, পৃষ্ঠা-২১৪। (২). তাফসীরে রুহুল মায়ানী, খ--২৫, পৃষ্ঠা-১১০। (৩). তাফসীরে বাহরুল মুহীত, খ--৮, পৃষ্ঠা-২৪। (৪). তাফসীরে ফাতহুল কাদীর, খ--৪, পৃষ্ঠা-৫৭০। (৫). তাফসীরে যাদুল মাছির, খ--৭, পৃষ্ঠা-১২২। (৬). তাফসীরে নাসাফী, খ--৩, পৃষ্ঠা-৩০২। (৭). তাফসীরে নিসাপুরী, খ--৬, পৃষ্ঠা-৪৯০। (৮). তাফসীরে কাশ্শাফ, খ--৪, পৃষ্ঠা-২৭২। (১০). তাফসীরে নুকুত ওয়াল উয়ূন, খ--৬, পৃষ্ঠা-৪৯০। (১১). তাফসীরে দুররে মানসূর, খ--১২, পৃষ্ঠা-৬৯। (১২). তাফসীরে খাজেন, খ--৬, পৃষ্ঠা-১৪৩। (১৩). তাফসীরে আল বোরহান, খ--২৩, পৃষ্ঠা-১১৬। (১৪). তাফসীরে রাযী, খ--১৭, পৃষ্ঠা-১৩৩। (১৫). তাফসীরে আলুসী, খ--১৮, পৃষ্ঠা-৪২৪। (১৬). তাফসীরে হাক্কী, খ--৫, পৃষ্ঠা-৬। (১৭).তাফসীরে কুরতুবী, খ--১৬, পৃষ্ঠা-১২৭। (১৮). তাফসীরে সাভী, খ--২, পৃষ্ঠা-৩০২। (১৯). তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ--৭, পৃষ্ঠা-২৪৬। (২০). তাফসীরে জামিউল বায়ান, খ--২০, পৃষ্ঠা-১৫১। (২১). তাফসীরে নুসূকী, খ--৪, পৃষ্ঠা-১২০। (২২). তাফসীরে কাদের, খ--৪, পৃষ্ঠা-১৬৬। (২৩). তাফসীরে মাযহারী, খ--৮, পৃষ্ঠা-৩৬৮। (২৪). তাফসীরে কাসেমী, খ--৮, পৃষ্ঠা-৩৬৮। (২৫). তাফসীরে কোশাইরী, খ--৩, পৃষ্ঠা-১৯০, (২৬). তাফসীরে আবু সাউদ, খ--৬, পৃষ্ঠা-১৩০। (২৭). তাফসীরে আয়াতুল আহকাম, খ--৪, পৃষ্ঠা-১৬৬। (২৮). তাফসীরে রুহুল বয়ান, খ--৩, পৃষ্ঠা-৫৯৮। (২৯). তাফসীরে কাশেফুল আসরার, খ--৯, পৃষ্ঠা-৯৪-৯৮ পৃষ্ঠা। (৩০). তাফসীরে মাওয়ারদী, খ--৪, পৃষ্ঠা-১০২। (৩১). তাফসীরে সিরাজুম মুনির, খ--৩, পৃষ্ঠা-৪৫৮। (৩২). কানজুল ঈমান শরীফ।
হাদীসের আলোকে লাইলাতুল বরাতের দলিল
দলিল নং : ১
হযরত আবূ মূসা আশয়ারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান, মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহপাক রহমতের তাজাল্লী ফরমান এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না।
{তথ্যসূত্র : (১). ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা-১০০, হাদীস নং-১৩৮৯, মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১১৫। (২). ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, খ--৩, পৃষ্ঠা-৩৮২। (৩). ফাজায়েলুল আওকাত, পৃষ্ঠা-১৩৩, হাদীস নং-২৯। (৪). মিসবাহুজ জুজাযাহ, খ--১, পৃষ্ঠা-৪৪২, হাদীস নং-৪৮৭। (৫). আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ--৩য়, হাদীস নং-২৭১৮। (৬). আহলে হাদীস তথা লা-মাযহাবীদের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নাসির উদ্দীন আলবানীর “সিলসিলাতুল আহাদিছে ছহিহা”-এর খ--৩, পৃষ্ঠা-১৩১ আরো ৫টি হাদীস রয়েছে।}
দলিল : ২
হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে জালওয়া রাখেন, অতঃপর তাঁর সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না।
{তথ্যসূত্র : (১). ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৮৩৩। (২). সহীহ ইবন হিব্বান, খ--১৩, পৃষ্ঠা-৩৫৫, হাদীস নং ১৯৮০। (৩). আহলে হাদীস তথা লা-মাযহাবীদের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নাসির উদ্দিন আলবানীর ‘সিলসিলাতুল আহাদিস আসসাহীহা’-এর খ--৩, পৃষ্ঠা-১৩৫, হাদীস নং-১১৪৪। (৪). মুজামুল কাবীর, খ--১৫, পৃষ্ঠা-২২১। (৫). ফাজায়েলুল আওকাত, পৃষ্ঠা-১১৯, হাদীস নং-২২। (৬). আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ--২, পৃষ্ঠা-২৪১। (৭). মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খ--৮, পৃষ্ঠা-৬৫। (৮). আল হিলয়াহ, খ--৫, পৃষ্ঠা-১৯১। (৯). আসসুন্নাহ, হাদীস নং-৫১২।}
দলিল নং : ৩
উম্মুল মোমেনীন মাহবুবায়ে মাহবুবে রাব্বিল আলামিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রহমতে আলম নূরে মুজাচ্ছম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন হুজুর পাক রাউফুর রাহীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা ও বুযুর্গী সম্পর্কে তুমি কি জান? তিনি আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতের কি মর্যাদা রয়েছে? আল্লাহ হাবিব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ট হবে এবং কতজন আদম সন্তান মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাত্রিতে তাদের আমল মহান আল্লাহ দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়। অতঃপর হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আল্লাহ রহমত ছাড়া কারো পক্ষে কি জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়?’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, মহান আল্লাহ বিশেষ রহমত ও একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া কারো পক্ষে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথাটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বললেন।
{তথ্যসূত্র : (১). মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১১৫। (২). ফাজায়েলুল আওকাত, হাদীস নং ২৬।}
দলিল নং : ৪
সিহাহ্ সিত্তার অন্যতম হাদীসগ্রন্থ জামে তিরমিজি শরীফ ১ম খ-, ৯২ পৃষ্ঠায় একটি অধ্যায় রয়েছে, যার নাম ‘বাবু মাযা ফি লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ সেখানে হযরত উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রজনীতে আমি দয়াল নবী রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বিছানায় পেলাম না। এই জন্য তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর আমি জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে নবীজিকে আকাশের দিকে মাথা উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি এ ধারণা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমার উপর অবিচার করেছেন? হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহা বললেন, আমি এমন ধারণা করিনি, ভেবেছিলাম আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকট গমন করেছেন। তখন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমালেন নিশ্চয় আল্লাহ পাক শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত্রে প্রথম আকাশে তাজাল্লী ফরমান, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) বনী কালব গোত্রের মেষের পশমসমূহের চেয়েও বেশি লোকের গুনাহ ক্ষমা করেন। উল্লেখ্য, এই বনী কালব-এর মেষের সংখ্যা ছিল ৩০,০০০। {তথ্যসূত্র : (১). মুসনাদে আহমদ, খ--১৮, পৃষ্ঠা-১১৪, হাদীস নং-২৫৯৬, মোট ২১টি হাদীস রয়েছে। (২). মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, খ--১০, পৃষ্ঠা-৪৩৮, হাদীস নং-৯৯০৭।
দলিল নং : ৫
শেরে খোদা হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে মারফু মুত্তাছিল সনদে রেওয়ায়েত করা হয় যে, আল্লাহ হাবীব নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান, যখন শাবানের ১৫ তারিখের রাত্র আগমন করে তখন তোমরা রাত্র জাগরণকরতঃ মহান আল্লাহ তা’য়ালার এবাদত-বন্দেগী কর এবং এর পূর্ববর্তী দিনে (১৫ তারিখে) রোজা পালন কর। কেননা চৌদ্দ তারিখের সূর্য অস্ত যাওয়া তথা ১৫ তারিখের রাত্র আরম্ভ হওয়ায় সাথে সাথে মহান আল্লাহ তা’য়ালা দুনিয়ার আসমানে স্বীয় তাজাল্লী প্রকাশ ফরমান। অর্থাৎ দুনিয়াবাসীর প্রতি বিশেষ রহমতের দৃষ্টি দানকরতঃ দয়াপূর্ণ কুদরতী আওয়াজে আহ্বান করে থাকেন। আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আজকের এ পবিত্র রাত্রে আমি আল্লাহ দরবারে নিজের কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। রুজি-রিজিক চাওয়ার আছ কি? আমি তোমাদের চাহিদা অনুপাতে রিজিক দানের ফয়সালা করে দিব। কোন বিপদগ্রস্ত লোক বিপদ মুক্তির জন্য প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তোমাদের বিপদ দূরীভূত করে দিব। এমন আরো বিষয়ে কেউ প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তা সবই তোমাদেরকে দান করব। মহান আল্লাহ তা’য়ালার এরূপ করুণাপূর্ণ ঘোষণা সুবহে সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকে। {তথ্যসূত্র : (১). ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা-১০০। (২), মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১১৫।
দলিল নং : ৬
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত যখন আগমন করে তখন মহান আল্লাহ তা’য়ালা রহমতের তাজাল্লী ফরমান এবং তিনি তার সমস্ত বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারীকে ক্ষমা করেন না। {তথ্যসূত্র : (১). বাজ্জার, খ--১, পৃষ্ঠা-৯৩। (২). বায়হাকী শরীফ, খ--৩, পৃষ্ঠা-৩৭৮।
দলিল নং : ৭
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে মহান আল্লাহ রহমতের ভা-ার নিয়ে তার সকল সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং এ রাতে হিংসুক ও হত্যাকারী ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। {তথ্যসূত্র : (১). মুসনাদে আহমদ, খ--৬, পৃষ্ঠা-২৩৮, হাদীস নং-১৬৪২।}
ইসলামী মনীষাতের বক্তব্য : বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, হা-মী-ম প্রকাশ্য মহাগ্রন্থ আল কোরআনের শপথ, যে কোরআনকে আমি মুবারক (বরকতময়) রাতে নাজিল করেছি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এ তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত যা হওয়ার আছে, তা আল্লাহপাক ফয়সালা করে দিয়েছেন। শপথ উজ্জ্বল প্রকাশ্য গ্রন্থ তথা কোরআনের যাকে আমি বরকতময় রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনীতে নাজিল করেছি, ঐ ১৫ শাবানের রাতটি হচ্ছে লাইলাতুল বরাআত, এবং অধিকাংশ মোফাসসিরীনে কেরাম এ মত পোষণ করেছেন। (গুনিয়াতুত্ত্বালেবীন, খ--১, পৃষ্ঠা-৬৮৪। আরো আলোচনা ১৮৭ পৃষ্ঠায় রয়েছে।)
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী, ইমাম সবুকীর (রঃ) থেকে নকল করে বলেন, উক্ত শবে বরাতের রাত্রে বান্দার সারা বৎসরের গুনাহ মাফের বদলা হয়ে যায়। শুক্রবার রাত্রের ইবাদত সাপ্তাহিক গুনাহ মাফের বদলা এবং শবে ক্বদরের রাত্রের ইবাদত সারা জিন্দেগীর গুনাহ মাফের বদলা হয়ে যায়। এই জন্যই এ রাত্রসমূহে আল্লাহ নৈকট্যলাভের আশায় জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে গুনাহ মাফের উছিলা হয়ে যায়। তাই এ রাত্রসমূহকে গুনাহ মাফের উছিলা বলা হয়। (মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃষ্ঠা-৬৪০)
ফিকহে হানাফী : আল্লামা শামী, ইবনে নুজাইম, আল্লামা শরমবুলালী, শাইখ আব্দুল হক দেহলভী, মাওলানা আব্দুল হক লাখনভী, মুফতী মুহাম্মদ শফী, মুফতী তাকী উসমানীসহ উলামায়ে হানাফীয়া মতামত হল, শবে বরাতে শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী জাগ্রত থেকে একাকীভাবে ইবাদত করা মুস্তাহাব। তবে এর জন্য জামাআত বদ্ধ হওয়া যাবে না। (আদ-দুররুল মুখাতার, খ--২ খ-, পৃষ্ঠা-২৫।
ফিকহে শাফেয়ী : ইমাম শাফেয়ী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মতে, শাবানের ১৫তম রাতে অধিক অধিক দু’আ কবুল হয়ে থাকে। (কিতাবুল উম্ম, খ--১ম, পৃষ্ঠা-২৩১)
ফিকহে হাম্বলী : শাইখ ইবনে মুফলী হাম্বলী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), আল্লামা মনসুর আল বাহুতী, ইবনে রজর হাম্বলী প্রমুখ হাম্বলী উলামায়ে কেরামের মতে, শবে বরাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। (আল মাবদা, খ--২, পৃষ্ঠা-২৭, কাশফুল কিনা, খ--১, পৃষ্ঠা-৪৪৫)
ফিকহে মালেকী : ইবনে হাজ্ব মালেকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, সালফে সালেহীনগণ এ রাতকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং এর জন্যে পূর্ব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। (আল মাদখাল, খ--১ম, পৃষ্ঠা-২৯২)
ইবনে তাইমিয়ার অভিমত : লা-মাজহাবী ও খালাফী সম্প্রদায়ের অন্যতম ইমাম, আব্দুল আব্বাস আহমেদ ইবনে তাইমিয়া বলে, পনেরো শাবানের রাতের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক মারফু হাদীস ও আসারে সাহাবা বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালফে সালেহীনদের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাজের ব্যাপারে যতœবান হতেন। আর শাবানের রোজার ব্যাপারে তো সহীহ হাদীসসমূহই রয়েছে। (ইকতিযাউস সিরাতুল মুস্তাকিম, খ--২য়, পৃষ্ঠা-৬৩১)
আশরাফ আলী থানবী : কাওমী ও তাবলীগ সম্প্রদায়ের অন্যতম মুরুব্বী আশরাফ আলী থানবী বলে, ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ বলতে গিয়ে বলেন, কেউ কেউ লাইলাতুল মুবারাকাহ এর ব্যাখ্যা লাইলাতুল বরাত করেছেন। এর কারণ এই যে, বিভিন্ন বর্ণনায় এ সম্পর্কেও বার্ষিক ঘটনাবলির সিদ্ধান্তের বিষয় এসেছে। (তাফসীর বয়ানুল কুরআনে, খ--২, পৃষ্ঠা-৯৯।)
কবর জিয়ারত : এ রাত্রে আপনজন যারা কবরে তাদের কবর জিয়ারত করবেন। স্ব স্ব এলাকার আওলিয়ায়ে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীনদের মাজার জিয়ারত করা অতি উত্তম। এতে ফয়েজ ও বরকত হাসেল হয়। তবে হ্যাঁ কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সারা রাত্র ব্যয় করে দেয়াটা বোকামী। যেহেতু সুন্নত আদায়ের লক্ষ্যে আয়ত্বের ভেতরে নিকটতম মাজার শরীফ ও কবর জিয়ারত করলে আদায় হয়ে যায়। কেনান, প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে মা আয়েশা সিদ্দিকা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) শা’বানের ১৫ তারিখের রাতে জান্নাতুল বাকীতে মোনাজাতরত অবস্থায় পেয়েছেন। (জামে তিরমিজি, ১ম খ- ৯২ পৃষ্ঠা, মুসনাদে আহমদ, ১৮তম খ-, পৃঃ ১১৪, হাদীস নং-২৫৯৬। মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, ১০ম খ-, পৃঃ ৪৩৮, হাদীস নং-৯৯০৭।)
তাহলে আমাদেরকে শবে বরাত পালন করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা সকলকে সঠিক বিষয়টি বুঝার তাওফিক দান করুক। আমিন।
মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।