শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২২, ০০:০০

শবে বরাত : বরকতময় একটি রাত
মাওঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন

শব-ই-বরাত বা মুক্তির রাত। মাহিমান্বিত এ রাতে মহান আল্লাহর কাছে পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিষ্কৃতি লাভের পরম সৌভাগ্যের রজনী। মধ্য-শাবান হচ্ছে আরবি শা’বান মাসের ১৫ তারিখ, যা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে শবে বরাত বা শব-ই-বরাত নামে পালিত একটি পুণ্যময় রাত। ‘শব-ই-বরাত’ দুটি শব্দের সমষ্টি। প্রথম শব্দটি ‘শব’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ রাত রজনী। দ্বিতীয় শব্দটি ‘বরাত’ আরবি শব্দ, যার অর্থ মুক্তি। এভাবে শব-ই-বরাত অর্থ মুক্তির রাত। বাংলা ভাষায় বরাত শব্দটি ব্যবহৃত ও প্রচলিত, যার অর্থ ভাগ্য, অদৃষ্ট। এক্ষেত্রে শব-ই-বরাত অর্থ হবে ভাগ্যরজনী। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানগণ বিভিন্ন কারণে এটি পালন করেন। তবে এক এক দেশে এই মহিমান্বিত রজনীর নাম আলাদা আলাদা। ইরান ও আফগানিস্তানে শবে বরাত নিসফে শাবান, মালয় ভাষাভাষীর কাছে নিসফু শাবান এবং আরবি ভাষাভাষীর কাছে এই বরকতময় রজনী নিসফ শাবান নামে পরিচিত। কোনো কোনো অঞ্চলে লাইলাতুল দোয়াও বলা হয়। আমাদের দেশে এই রাত ‘শবেবরাত’ এবং লাইলাতুল বরাত নামে পরিচিত।

মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং নিজেদের একতা ও সংহতি রক্ষা করা ইসলামের একটি মৌলিক ফরজ। তেমনি সুন্নাহর অনুসরণ তথা আল্লাহর রাসূলের শরীয়ত এবং তাঁর উসওয়াহ ও আদর্শকে সমর্পিত চিত্তে স্বীকার করা এবং বাস্তবজীবনে চর্চা করা তাওহীদ ও ঈমান বিল্লাহর পর ইসলামের সবচেয়ে বড় ফরজ। সুতরাং সুন্নাহর অনুসরণ যে দ্বীনের, বিধান উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং বিভেদ ও অনৈক্য থেকে বেঁচে থাকাও সেই দ্বীনেরই বিধান। এ কারণে এ দুইয়ের মাঝে বিরোধ ও সংঘাত হতেই পারে না। সুতরাং একটির কারণে অপরটি ত্যাগ করারও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এখন আমরা এই দুঃখজনক বাস্তবতার সম্মুখীন যে, হাদীস অনুসরণ নিয়ে উম্মাহর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই অবস্থা প্রমাণ করে, আমাদের অনেকে সুন্নাহ অনুসরণের মর্ম ও তার সুন্নাহসম্মত পন্থা এবং সুন্নাহর প্রতি আহ্বানের সুন্নাহ্সম্মত উপায় সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে উদাসীন। তদ্রƒপ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির সঠিক উপলব্ধি এবং ঐক্যবিনাশী বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির শিকার। সুন্নাহর অনুসরণ এবং উম্মাহর ঐক্য উভয় ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে চলমান অবহেলা ও ভুল ধারণা ব্যাপক।

ইদানীংকালে শবে বরাত নিয়ে মানুষদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। কেউ কেউ এর ফাযাইল বর্ণনা করছেন, আবার কেউ কেউ এর অস্তিত্বকেই পুরোদমে অস্বীকার করে বসছেন। আবার কেউ কেউ আমলের নামে অনেক বিধর্মীদের রেওয়াজও অনুসরণ করছেন। উম্মতের এই করুণ অবস্থায় যেখানে আমাদের এক হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার, সেখানে প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে কলহ সৃষ্টি করা এবং এ নিয়ে মাতামাতি করা উম্মতের ঐক্যের জন্য অনেক ক্ষতিকারক। তবে উম্মতের ঐক্যের পাশাপাশি, কোরআন-সুন্নাহর সঠিক বুঝের অভাবে কেউ যেন কোন আমল থেকে বিচ্যুত না হয়ে পড়েন কিংবা আমলের নাম করে বিদআত বা শরীয়ত-বিরোধী কাজে লিপ্ত না হয়ে পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরি। কারণ আমরা সবাই জানি, আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্যে। তাই ইবাদতে যাতে কম না হয় কিংবা ইবাদতে যাতে ত্রুটি না হয়, এজন্য আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।

এতোদিন পর্যন্ত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর মানুষ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিলো। তারা এ রাতটি উপলক্ষে নানা অনুচিত কাজকর্ম এবং রসম-রেওয়াজের অনুগামী হচ্ছিলো। ওলামায়ে কেরাম সবসময়ই এসবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনো করছেন। আবার ইদানীং আবার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবি হলো, ইসলামে শবে বরাতের কোনো ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যতো রেওয়ায়েত আছে সব মওযু বা যয়ীফ। এসব অনুযায়ী আমল করা এবং শবে বরাতকে বিশেষ কোন ফজিলতপূর্ণ রাত মনে করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নয়। তারা এসব বক্তব্য সম্বলিত ছোটখাট পুস্তিকা ও লিফলেট তৈরি করে মানুষের মধ্যে বিলি করে। বাস্তব কথা হলো, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিল না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়। ইসলাম ভারসাম্যতার দ্বীন এবং এর সকল শিক্ষাই প্রান্তিকতা মুক্ত সরল পথের পথ নির্দেশ করে। শবে বরাতের ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হলো, এ রাতের ফজিলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনো রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদ্যাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এই রাতের ফজিলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে, তার সবগুলোকে মওযু বা যয়ীফ মনে করা যেমন ভুল, অনুরূপ এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।

মুসলিম উম্মাহের মাঝে রাতটির এহেন চর্চা না আজকে এই মাত্র জন্ম নিয়েছে, না বছর কয়েক আগে, না একটি মাত্র যুগের তফাতে এর আগমন ঘটেছে। বরং ইসলামের শুরু লগ্ন থেকে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরেই এর চর্চা চলে আসছে। আবার এমনও নয় যে, কারো ভিন্ন প্রক্রিয়ার স্পন্দনে রাতটির গুরুত্ব মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। বরং এ রাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে যেমনি অপ্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে তেমনি বেশ কিছু হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে এ রাতের মাহাত্ম্য-গুরুত্ব ও আমলসমূহ স্বীকৃত-প্রমাণিত। এ সকল কারণে যুগ যুগ ধরে সকল ওলী বুজুর্গ, আহলে হক নবীর সাচ্চা উম্মত শবেবরাতের মর্যাদা দিয়ে এসেছেন। ওলামা-মুহাদ্দিসীন, আওলিয়া-বুযুর্গানেদ্বীন, ফুকাহা-আইম্মায়ে মুজতাহেদীনের কাছে এ রাতের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য ও ফজিলত স্বতঃস্বীকৃত। তারা সুস্পষ্ট করে বলে গেছেন, শবেবরাতে যে কোন ইবাদত একটি মুস্তাহাব ও ঐচ্ছিক আমল-এটাকে অস্বীকার করা বা গুরুত্বহীন বলা যেমনিভাবে কুরআন-হাদীসকে অস্বীকার করার নামান্তর ঠিক তেমনিভাবে একে পুঁজি করে নিজের পক্ষ থেকে বিদআতে সায়্যিআহ যুক্ত করা বা এটাকে পার্থিব কোনো আনন্দ উৎসবের ন্যায় মনে করা সাংঘাতিক ধরনের গুনাহের কাজ। ইসলামে শবে বরাত বলতে কিছু নেই-এ ধারণাটির উৎপত্তি খুব বেশি দিন আগের নয়। যারা এ কথা বলে থাকেন, তারা সবাই মিথ্যুক এবং ফিতনা সৃষ্টিই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। টিভি, রেডিও ও তথ্যপ্রযুক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারা ইসলামের নামে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার এবং নবীর সুন্নাত থেকে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আর অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের সামনে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করলেও তারা তা মানতে নারাজ। হুজুরে পাক (সঃ) বলেছেন, আমার পরবর্তী উম্মতেরা পূর্ববর্তীদের নিচু চোখে দেখবে। তারা তাদের ভর্ৎসনা করবে এবং বলবে যে, তারা ভুল করেছে এবং ভুল বুঝেছে।

আল-কোরআনের আলোকে শব-ই-বরাত

পবিত্র কোরআনের ২৫তম পারা ও ৪৪নং সূরা দুখানের শুরুতে যে পাঁচটি আয়াত রয়েছে সে আয়াতগুলোই মূলত শবে বরাত ও পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ক আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাফসীরে কবীর, তাফসীরে রুহুল মাআনী, তাফসীরে রুহুল বায়ান, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে তবরী, তাফসীরে বগবী,তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে ইবনে কাসির ইত্যাদি পবিত্র কোরআনের বড় বড় তাফসীর গ্রন্থগুলোর মাঝে বিচার বিশ্লেষণ করার পর অভিজ্ঞ আলেমদের নিকট এ কথা সুস্পষ্ট যে, উক্ত আয়াতের ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ (বরকতময় রাত) শব্দের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য তাফসীর হলো শবে ক্বদর, শবে বরাত নয়। তবে সাথে সাথে জমহুর উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত এ-ও যে, প্রথম মত অগ্রাধিকার পেলেও (অর্থাৎ শবে ক্বদর) দ্বিতীয় মতকে (শবে বরাত) উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।

আল-হাদিসের আলোকে শব-ই-বরাত

শবে বরাত ও তার ফাযায়েল সম্পর্কিত অনেক হাদীসই হাদীসের কিতাবে দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে কিছু হাদীস সহীহ, কিছু হাদীস হাসান, কিছু জঈফ (তবে অতি দুর্বল নয়)। তদুপরি এ জঈফ হাদীসগুলো বহু সহীহ ও হাসান হাদীসের সমর্থন ও সহযোগিতায় আমলের যোগ্য হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। যা উসূলে হাদীসের সর্বসম্মত নীতিমালা। ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় দলীল হলো হাদীস। আর হাদীস দ্বারা শবে বরাতের ফজিলত সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত। তাই কোরআনে শবে বরাতের কথা নেই বলে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করার মানেই হলো মহানবী (সঃ)-এর হাদীস অস্বীকার করা। এটা কোরআনের দোহাই দিয়ে হাদীস অস্বীকার করারই একটি চক্রান্ত। সিহাহ সিত্তারই দুটি কিতাব তিরমিযী শরীফ ও সুনানে ইবনে মাজাহতে শুধু যে শবে বরাত-এর ফজিলত সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত আছে তা নয়, বরং ইমাম তিরমিযী (রহঃ) তাঁর তিরমিযী শরীফে এবং ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁর সুনানে পনের শাবানের ফজিলত নিয়ে আলাদা বাব বা অধ্যায়ই লিখেছেন। সিহাহ সিত্তার বাইরেও অনেক ইমাম তাঁদের জগদ্বিখ্যাত বড় বড় হাদীসগ্রন্থে শবে বরাত ও তার ফজিলত নিয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমন : ইমাম তাবরানী রচিত ‘আল কাবীর’ এবং ‘আল আওসাত’, ইমাম ইবনে হিব্বান রচিত ‘সহীহ ইবনে হিব্বান’, ইমাম বায়হাকী রচিত ‘শুআবুল ঈমান’, হাফেয আবু নুআইম রচিত ‘হিলয়া’, হাফেয হায়ছামী রচিত ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’, ইমাম বাযযার তাঁর ‘মুসনাদ’-এ, হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী রচিত ‘আততারগীব ওয়াত-তারহীব’, ইমাম আহমদ তাঁর ‘মুসনাদ’-এ, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাফেয আব্দুর রাজ্জাক এর ‘মুসান্নাফ’-এ।

মুফাসসিরে কেরামের নিকট শব-ই-বরাত

সূরা দুখানের তাফসীরে অধিকাংশ যুগবিখ্যাত মুফাসসিরে কেরামের সিদ্ধান্ত এই যে, ‘লাইলাতুম মোবারকাহ’ বলতে ‘শবে ক্বদর’ই উদ্দেশ্য, শবে বরাত নয় যদিও অনেক মুফাসসিরে কেরামই আবার শবে বরাতকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু এখানে গভীরভাবে লক্ষ্যণীয় যে, যারা এ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ শব্দের ব্যাখ্যায় ‘ শবে ক্বদর’কে প্রাধান্য দিয়েছেন, তারা কেউই কিন্তু শবে বরাত নামক মধ্য-শাবানের রাতের গুরুত্বের ব্যাপারে যে সব হাদীস বর্ণিত আছে সেগুলোকে ভিত্তিহীন বলে মত প্রকাশ করেননি। বরং তারা শুধুমাত্র উক্ত আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’-এর ব্যাখ্যা যে শবে বরাত নয় শুধু এ কথাটিই ব্যক্ত করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে যে সব তাফসীরবিশারদ উক্ত আয়াতে লাইলাতুম মুবারাকাহ-এর ব্যাখ্যায় শবেবরাত বলে সাব্যস্ত করেছেন, তারাও কখনও কুরআন অবতরণের রাত্রি, মহা পবিত্র রজনী শবে ক্বদরকে গুরুত্বহীন বলে মত পোষণ করেন নি। বরং তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ রাত বলেই সাব্যস্ত করেছেন।

মুহাদ্দিসীনে কেরামের নিকট শব ই বরাত

শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কিত হাদীসগুলোকে মুহাদ্দিসীনে কেরামেরা বরাবরই সনদসহ বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন এবং তার মধ্যে কিছু হাদীসকে সহীহ, কিছুকে হাসান (সহীহের অন্তর্ভুক্ত), আর কিছুকে দুর্বল (কম মাত্রাসম্পন্ন) বলে রায় দিয়েছেন। মুহাদ্দিসগণ যদিও কোনো কোনো হাদীসের দোষ ত্রুটি আলোকপাত করেছেন, কিন্তু কেউ সেগুলোকে ভিত্তিহীন জাল হাদীস বা অগ্রহণযোগ্য হাদীস বলেন নি, এমনকি তারা কোনো হাদীসের মতনকেও যঈফ বলেননি। উপরন্তু তারা উসূলে হাদিসের নীতি অনুযায়ী শবে বরাতের ফজিলত আছে বলে মত প্রদান করেছেন এবং এ রাতে সাহাবারা, সলফে সালেহীনরা ইবাদতে মগ্ন থাকতেন বলে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

সালাফী/আহালে হাদিসের নিকট শব-ই-বরাত

ইদানীং আমাদের কতক সালাফী বা গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুকে দেখা যায়, তারা নানা ধরনের লিফলেট বিলি করেন। তাতে লেখা থাকে যে, শবে বরাত (লাইলাতুল নিসফি মিন শাবান)-এর কোন ফজিলতই হাদীস শরীফে প্রমাণিত নেই। অথচ তাদের সবচেয়ে বড় গণ্যমাণ্য ইমাম, অধিকাংশ মাসয়ালা মাসায়েল ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তারা যার উদাহরণ সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে থাকে, শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাও (রহঃ) শবে বরাতের ফজিলতকে স্বীকার করেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, সাহাবারা, তাবেঈনরা এবং সালাফরাও এই রাতের বিশেষ মর্যাদা দিতেন। আবার আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ)-এর শিষ্য ইবনে রজব হাম্বলীও (রহঃ) এই রাতের ফজিলতের কথা উল্লেখ করেছেন। ঠিক তেমনি তাঁরই শিষ্য বর্তমান যুগের খ্যাতিমান হাদীস পর্যালোচক শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্বও শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কিত কিছু হাদীসকে সহীহ বা হাসান বলেছেন।

বর্তমান ওলামায়ে কেরামের নিকট শব-ই-বরাত

আমাদের দেশের প্রায় নব্বইভাগ মুসলিম হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। ওলামায়ে আহনাফ, ওলামায়ে হক্কানী ও আওলিয়ায়ে কেরামগণ শব-ই-বরাত সম্পর্কে অসংখ্য কিতাব, পুস্তিকা রচনা করেছেন। তাঁরা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সহীহ আমল করে পাক ভারত উপমহাদেশের হিন্দু সভ্যতাকে দূর করে নবীর আদর্শ বাস্তবায়নে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সে জন্যই আজ আমাদের দেশে আযান, নামাজ হচ্ছে। এমনকি হাজারো মাদ্রাসা, লক্ষাধিক মসজিদ, খানকা রয়েছে। এ রাতে আমল করা যদি বিদয়াত হতো তাহলে আওলিয়ায়ে কেরাম বিদয়াতি আমল করে এ দেশকে মুসলিম দেশে পরিণত করা সম্ভব হতো না। কারণ বিদয়াতি আলম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বিদয়াতী ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর শত্রু। সুতরাং বুঝতে হবে, পূর্ববর্তী হক্কানী ওলামায়ে কেরাম যে সকল আমল করেছেন তা অবশ্যবই কোরআন সুন্নাহর আলোকে হয়েছে। আমরা তা খুঁজে পাইনি। উসূলের পরিভাষায় নস চার প্রকার : ইবারাতুন নস, ইশারাতুন নস, দালালাতুন নস, ইকতেজাউন নস। অতএব চার প্রকার নসের ভিত্তিতে আমল করতে হবে। তারপরও আহলে হাদীস সালাফীরা শব ই বরাত নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকে। তার কিছু অংশ তুলে ধরলাম:-মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের জন্য একত্র হওয়া, ঐ দিন সিয়াম পালন করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট বিদআত। অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এটাই বলেছেন। এ ধরনের আমল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু (সাঃ)-এর যুগে যেমন ছিল না তেমনি ছিল না তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর যুগে। যদি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হতো তাহলে রাসূলে কারীম (সা) উম্মতকে সে সম্পর্কে সতর্ক ও উৎসাহিত করতে কার্পণ্য করতেন না। যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি লাইলাতুল কদর ও রমজানের শেষ দশ দিন ইবাদত-বন্দেগী করার ব্যাপারে মুসলিমদের উৎসাহিত করতে।

শব-ই-বরাতে আমল

শব-ই-বরাত রাতে নফল নামাজ আদায় করা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত. যিকির আযকার করা, দান-খয়রাত করা, কবর জিয়ারত করা উত্তম আমল। যদি সম্ভব হয় তাহলে সালাতুস তাসবীহ নামাজ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করবে। গভীর রজনীতে মহান প্রভুর দরবারে বান্দাহ নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দিদার লাভের আসায় মুনাজাত করবে। এই রাতে আগামী এক বছরের যাবতীয় বিষয়াদি নির্ধারিত হয় এবং শবে ক্বদরে সংশ্লিষ্ট ফেরেস্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই রাতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শাফায়াতের পূর্ণ অধিকার প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র এই রাতটি বিশ্বের মুসলমানদের ন্যায় বাংলাদেশের মুসলমানরাও যথাযোগ্য মর্যাদায় এবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে পালন করবে। রাসূল (সাঃ) আরেকটি হাদিসে বলেছেন, ‘এই রাতে আসমান থেকে ৭০ হাজার ফেরেশতা জমিনে এসে ঘুরে ফিরে ইবাদতকারীগণকে পরিদর্শন করেন এবং তাদের ইবাদতসমূহ দেখেন। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে ইবাদত করবে এবং দিনে রোজা রাখবে, দোজখের আগুন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি ১৪ শাবানের রাতে নামাজ আদায় করে, তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং সদ্য প্রসূত নবজাত শিশুর মতো গুনাহ থেকে পবিত্র হবে।

মাওঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন : খতিব, কালেক্টরেট জামে মসজিদ, প্রভাষক (আরবি), মান্দারী আলিম মাদ্রাসা, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়