প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
মহান আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত মানুষের জীবনকাল। আর এ জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় হলো ‘যৌবনকাল’। জীবন গঠন, নেক আমল করা, ভবিষ্যৎ জীবনের সঠিক ভিত্তি তৈরি করা, দেশ ও জাতি গঠনের শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদির ভিত্তি এ যৌবনেই তৈরি হয়। শৈশবের দূরন্তপনা, যৌবনের ভিত রচনার উপর দাঁড়িয়েই বার্ধক্যকে অতিক্রম করতে হয়। বাংলাদেশের যুবনীতি অনুসারে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের জনগোষ্ঠীকে যুবক বলা হয়। এ বিশাল জনগোষ্ঠী দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অন্যতম নিয়ামক। যৌবনের এই সময়টা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ যৌবনকালে আল্লাহ তাআলা যে নেয়ামত মানুষকে দান করেছেন তার সঠিক ও যথাযথ ব্যবহার করলে এগিয়ে যেতে পারে দেশ, জয় করা যায় বিশ্বকেও। যুগে যুগে যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামে, অন্যায়প্রতিরোধে, বাতিলের অপচেষ্টা প্রতিহত করতে যুবকরাই এগিয়ে এসেছিল। আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সত্য ও ন্যায়ের ঝা-া। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহ, তিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন, অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তি দান করেন, অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সূরা রূম-৫৪)
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন নবীদেরকে নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব প্রদান করেছেন এ যৌবন বয়সে। যাতে তাঁরা সমাজে আল্লাহর বিধানের আলোকে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করে সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতে পারেন। হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালাম এর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, “যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল, তখন তাকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম। এমনিভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দেই।” (সূরা ইউসুফ-২২)
হযরত ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও কাতাদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালাম এর বয়স হয়েছিল তখন তেত্রিশ বছর। হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, চল্লিশ বছর। আর এখানে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দ্বারা নবুয়াত প্রদান করাকেই বুঝানো হয়েছে।
হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এর প্রসঙ্গে বলেন, “(মুসা) যখন পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল এবং তার বিকাশ পূর্ণতা লাভ করলো তখন আমি তাকে হুকুম ও জ্ঞান দান করলাম, সৎলোকদেরকে আমি এ ধরণেরই প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা কাসাস-১৪)
হযরত সোলায়মান আলায়হিস্ সালাম এর যৌবন কালে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “অতঃপর আমি সোলায়মানকে সে ফয়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়েছিলাম।” (সূরা আম্বিয়া-৭৯)
অনুরূপ হযরত ইয়াহইয়া আলায়হিস্ সালামকে যৌবনকালে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে বলেন, “হে ইয়াহয়া দৃঢ়তার সাথে এই গ্রন্থ ধারণ কর। আমি তাকে শৈশবেই বিচার বুদ্ধি দান করেছিলাম।” (সূরা মরইয়াম-১২)
হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এর যৌবনকালে যখন ফিরআউনের অত্যাচারের মাত্রা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল, তখন তিনি মিসর থেকে বের হয়ে মাদয়ানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মাদয়ান ছিল ফেরআউনের রাজ্যের বাইরে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর যখন সে মাদয়ানের কুয়ার কাছে পৌঁছল, সে দেখলো অনেক লোক তাদের পশুদের পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের থেকে আলাদা হয়ে একদিকে দুটি মেয়ে নিজেদের পশুগুলো আগলে রাখছে। হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম মেয়ে দুটিকে জিজ্ঞাসা করল তোমাদের সমস্যা কোথায় হয়েছে? তারা বললো, আমরা আমাদের জানোয়ার গুলোকে পানি পান করাতে পারিনা যতক্ষণ না এ রাখালেরা তাদের জানোয়ারগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর আমাদের পিতা একজন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তি।” (সূরা কাসাস-২৩)
যৌবনকাল আল্লাহর আমানত
যৌবনকাল হলো আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। এটি মানুষের জীবনে একবারই আসে। অনেকটা মেহমানের সাথে তুলনীয়। মেহমান যে রকম এসেই চলে যায় যৌবনকালও তেমন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমরা পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে গণিমত বা সুবর্ণ সুযোগ মনে কর, ১. তোমরা বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে, ২. সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, ৩. দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে, ৪. ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে, ৫. মৃত্যুর পূর্বে হায়াতকে কাজে লাগাও। (হাকিম মোস্তাদরাক-৭৮৪৬, তিরমিজি, মিশকাত-৫১৭৪)।
সুতরাং যৌবনকাল বলে হাসি-ঠাট্টা, আমোদ-প্রমোদ, গান-বাজনা, হই-হুল্লোড় নয়। ক্ষণিকের এই নেয়ামত আল্লাহ তাআলা পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন। যে এ সময়টাকে সদ্ব্যবহার করবে, আল্লাহর বিধান পালন করবে তার জন্য পরবর্তী জীবন সুখের হবে, পরকালে নাজাতের ব্যবস্থা হবে। আর যদি এ সময়টাকে শয়তানের পথে অতিবাহিত করে তাহলে পরবর্তী জীবনে তাকে এর ফল ভোগ করতে হবে।
যৌবনকালের পরকালীন জবাবদিহিতা
মানুষের ইহকালের প্রতিটি কাজকর্মের হিসাব আল্লাহর সামনে পেশ করতে হবে। যে বিন্দু পরিমাণ ভালো কাজ করবে তাকে তা দেখানো হবে। আর যে বিন্দু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে তাকে তাও দেখানো হবে। (সূরা যিলযাল : ৭-৮)।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ব্যতীত কোনো আদম সন্তান আল্লাহর সামনে থেকে এক পাও নড়তে পারবে না। ১. তার জীবন কোথায় ব্যয় করেছে? ২. যৌবনকে কোথায় ক্ষয় করেছে? ৩. সম্পদ কোন পথে অর্জন করেছে এবং ৪. কোন্ পথে ব্যয় করেছে? ৫. জ্ঞান অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (তিরমিযি-২৪১৬)
যুবকদের জন্য পরকালীন পুরস্কার
যৌবনকালে জবাবদিহিতা যেমন রয়েছে তেমনি যে যুবক তার জীবনের এই সময়টুকুতে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করতে পারবে তার জন্য হাশরের ময়দানে অনেক বড় পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। হযরত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে (হাশরে) ছায়া প্রদান করবেন, যে দিন তার (আরশের) ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবেনা। তারা হলেন,
এক. ন্যায়পরায়ণ শাসক, দুই. সে যুবক যে তার যৌবনকালকে আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করে, তিন. সে ব্যক্তি যার অন্তরসমূহ মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, চার. দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে। যারা এই ভালোবাসাতেই মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসাতেই বিচ্ছিন্ন (মৃত্যু) হয়, পাঁচ. সে ব্যক্তি যাকে কোনো কামিনী নারী অসৎ উদ্দেশ্যে আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি, ছয়. যে ব্যক্তি গোপনে দান করে। এমনকি ডান হাতে দান করলে বাম হাত পর্যন্ত তা জানতে পারে না এবং সাত. আর সে ব্যক্তি যে একাকী অবস্থায় আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করে, তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়। (সহীহ বুখারী-১৪২৩, ৬৮০৬, সহীহ মুসলিম-১০৩১)
আল কুরআনে বর্ণিত বিস্ময়কর
সাত যুবকের ঘটনা
হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম এর পর তার উম্মতগণের মধ্যে অনেকে মূর্তিপূজা শুরু করল। অনেক অত্যাচারী শাসকের জন্ম হলো। তন্মধ্যে একজন জালিম শাসক ছিলেন দাকইয়ানুস বাদশা। তার আমলে কেউ মূর্তি পূজা না করলে তাকে নির্যাতন করা হতো। এশিয়া মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ‘আফসুস’ বা ‘তারসুস’ নামক শহরে সাতজন ইমানদার যুবক বাস করত। তারা হলেন, ১. মাকসালমীনা, ২. ইয়ামলীখা ৩. মারতুনাস, ৪. বায়নুনাস ৫. সারীনুনাস, ৬. যুনুওয়ানুস ৭. কাশফীত তানুনাস। তাদের সাথে একটি কুকুর ছিল ‘কিতমীর’। মূর্তিপূজা না করার কারণে বাদশা তাদের নানাভাবে নির্যাতন করত। এই সাতজন যুবক বাদশাহর অত্যাচার থেকে ঈমান বাঁচানোর জন্য পার্শ¦বর্তী একটি পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। যখন ঐ যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিলো তারা সেখানে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করতেন। গুহাতে থেকে তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন ঐ যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিলো, অতঃপর বললো “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে তোমার নিজ থেকে অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনা করার ব্যবস্থা কর।” (সূরা কাহাফ-১০)।
প্রায় তিনশ বছর পর্যন্ত ঐ যুবকরা পাহাড়ের গুহায় ঘুমিয়ে ছিলো। প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দুনিয়াতে আসার বিশ বছর পূর্বে বাদশাহ ‘বায়দরুস’ এর শাসনামলে এই আশ্চর্য ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে বাদশাহর উপস্থিতিতেই তারা নিজেদের শয়নকক্ষে গমন করেন এবং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মৃত্যুদান করেন। ঐ যুবকদের নীতি ছিলো যে শহরে এক আল্লাহর ইবাদত করা যায় না সেই শহর থেকে যেখানে নিরাপদে ইবাদত করা যায় সেখানে চলে যাওয়া উচিত। যুগে যুগে যেটা সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিস্ সালাম এর সুন্নাত ছিল। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “আমি তোমাকে তাদের সংবাদ সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। নিশ্চয়ই তারা কয়েকজন যুবক, যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের হিদায়াত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।” (সূরা কাহাফ-১৩)
ইসলামের সেবায় যুবকদের অবদান
প্রিয় নবী হযরত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইসলামের যে বাণী প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন তা সবার আগে যে সব পূণ্যবান সাহাবা গ্রহণ করে নেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন যুবক। বিচারের দায়িত্ব, প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে দায়িত্ব, সমরাভিযানের অগ্রভাগে নিয়োজিত করতেন যুবকদেরকে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গোপনে ঈমান ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য অনেক দিন হযরত আরকাম ইবনে আবু আরকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর ঘরে ছিলেন। তখন হযরত আরকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর বয়স বিশ বছর পার হয়নি। হযরত মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মত যুবকদের কে তিনি পবিত্র কুরআন সংকলন ও ওহি লেখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবদ্দশায় তারই অনুমতিক্রমে হাদীস সংকলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। যুবক সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু “সহিফা আস-সাদিকা” সংকলন তারই প্রমাণ বহন করে।
হযরত উসামা ইবনে যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন নবীজীর অত্যন্ত প্রিয় সাহাবী। তাঁর পিতা হযরত যায়দ ইবনে হারিসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মুতার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। ১১ হিজরী ২৬ সফর সোমবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রোমকদের মোকাবেলায় মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেখানের ‘উবনা’ নামক স্থানে সৈন্য সমাবেশ করার নির্দেশ দেন। এটা ছিল প্রিয় নবীর জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রেরিত অভিযান। এ অভিযানে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মত মর্যাদাবান সাহাবাগণ ছিলেন। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নেতৃত্ব তুলে দেন বিশ বছরের যুবক হযরত উসামা ইবনে যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর হাতে। তাঁর নেতৃত্বের ব্যাপারে কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যদি তোমরা উসামার নেতৃত্বের ওপর প্রশ্ন কর, তাহলে তো তোমরা তার পিতার নেতৃত্বের প্রতিও প্রশ্ন করেছিলে। আল্লাহর কসম! সে নেতৃত্বের যোগ্য, আর আমার কাছে অধিক প্রিয়। (সহীহ মুসলিম, যায়েদ ইবনে হারেসা ও তার ছেলে উসামার ফাযাইল অধ্যায়) হুনাইনের যুদ্ধে যাওয়ার সময় ইত্তাব ইবনে উসাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে বিশ বছর বয়সে মক্কার গভর্নর নিয়োগ করেন।
যৌবনের শক্তি
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সাধারণত তিনটি অবস্থায় পরিবর্তিত করেন। শৈশবকাল থেকে শুরু হয়ে যৌবন কাল পার করে মানুষ বার্ধক্যে উপনীত হয়। শৈশব হলো দূরন্তপনার কাল। আর যৌবনতো গমনদ্রের গর্জন, নদীর প্রচ- ¯্রােত। বৈশাখের উত্তপ্ত হাওয়ার মতো। যা কোন বাধা মানে না। দেহের মধ্যে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতগুলোর পরিপূর্ণতা লাভ করে এখানেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদেরকে বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (সূরা নাহল-৭৮)
মানুষের চোখ, কান, হৃদয় ও অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় যৌবনকালে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। সোনালী যৌবনের ¯িœগ্ধ ছায়ায় অনেকেই যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদত করে জগৎবিখ্যাত হয়েছেন। তারা আপন আপন ক্ষেত্রে সম্মানিতও হয়েছেন জগৎবাসীর জন্য আলোর মশাল ছড়িয়ে দিয়েছেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কোনো এক যুবককে দেখে খুশি হয়ে বললেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অসিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাদেরকে মারহাবা জানাচ্ছি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীস শিখাবার বা বুঝাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর। (খতিব বাগদাদী)
একটি সুশীল সমাজ গঠনের জন্য অন্যতম চালিকাশক্তি হলো যুব সমাজ। এ সময়েই গতিশীল প্রাণশক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের সাথে থাকে নতুন নতুন কাজের উদ্দীপনা, লক্ষ্যে পৌছার অপূর্ব সাধনা। তারাই পারবে মানবতার জয়গান শ্লোগানকে উঁচু করে ধরতে। যেখানেই অন্যায়, অত্যাচার, কুসংস্কার, পাপাচার, শয়তানের প্রতারণার হাজারো ফাঁদ ছিটানো রয়েছে তার উপর ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের জয়গান গাইতে। আলোর মিছিলে শরিক হতে। কেননা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যে মৃত্যুকে ভয় করেনা। মানে না কোনো বাঁধা।
ইসলামী অনুশাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ
যৌবনকালে ইবাদতের জন্য শক্তি সামর্থ্য দুটিই থাকে। ফলে মানুষ বৃদ্ধ অবস্থার তুলনায় শুদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থায় ইবাদত করতে পারে। আবার যৌবনকালে মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সতেজ থাকায় বিভিন্ন পাপ কাজেও জড়িত হতে পারে। সেজন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-“হে যুবকের দল! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। আর যার বিবাহ করার সামর্থ্য নেই সে যে রোজা পালন করে। কেননা রোজা যৌন ক্ষমতাকে দমন করে।” (সহীহ বুখারী-৫০৬৫)
অনেক সময় যুবকরা বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে তারা দেশীয় ও ধর্মীয় নিয়ম নীতির বাইরে চলে যায়। আর এটি একজনকে দেখে অপরজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাই যুব সমাজের উচিত ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা করা। হাদীসে পাকে রয়েছে, একদা হযরত খাব্বাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সোনার আংটি পরিধান করলেন। নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন এখনো কি তোমার এই আংটি খোলার সময় হয়নি? হযরত খাব্বাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আজকের পর থেকে আমার হাতে আর দেখবেন না। অতঃপর তিনি তা ফেলে দেন। (সহীহ বুখারী-৪৩৯১)
যুবকদের জন্য যথাযথ দিকনির্দেশনা প্রদান
কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক পর্যন্ত সকল শ্রেণির মানুষের কাজকর্ম ও লেনদেনের মাধ্যমে স্বভাব চরিত্র প্রকাশ পায়। সুন্দর আখলাক হলো উন্নত জাতির জীবনীশক্তি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, চরিত্রের বিচারে যে উত্তম, মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণতম ঈমানের অধিকারী। (আবু দাউদ)
অন্য হাদীসে তিনি বলেছেন-মুমিনের পরিমাপ দন্ডে কিয়ামতের দিন উত্তম চরিত্র অপেক্ষা ভারী জিনিস আর কিছু নেই। (তিরমিযী)
চরিত্রবান মানুষ আমলের দিক দিয়ে দুর্বল হলেও উত্তম চরিত্র তাকে পরকালে মর্যাদাবান করবে। যুবকদের নৈতিক চরিত্রের বিষয়গুলো চর্চা করে উত্তম চরিত্রে বলিয়ান হওয়া আবশ্যক। যেমন, বড়দের সালাম দেয়া, ছোটদের ¯েœহ করা, সৎকাজে সহযোগিতা করা, সৌজন্যতা বজায় রাখা, অন্যায়প্রতিরোধ করা ইত্যাদি মূলনীতিগুলো মেনে চলতে হবে।
হযরত আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন,যে যুবক কোন বৃদ্ধকে তার বয়সের কারণে সম্মান করলো, তবে তার পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা অন্য কাউকে দিয়ে তকে সম্মান করাবেন। (তিরমিযী-২০২৯, কিতাবুল বিররে ওয়াস সিলাহ)
দৃষ্টি সংযত রাখা আবশ্যক
যৌবনকালে দৃষ্টি সংযত রাখা আবশ্যক। কেননা ব্যভিচারে প্ররোচিত হওয়ার প্রথম ধাপ হলো কূদৃষ্টি। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে দৃষ্টিশক্তি হেফাজতের প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “মুমিনদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।” (সূরা আন নূর-৩০)
নারী পুরুষের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ একটি সহজাত ও সৃষ্টিধর্মী প্রক্রিয়া। কিন্তু এটি ঈমানদারের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষার বিষয়ও বটে। তাই ইসলামে দৃষ্টি শক্তি হেফাজতের সাথে সাথে পর্দার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো দেখা, জিহবার ব্যভিচার হলো কথা বলা। কুপ্রবৃত্তি কামনা ও বাসনা সৃষ্টি করে আর যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণীত করে। (সহীহ বুখারী-৬২৪৩)
একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করা হলো পরনারীর প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়লে করণীয় কী? নবীজি বললেন, তোমার চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও। (আবু দাউদ-২১৪৮)
মার্জিত ও ভদ্র আচরণে অভ্যস্ত হওয়া
যুবকরা যৌবনের তাড়নায় সর্বদা উত্তেজিত থাকে। যে কোন চ্যালেঞ্জকে সহজেই গ্রহণ করতে চায়। সাহাবাগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে থেকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এমনকি ইসলামের উষালগ্নে যুবক সাহাবাদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এই যুবক সাহাবাগণ নিজেদের জীবনকে সুন্নাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আদলে গড়ে তোলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞাসা করেন বলোতো ঐ গাছ কোনটি যা মুমিনের দৃষ্টান্তস্বরূপ? আল্লাহর হুকুমে যা সবসময় ফল দেয় এবং এর পাতাগুলো ঝরে পড়েনা। (যুবক সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, আমার মনে হলো এটি খেজুর গাছ। কিন্তু সেখানে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থাকাতে আমি উত্তর দিতে সাহস পেলাম না)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজেই বললেন, এটি খেজুর গাছ। অতঃপর যখন বেরিয়ে এলাম তখন আমার বাবাকে বললাম, আমারতো মনে হয়েছিল গাছটি খেজুর গাছ। হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তবে কেন তুমি সেখানে বললেনা? তোমার এই সঠিক উত্তর আমার জন্য অমুক অমুক বস্তু থেকে অধিক প্রিয় ছিল। হযরত ইবনে উমর বলেন, (আমি যুবক) হযরত আবু বকর ও আপনার নীরবতা আমাকে বলতে সাহস দেয়নি। (সহীহ মুসলিম-২৮১১)।
যুবক থেকে পরামর্শ গ্রহণ
ইরাক থেকে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর কাছে একটি প্রতিনিধি দল এলো। ওই দলের একজন যুবক কথা বলার জন্য খুবই আগ্রহী ছিলেন। খলিফা তা লক্ষ্য করে বলেন হে যুবক, বড়দের কথা বলতে দাও। যুবক একথা শুনে আরজ করল, হে খলিফাতুল মুসলেমীন! ব্যাপারটাতো বয়সের নয়। কারণ বয়সের কারণে সব জায়গায় অগ্রগণ্য হওয়ার বিধান থাকলে আপনার চাইতে অনেক প্রবীণ লোক জীবিত থাকতে আপনি খলিফা হতেন না। কারণ তখন খলিফার চেয়ে প্রবীন অনেক লোক ছিল। একথা শুনে খলিফা বললেন, হ্যাঁ এবার তুমি বলো। ইসলামের সোনালী যুগের গমনজ্জ্বল সাহাবাগণ যৌবনকাল থেকে ইসলামের সেবা করেছেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৩৭ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। অনুরূপ হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ২৭ বছর বয়সে, হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৩৪ বছর বয়সে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। বিশ বছর বয়সে তিনি বদর যুদ্ধে পতাকা বহন করেছিলেন। প্রিয় নবীজী নিজেই যুবকদের মহিমায় বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ওই যুবকদের প্রতি আশ্চর্য হন। যাদের মাঝে চিন্তার কোনো বিচ্যুতি নেই। (মুসনাদে আহমদ)
উপসংহার
প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন এর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলভিত্তি ছিল তাকওয়া। তাকওয়াবান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নিজেকে যাবতীয় পাপাচার থেকে বিরত রেখে আল্লাহ ও তার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাকওয়া সকল সৎগুণের মূল, মুমিনের চরিত্রের একটি মহৎ বৈশিষ্ট্য। প্রিয় নবীর সাহাবাগণ তাকওয়ার বলে বলীয়ান ছিলেন বলে সংখ্যায় কম হয়েও বদরের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। উহুদের যুদ্ধেও প্রাথমিক বিজয় মুসলমানদের পক্ষে ছিল। সাহাবায়ে কেরামগণ নবীজীর প্রেমে এতই বিভোর ছিলেন যে তাদের পরিবার-পরিজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান সমস্ত কিছুকেই তারা তুচ্ছ মনে করেছিলেন। কাফিরদের শত নির্যাতন সহ্য করেও যুবক বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, সুহাইব রুমী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মত সাহাবাগণ সত্যের পথ থেকে পিছপা হননি। তারা মাঠে ময়দানে, মসজিদে সর্বত্রই নবীজীকে আগলে রাখতেন। বদরের যুদ্ধে ইসলামের নামকরা শত্রু আবু জাহেলকে হত্যাও করেছিল হযরত মুআউয়াজ ইবনে আফরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও মুআজ ইবনে আফরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মত যুবক। আজকের যুবকদের জন্য করণীয় হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য পোষণ করা, অন্যায়-অবিচার, যিনা-ব্যভিচার, মিথ্যা-প্রতারণা, মাদক-দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম।