প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২১, ০০:০০
কুরবানি শব্দটি আরবী। আভিধানিক দৃষ্টিকোন হইতে উহার অর্থ হইল নৈকট্য লাভের উপায় হিসাবে যে কোন বস্তু ব্যবহার করা।অপর দিকে শরীয়তের পরিভাষায় কুরবানি বলা হয় ঐ নির্দিষ্ট জন্তুকে যাহা একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিদিষ্ট সময়ে একমাত্র মহান আল্লাহর নামে জবাই করা হয়।
কুরবানির ইতিকথা বা ঐতিহাসিক পটভূমি :
কুরবানির প্রচলন : সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা, তবে কুরআন, হাদীস এবং ইতিহাসের কিতাব সমূহ হইতে সংক্ষেপে যাহা জানা যায় তাহা হইল আজ থেকে প্রায় সাত হাজার ছয়শ’ পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে মানব গোষ্ঠির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান হাবিল ও কাবিল এর মধ্যে তাহাদের বোন আকলিমাকে বিবাহ করা নিয়ে কলহ বিবাদ দেখা দিলে হযরত আদম (আঃ) আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমে তাহাদেরকে এখলাছের সহিত কুরবানি করার আদেশ দেন এবং বলেন আমাদের মধ্যে যাহার কুরবানি গৃহীত হইবে তাহার সংগেই আকলিমার বিবাহ হইবে। এইভাবেই সর্বপ্রথম কুরবানির প্রথা চালু হয়।
কুরবানির প্রচলনের ঐতিহাসিক ঘটনা : আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর পুত্র দ্বয়ের ঐতিহাসিক ঘটনাটি আল্লামা ইবনে কাসীর তদীয় তাফসীর গ্রন্থে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সর্বস্তরের আলেমদের সর্বসম্মত রায় বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।
যে ঘটনাটি : যখন আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর স্ত্রী আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ)-এর প্রতি গর্ভ হইতে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান যমজ বা একই সাথে জন্ম গ্রহণ করিত তখন তাহারা পরস্পর ভাই বোন ছাড়া হযরত আদম (আঃ)-এর আর কোন সন্তান ছিলনা। অথচ ভাই বোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে পারে না। তাই আল্লাহ পাক উপস্থিত প্রয়োজনের তাগিদে হযরত আদম (আঃ)-এর শরীয়তে বিশেষ ভাবে এই নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ হইতে যে যমজ পুত্র ও কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করিবে তাহারা পরস্পর সহোদর ভাই বোন হিসাবে গণ্য হইবে। তাহাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হইবে কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণকারিনী কন্যা সহোদরা ভগিনী হিসাবেগণ্য হইবে না। অতএব, তাহাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হইবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন আকলিমা ছিল পরমা সুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত বোনটি ছিল কুশ্রি ও কদাকার। বিবাহের সময় হইলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত সহোদরা কুশ্রি বোন কাবিলের ভাগে পড়িল। ইহাতে কাবিল অসন্তুষ্ট হইল এবং হাবিলের শত্রু হইয়া দাড়াইল। কাবিল প্রতিজ্ঞা করিল যে, আমার সহজাত বোনকে আমার সংগে বিবাহ দিতে হইবে। যাহার ফলে হযরত আদম (আঃ) মহা সমস্যায় পড়িলেন। তাহার শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের এই দাবীকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। অতঃপর তিনি হাবিল কাবিলের মতভেদ দূর করিবার উদ্দেশ্যে বলিলেন - তোমরা উভয়েই আল্লাহ পাকের জন্য নিজ নিজ কুরবানি পেশ কর। যাহার কুরবানি গৃহীত হইবে সেই এই কন্যার পানি গ্রহণ করিবে অর্থাৎ তাহার সাথে বিবাহ হইবে। হযরত আদম (আঃ) - এর দৃঢ বিশ্বাস যে উভয়ের মধ্যে যে সত্য পথে আছে একমাত্র তাহার কুরবানিই গৃহীত হইবে। এই ব্যাপারে পবিত্র কালামুল্লাহ সূরা মায়েদার ২৭ নং আয়াতে বলা হইয়াছে - অর্থাৎ “ আর (হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনি তাহাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করিয়া শুনান যখন তাহারা উভয়েই কিছু কুরবানি করিয়াছিল তখন তাহাদের একজনের কুরবানি গৃহীত হইয়াছিল এবং অপর জনের কুরবানি গৃহীত হয় নাই। সে (কাবিল) বলিল আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করিব। সে (হাবিল) বলিল আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেইতো গ্রহণ করেন। (মায়েদা - ২৭)
প্রকাশ থাকে যে , তৎকালীন কুরবানি গৃহীত হইবার একটা সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে , আকাশ হইতে একটি অগ্নি শিখা আসিয়া যাহার কুরবানি কবুল হইবে তাহার কুরবানিকে জ্বালাইয়া ভস্মিভুত করিয়া আবার গোপন হইয়া যাইত আর যাহার কুরবানিকে অগ্নি ভস্মিভূত করিত না তাহারটা প্রত্যাখ্যান মনে করা হইত। অর্থাৎ মনে করা হইতো এই কুরবানি কবুল করা হয় নাই। যেহেতু হাবিল ভেড়া দুম্বা ইত্যাদি পালন করিত সেহেতু সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট স্থানে রাখিয়া আসিল। অপর দিকে কাবিল কৃষি কাজ করিত বিধায় সে কিছু শষ্য ও গম ইত্যাদি কুরবানির জন্য পেশ করিল। নিয়মানুযায়ী আল্লাহ পাকের হুকুমে আকাশ হইতে অগ্নিশিখা অবতরণ করিয়া হাবিলের কুরবানিটি ভস্মিভূত করিয়া দিল এবং কাবিলের কুরবানি যেমন ছিল তেমনি পড়িয়া রহিল। এহেন অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভের সীমা রহিল না। সে আত্মসংবরণ করিতে না পারিয়া প্রকাশ্যে ভাই হাবিলকে বলিয়া দিল কুরআন পাকের ভাষায় অথাৎ আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করিব। ” হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করিয়া একটা মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করিল যা কুরআন পাকে বলা হইয়াছে অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার বিধান এই যে, তিনি খোদাভীরু পরহেজগারের কর্মই গ্রহণ করেন " তুমি খোদাভীতি অবলম্বন করিলে তোমার কুরবানি গৃহিত হইত , তুমি তো তাহা করনাই , তাই তোমার কুরবানি গৃহীত হয় নাই। এতে আমার অপরাধ কি ? (ইবনে কাছীর)। কাবিলের প্রতি হাবিলের বিনয় নম্রতা, সহানুভূতি ও শুভেচ্ছপূর্ণ বাক্য উচ্চারণে কোন সুফল হইল না বরং আমি তোমাকে হত্যা করিবই এইটাই ছিল প্রতিজ্ঞা। যাহার ফলাফল কুরআন পাকে ঘোষিত হইয়াছে। এরশাদ হইতেছে অত:পর কাবিলের অন্তর তাহাকে স্বীয় ভ্রাতা হত্যার জন্য সম্মত করিল আর কাবিল তাহাকে হত্যা করিল ইহাতে সে ক্ষতি গ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেল। ” ভ্রাতা হত্যার দ্বারা কাবিল ইহকাল পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হইল। ইহকালীন ক্ষতি পিতা তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট হইল। অপর দিকে পরকালে অত্যাচার , সীমালংঘন এবং সম্পর্ক ছেদ করার কারণে আযাব পাওয়ার যাগ্যো হইল। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন যে , কেই যদি কাহাকেও অন্যায় ভাবে হত্যা করে তবে তাহার পাপের একাংশ হযরত আদম (আঃ) - এর প্রথম সন্তানের ভাগ্যে আসে। কারণ সেই সর্ব প্রথম না হক হত্যার পথ খুলিয়াছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে অবৈধ রক্তপাত হইতে হিফাজত করুন।
সর্ব প্রথম কুরবানি যেখানে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল : সর্ব প্রথম কুরবানির স্থান তাফসীর ও তারিখের কিতাবাদী দ্বারা প্রমাণীত হয় যে , বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নিকটেই হাবিল কাবিলের সর্ব প্রথম কুরবানি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল।
ইসমাঈল (আ:) এর বিস্ময়কর কুরবানির ঘটনা : পবিত্র কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পরীক্ষা মূলক স্বপ্নে নির্দেশিত হইয়া তাহার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ভাবীকালের নবী হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবানি করিয়া সৃষ্টি জগতে এক বিস্ময়কর ইতিহাস রচনা করিয়াছেন। পবিত্র কুরআন ও উহার বিভিন্ন তাফসীরের কিতাবের আলোকে ঘটনাটি নি¤œরূপ।
এরশাদ হচ্ছে -সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০০
অর্থঃ হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০১
অর্থঃ সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০২
অর্থঃ অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৩
অর্থঃ যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল।
সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৪
অর্থঃ তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম,
সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৫
অর্থঃ তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৬
অর্থঃ নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৭
অর্থঃ আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৮
অর্থঃ আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১০৯
অর্থঃ ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। সূরা আস ছাফ্ফাত আয়াত: ১১০
অর্থঃ এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
আয়াত ১০২-১০৭ এর অনুবাদ একসাথে -
অর্থঃ অতঃপর যখন হযরত ইসমাঈল (আঃ) তাঁর পিতার সাথে চলাফেরার (নয় বৎসর) বয়সে উপণীত হইলেন তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন , প্রিয় পুত্র আমার ! “আমি তোমাকে কুরবানি করিবার জন্য স্বপ্নযাগে আদিষ্ট হইয়াছি। এ বিষয়ে তােমার অভিমত কি ? পুত্র উত্তরে বলিলেন আব্বা ! আপনি যাহা করিতে আদিষ্ট হইয়াছেন শীঘ্র তাহা কাজে পরিণত করুন , ইনশাআল্লাহ , আপনি আমাকে ধৈয্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখিতে পাইবেন। অতঃপর যখন পিতা পুত্র উভয়েই আত্মসমর্পণ করিলেন , আর পিতা পুত্রকে কুরবানি করিবার জন্য উপুৎ করিয়া ধরাশায়ী করিলেন। আমি তখন তাঁহাকে ডাক দিয়া বলিলাম , হে ইব্রাহীম ! সত্যিই আপনি স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করিয়াছেন। আমি এই ভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করিয়া থাকি। বস্তুতঃ ব্যাপারটি একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা মাত্র। আর আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়া দিলাম। (সূরা সাফফ্ত ১০২-১০৭)
এই স্বপ্ন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে উপর্যুপরি তিন বার অর্থাৎ ৮ , ৯ , ও ১০ই জিলহজ্জ তারিখে দেখানো হয়। (কুরতুবী)।
একথা স্বীকৃত সত্য যে পয়গম্বরগণের স্বপ্ন ওহীই বটে। তাই এই স্বপ্নের অর্থ ছিল এই যে , আল্লাহ পাকের পক্ষ হইতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) - এর প্রতি একমাত্র পুত্রকে জবাই করার হুকুম হইয়াছে। এই হুকুমটি সরাসরি কোন ফেরেস্তার মাধ্যমেও নাজিল করা যাইত কিন্তু স্বপ্নে দেখানোর তাৎপর্য হইল হযরত ইব্রাহীম (আঃ) - এর আনুগত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পাওয়া। স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত আদেশে মানব মনের পক্ষে ভিন্ন অর্থ করার যথেষ্ঠ অবকাশ ছিল। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ভিন্ন অর্থের পথ অবলম্বন করার পরিবর্তে আল্লাহ পাকের আদেশের সামনে মাথা নত করিয়া দেন। (তাফসীরে কবির)।
আর সাথে সাথে কুরবানির প্রস্তুতি হিসাবে পুত্রকে সাথে নিয়া সিরিয়া হইতে মক্কা শরীফের ঐ স্থানের দিকে আগমন করেন যেখানে ১৩ বৎসর মতান্তরে ৮ বৎসর পূর্বে মা হাজেরাসহ প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে রাখিয়া গিয়াছিলেন। মক্কা শরীফে পৌছাইয়া হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্ত্রী হাজেরা (আঃ) কে বলিলেন ইসমাঈলকে সাজাইয়া দাও এক স্থানে বেড়াইতে যাইব (মতান্তরে দাওয়াতে যাইব) সাজাইয়া দিলেন মা হাজেরা (আঃ) কলিজার টুকরা ইসমাঈলকে। পিতা চলিতেছেন গন্তব্য স্থানে পচ্চাদানুসরণ করিয়া চলিতেছেন পুত্র ইসমাঈল (আঃ) পথিমধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুত্রকে কুরআন পাকের ভাষায় বলিলেন ইসমাঈল ! আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি যে তোমাকে কুরবানি করিতেছি। অতএব ভাবিয়া দেখ তোমার অভিমত কি ? কিন্তু খলিলুল্লাহরই পুত্র ভাবী পয়গম্বর তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলিলেন পিতা। আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা সম্পন্ন করিয়া ফেলুন এবং সাথে সাথে পিতাকে আরো আশ্বাস দিলেন ইনশাআল্লাহ ! আপনি আমাকে ধৈর্য ধারণ কারীদের মধ্যে পাইবেন। অপর দিকে মুসলমানের আজীবন শক্র ইসলামের চির দুশমন ইবলীস এই দৃশ্য সহ্য করিতে না পারিয়া তাহাদেরকে প্রতারিত করার কাজে লাগিয়া গেল। তাফসীরের বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায় শয়তান প্রথমে হযরত হাজেরা (আঃ) কে প্রতারিত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায়। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর প্রতি ছুটিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) - এর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় শয়তান হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে তিন বার প্রতারণা করার চেষ্টা করিয়াছে। প্রথমে বন্ধুর বেশে জমরায়ে আকাবার নিকট তখন তিনি “ আলাহু আকবার ” ধ্বনী দিয়া সাতটি কংকর নিক্ষেপ করেন মতান্তরে পিতা পুত্র উভয়েই সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। অদ্যবধি এই প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি হিসাবে মীনায় তিনবার কংকর নিক্ষেপের বিধান চালু আছে। যাহা শরীয়তে মোহাম্মদীতে ওয়াজিব। শয়তান সেখান থেকে বিতাড়িত হইয়া জমরায় উসতার নিকট বাধা প্রদান করে। কিন্তু ইব্রাহীম (আঃ) সেখানেও কংকর নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে বিতাড়িত করেন। হতাশ হইল শয়তান অবশেষে তৃতীয় বার জুমরায়ে উলার পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়ায়। সেখানেও “ আল্লাহু আকবার ” বলিয়া সাতটি কংকর নিক্ষেপ করিয়া চির অভিশপ্ত শয়তানকে বিতাড়িত করিলেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে হযরত ইসমাঈল (আঃ) - এর সাথে শয়তানের তর্ক হয় এবং হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে এই মহান কাজ হইতে বিরত রাখার জন্য সর্বশেষ চেষ্টা প্রয়োগ করিয়া বলিল হে ইসমাঈল ! তুমি কি জান ? তোমার পিতা তোমাকে কোথায় নিয়া যাইতেছে। তদুত্তরে তিনি বলিলেন বেড়াইতে যাইতেছি। তখন শয়তান বলিল তুমিতো কিছুই জান না। তোমাকে তোমার পিতা হত্যা করার জন্য নিয়া যাইতেছে। উত্তরে হযরত ইসমাঈল (আঃ) বলিলেন - পিতা কি কখনো পুত্রকে হত্যা করিতে পারে ? ইবলীস বলিল তাহাকে আল্লাহ তায়ালা হুকুম দিয়াছেন। তোমাকে কুরবানি করার জন্য তখন হযরত ইসমাঈল (আঃ) দৃঢ় কণ্ঠে বলিলেন ইহার চাইতে উত্তম জীবন আর কি হইতে পারে ? যে জীবনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কবুল করিয়াছেন। হে শয়তান ! তারে উপর আল্লাহ পাকের অভিসম্পাত অবতীর্ণ হোক তোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এইখানেই মরদুদ নিরাশ হইয়া চলিয়া গেল।
অবশেষে পিতা পুত্র উভয়েই আল্লাহর রহমতে শয়তানের ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করিয়া কুরবানির স্থানে মীনায় পৌঁছাইতে সক্ষম হইলেন। হযরত ইসমাঈল (আঃ) পিতাকে সম্মোধন করিয়া বলিলেন আব্বাজী আর দেরী নয় এখনই বিসমিল্লাহ বলিয়া আমার গলায় ছুরি চালাইয়া দিন। তবে ইহধাম পরিত্যাগ করিবার পূর্ব মুহূর্তে আপনি আমার এই প্রার্থনাগুলি মঞ্জুর করিয়া নিন।
(ক) পিতা আমাকে খুব শক্ত করিয়া বাঁধিয়া নিন। যাহাতে আমি ছটফট করিতে না পারি।
(খ) আপনার পরিধেয় বস্ত্র সামলাইয়া নিন। যাহাতে আমার রক্তের ছিটা তাহাতে না পড়ে।
(গ) আপনার ছুরিটা ধার দিয়া নিন এবং তাহা আমার গলায় দ্রুত চালাইবেন যাহাতে আমার প্রাণ সহজে বাহির হইয়া যায়। কারণ মৃত্যর জালা কঠিন। অন্য বর্ণনা মতে হে পিতা ! আপনি যখন বাড়ী তাশরীফ নিবেন তখন আমার জনম দুঃখিনী মাকে আমার রক্তমাখা জামাটা দিবেন। হয়তো ইহাতে তিনি কিছুটা শান্তনা পাইবেন। একমাত্র পুত্রের মুখে এই সব কথা শুনিয়া পিতার মানসিক অবস্থা কি হইতে পারে তাহা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দৃঢ় তার পাহাড় হইয়া জবাব দিলেন বৎস আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমাকে চমৎকার সহযোগিতা করিয়াছ। অতঃপর তিনি পুত্রকে স্নেহের চুম্বন করিলেন এবং অশ্র পূর্ণ নেত্রে তাহাকে বাধিয়া নিলেন। কুরআন পাকের ভাষায় অতঃপর তাহারা উভয়েই নত হইয়া গেলেন (অর্থাৎ আত্ম সমর্পণ করিলেন) এবং তাহাকে উপুড় করিয়া মাটিতে শোয়াইয়া দিলেন। এই ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত পাওয়া গেলেও ঐতিহাসিক বর্ণনায় এইভাবে শোয়ানোর কারণ বর্ণিত হইয়াছে যে, শুরুতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাহাকে সোজা করিয়া শোয়াইয়া ছিলেন কিন্তু বার বার ছুরি চালানো সত্ত্বেও গলা কাটিতে ছিলনা। কেননা আল্লাহ পাক স্বীয় কুদরতে পিতলের একটি টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করিয়া দিয়া ছিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করিলেন পিতা আমাকে কাত করিয়া শোয়াইয়া দিন। কারণ আমার মুখমণ্ডল দেখিয়া আপনার পৈতৃক স্নেহ উথলিয়া উঠে ফলে গলা সম্পূর্ণ রূপে কাটা হয়না তাহা ছাড়া ছুরি দেখিয়া আমিও ঘাবড়াইয়া যাই। সেই মতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাকে এইভাবে শোয়াইয়া ছুরি চালাইতে থাকেন। (মাযহারী)।
[ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহঃ) মবছুত ও কাজীখান কিতাবদ্বয় থেকে হেদায়ার ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেন , হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আল্লাহ পাকের নির্দেশে বেহেস্ত হইতে একটি দুম্বা নিয়া রওয়ানা হইলেন। তাহার সংশয় হইতেছিল পৃথিবীতে পদার্পন করার পূর্বেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) জবাই কাজ সম্পন্ন করিয়া ফেলিবেন। তাই হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আকাশ হইতেই উচ্চঃস্বরে ধ্বনী দিতে থাকেন “ আল্লাহু আকবার ” হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাহার আওয়াজ শুনিয়া দেখিলেন যে উপস্থিত কুরবানির বস্তু ইসমাঈল (আঃ) - এর পরিবর্তে তিনি একটি দুম্বা নিয়া আসিতেছেন। তাই তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে বলিয়া উঠিলেন “ লা - ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ”। পিতার মুখে তাওহীদের অমূল্য বাণী শুনিতে পাইয়া তিনিও বলিয়া উঠিলেন। “ আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার - ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ” তাই এই তিন মহান ব্যক্তির আমল ও কালাম গুলো দরবারে এলাহীতে এত বেশী কবুল হইল যে , কিয়ামত পর্যন্ত উক্ত বাণীগুলো ঈদুল আযহায় সমস্ত মুসলিমের কণ্ঠে উচ্চারিত হইতে থাকিবে। আল্লাহ পাকের অসীম কুদরাতে হযরত ইসমাঈল (আঃ) - এর পরিবর্তে কুরবানি হইল একটি বেহেস্তী দুম্বা। এই ভাবেই প্রচারিত হল কুরবানির মহান বিস্ময়কর ইতিহাস। যাহা অনন্তকাল সুন্নাতে ইব্রাহীম হিসাবে বিশ্ব মানবতার কাছে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর অনুসরণে আমাদের কুরবানি : যদিও কুরবানির প্রচলন আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) - এর যুগ হইতে তবে আমরা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) - এর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) - এর স্মরণে কুরবানি করিয়া থাকি। সে প্রসঙ্গে হাদীস পাকে আসিয়াছে অর্থ্যাৎ হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হইতে বর্ণিত কতিপয় সাহাবী প্রশ্ন করিলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কুরবানি কি ? তদুত্তরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন ইহা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) - এর সুন্নাত। যদিও পরে সতন্ত্র ভাবে আমাদের উপর কুরবানির নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। তবুও সেই নির্দেশ সুন্নাতে ইব্রাহীম (আঃ) - এর অনুসরণে দেওয়া হইয়াছে। তাই আমরা শরীয়তে। মোহাম্মাদীর এই নির্দেশ সুন্নাতে ইব্রাহীম (আঃ) - এর স্মরণে পালন করিয়া থাকি।
(গ) ছাগল, এর মধ্যে দুম্বা ভেড়া নর-মাদী খাশী সবই অন্তরভুক্ত। উল্লিখিত জানোয়ার। ব্যতীত অন্য কোন জানােয়ার দ্বারা কুরবানি জায়েয নাই। যেমন হরিণ, নীলগাই বন্য পশু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নাই। (বাদায়ে ৫ / ৬৯ পৃঃ হিন্দিয়া ৪ / ১০৩পৃঃ)।
(বিঃ দ্রঃ কুরবানির পশু জবাই করার কিছুদিন পূর্বেই ক্রয় করিয়া উহা যত্ন করা এবং খাওয়াইয়া মােটাতাজা করা ভাল)।
প্রশ্ন : কোন শ্রেণীর পশুর বয়স কত হইলে কুরবানি জায়েয হইবে।
উত্তর : গরু, মহিষ, বলদ-গাভীর জন্য দুই বৎসর পূর্ণ হওয়া জরুরী। উট ও উটনীর পাঁচ বৎসর পূর্ণ হওয়া শর্ত। একদিন কম হইলে কুরবানি জায়েয হইবেনা। (রদ্দুল মুখতার ৫/২০৫পৃঃ)
অপরদিকে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা,নর-মাদীর জন্য এক বৎসর পূর্ণ হওয়া শর্ত।
তবে যদি ছয়মাস বয়সের ভেড়া ও দুম্বা মোটা তাজায় এক বৎসর বয়সের ভেড়া ও দুম্বার সমতুল্য মনে হয় তাহা হইলে উহা দ্বারা কুরবানি জায়েয আছে। কিন্তু ছাগল যতই মোটা তাজা হােক এক বৎসরের একদিন কম হইলেও কুরবানি হইবেনা। (জাইয়ালী ৬/৭পৃ:রদ্দুল মোখতার ৫/২০১পৃ:)
প্রশ্ন : কুরবানির ক্ষেত্রে একটি পশুতে কয়জন অংশীদ হইয়া কুরবানি করিতে পারিবে।।
উওরঃ ছাগল , ভেড়া ও দুম্বাতে এক ব্যক্তির অধিক শরীক হইয়া কুরবানি করা জায়েয নাই। অপর দিকে গরু মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে একের অধিক সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হইয়া কুরবানি করিতে পারিবে।। একজন সাত ভাগের একাধিক ভাগে শরীক হইতে পারিবে। কিন্তু সাত ভাগের এক অংশের কম হইলে কাহারও কুরবানি হইবে না। তবে গাস্তে ওজন করিয়া সমান ভাবে ভাগ করিয়া লইতে হইবে কোনরূপ অনুমান করিয়া লইলে হইবেনা। তাহার পরেও কম বেশীর জন্য একে অপর হইতে ক্ষমা চাহিয়া দাবী ছাড়াইয়া নেওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : একই কুরবানির পশু দ্বারা ওয়াজিব , নফল , মান্নত , অছিয়তের কুরবানি ও আকীকা দেওয়া জায়েয হইবে কি না ?
উত্তর : একই পশু দ্বারা ওয়াজিব , নফল , অছিয়ত বিভিন্ন প্রকারের কুরবানি দেওয়া জায়েয হইবে। যেমন , একটি গাভী কুরবানি করিতে গিয়া একজন ধনী হিসাবে ওয়াজিব আদায়ের নিয়ত করিল , আরেকজন আকীকা আদায়ের নিয়ত করিল , আরেক জন মান্নত কুরবানি আদায়ের নিয়ত করিল , আরেক জন অছিয়ত কৃত কুরবানির নিয়ত করিল , আরেকজন নফল কুরবানির নিয়ত
করিল , আরেকজন দমে এহছার বা দামে তামাত্তোর নিয়ত করিল ইত্যাদি তাহা হইলে সকলের কুরবানি শুদ্ধ হইয়া যাইবে। কেননা সকলেরই উদ্দেশ্য হইল আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করা।
প্রশ্ন : কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সমূহ।
উত্তর : শর্ত পাওয়া গেলেই আমাদের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। যেমন :-
(ক) কুরবানির দিন মালেকে নেছাব হওয়া। কাজেই গরীবের উপর কুরবানি ওয়াজিব নহে
(খ) সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি হওয়া। কাজেই বিকৃত মস্তিস্ক তথা পাগলের উপর কুরবানি ওয়াজিব নহে।
(গ) স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া। কাজেই দাস - দাসীর উপর কুরবানি ওয়াজিব নহে।
(ঘ) মুসলমান হওয়া। কাজেই অমুসলিমের উপরে কুরবানি ওয়াজিব নহে।
(ঙ) বালেগ হওয়া। কাজীখানের মতে নাবালেগের প্রতি কুরবানি ওয়াজিব নহে।
(চ) মুকিম হওয়া অর্থাৎ নিজ বাড়ীতে অবস্থান করা। কাজেই মুসাফিরের উপর কুরবানি ওয়াজিব নহে।
প্রশ্ন : প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য মালেকে নেছাব হওয়া শর্ত। কিন্তু মালেকে নেছাব কখন হয় ?
উত্তর : মালেকে নেছাব হইল কেহ স্থায়ী হাজতে আছলীয়া (অর্থাৎ খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান ও উপার্জনের উপকরণ ইত্যাদি) বাদ দিয়া যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য কিংবা উহার মূল্য বা সমমূল্যের অন্য কোন মালের মালিক হয়। অন্য কথায় প্রয়োজনীয় মাল-আসবাব ব্যতীত বর্তমান বাংলাদেশী টাকায় দশ হাজার পাঁচশত টাকা (সংযুক্ত : ঐ সময়ের হিসেবে ১০৫০০/টাকা। বর্তমান হিসেব করিয়া নিবেন)
বা সেই পরিমাণ মাল থাকিলে তাহার উপর কুরবানি ওয়াজিব হইবে। (হেদায়া-৪/ ৪৪৪ পৃঃ, শামী ৫/ ১৯৮পৃঃ)
প্রশ্ন : নেছাব পরিমাণ অর্থ মালিকের কাছে কতদিন থাকিলে তাহার উপর কুরবানি ওয়াজিব হইবে।
উত্তর : কুরবানির নেছাব যাকাতের নেছাবের মত নয় বরং সদকায়ে ফিতর নেছাবের সাথে সম্পর্ক রাখে। অর্থাৎ যাকাতের নেছাব পরিমাণ মাল যেমন মালিকের কাছে এক বৎসর থাকা শর্ত কিন্তু কুরবানির নেছাব পরিমাণ মাল মালিকের কাছ এক বৎসর থাকা শর্ত নয় বরং উক্ত নেছাব পরিমাণ মালের জিলহজ্জ মাসের ১০ ১১ ও ১২ এই তিন দিনের যেই কোন দিন মালিক হইলে তাহার উপর কুরবানি ওয়াজিব হইবে। থ (শামী ১৯৮পৃঃ)
প্রশ্ন : কাহারও কাছে স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয়টাই আছে কিন্তু কোনটাই নেছাব পরিমাণ নহে তবে যদি দুইটা মিলাইয়া নেছাব পরিমাণ হয় তাহার হুকুম কি।
উত্তর : স্বর্ণ ও রৌপ্য মিলাইয়া অথবা উহার মূল্য হিসাব করিয়া যদি রৌপ্যের নেছাব পরিমাণ হয় তাহা হইলে যাকাত কুরবানি ও সদকায় ফিতর সবই ওয়াজিব। (শামী)
প্রশ্ন : যাহার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব সে যদি কুরবানি না করিয়া উহার মূল্য কুরবানির দিনগুলোর মধ্যে সদকা করিয়া দেয় তবে কি কুরবানির ওয়াজিব আদায় হইবে ?
উত্তর : এমতাবস্থায় তাহার কুরবানির ওয়াজিব আদায় হইবে না। তাহাকে অবশ্যই বিধি মোতাবেক কুরবানি করিতে হইবে। (বাহার)
প্রশ্ন : আইয়্যামে তাশরীকের দিনগুলোতে কুরবানি দাতার করণীয় কিছু আছে কি না ?
উত্তর : আইয়্যামে তাশরীক যদিও কুরবানিকে কেন্দ্র করিয়া উপস্থিত হয় তবুও উহাতে সতন্ত্র বিধান আছে। আর তাহা হইল ৯ই জিলহজ্জের ফজর হইতে ১৩ই জিলহজ্জ আছর পর্যন্ত প্রতিটা মুকীম বালেগ পুরুষের জন্য ফরজ নামায বাদ তাকবীর বলা ওয়াজিব। এটা শুধু কুরবানি দাতার করণীয় নয় বরং সকল মুসলমানের দায়িত্ব। মুসলিম শরীফ ও মিশকাতের ১২৭ পৃষ্ঠায় হযরত উম্মে সালমা হইতে একখানা হাদীসে বলা হইয়াছে যে, কুরবানি দাতা কুরবানি না করা পর্যন্ত যেন নখ, চুল ও অন্যান্য ক্ষৌরকাজ না করে। সেই হিসাবে জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন কুরবানি দাতার জন্য উক্ত কাজ গুলো না করা মুস্তাহাব।
প্রশ্ন : মৃত্যু ব্যক্তির নামে কুরবানি করিলে জায়েয হইবে কি না বা ওয়াজিব আদায় হইবে কি না?
উত্তর : যদি কোন ব্যক্তি আম্বিয়া (আঃ), আউলিয়া, পীর, ওস্তাদ, মাতা পিতা বা যে কোন মৃত ব্যক্তির পক্ষ হইতে কুরবানি করে তাহা হইলে এই কুরবানি শুদ্ধ হইবে। কুরবানি দাতা ধনী হইলে উল্লিখিত ক্ষেত্রে তাহার কুরবানির ওয়াজিব আদায় হইয়া যাইবে। (শামী ২/২৮ পৃঃ কাজী খান ৩/৪৮ পৃঃ)
উল্লেখ্য যে , গরিব দুই ভাই বা কয়েক ভাই যদি মিলিয়া একটি বকরী ক্রয় করে অতঃপর তাহারা কোন এক ভাইকে ঐ বকরীর মালিক বানাইয়া দেয় এবং মালিক মৃত পিতা বা মাতা বা অন্য কোন মৃত আত্মীয়ের পক্ষে ঐ কুরবানি করে তাহা হইলে মালিক ও মৃত উভয়ই কুরবানির ছওয়াব পাইবে এবং অন্যান্য ভাই সাধারণ সদকার ছওয়াব পাইবে আর গোস্ত সকলেই খাইতে পারিবে।
প্রশ্ন : কোন কোন জন্তু দ্বারা কুরবানি করা জায়েয।
উত্তর : কুরবানির জন্য তিন প্রকার জন্তু নির্দিষ্ট আছে। ঐ তিন প্রকার ব্যতিত অন্য জানোয়ার দ্বারা কুরবানি জায়েয হইবে না। যথা :
(ক) উট, উটনীও উহার মধ্যে শামিল।
(খ) গরু , এর মধ্যে মহিষ নর-মাদী সব শামেল।
(গ) ছাগল, এর মধ্যে দুম্বা ভেড়া নর-মাদী খাশী সবই অন্তর্ভুক্ত। উল্লিখিত জানোয়ার। ব্যতীত অন্য কোন জানোয়ার দ্বারা কুরবানি জায়েয নাই। যেমন হরিণ, নীলগাই বন্য পশু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নাই। (বাদায়ে ৫/৬৯ পৃঃ হিন্দিয়া ৪/১০৩পৃঃ)।
(বিঃদ্রঃ কুরবানির পশু জবাই করার কিছুদিন পূর্বেই ক্রয় করিয়া উহা যত্ন করা এবং খাওয়াইয়া মোটাতাজা করা ভাল)।
প্রশ্ন : কোন শ্রেণীর পশুর বয়স কত হইলে কুরবানি জায়েয হইবে।
উত্তর : গরু, মহিষ, বলদ-গাভীর জন্য দুই বৎসর পূর্ণ হওয়া জরুরি। উট ও উটনীর পাঁচ বৎসর পূর্ণ হওয়া শর্ত। একদিন কম হইলে কুরবানি জায়েয হইবে না। (রদ্দুল মুখতার ৫ / ২০৫পৃঃ)
অপরদিকে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা,নর-মাদীর জন্য এক বৎসর পূর্ণ হওয়া শর্ত।
তবে যদি ছয়মাস বয়সের ভেড়া ও দুম্বা মােটা তাজায় এক বৎসর বয়সের ভেড়া ও দুম্বার সমতুল্য মনে হয় তাহা হইলে উহা দ্বারা কুরবানি জায়েয আছে।কিন্তু ছাগল যতই মোটা তাজা হোক এক বৎসরের একদিন কম হইলেও কুরবানি হইবে না। (জাইয়ালী ৬/৭পৃ: রদ্দুল মোখতার ৫/২০১ পৃ:)
প্রশ্ন : কুরবানির ক্ষেত্রে একটি পশুতে কয়জন অংশীদ হইয়া কুরবানি করিতে পারিবে।
উত্তর : ছাগল, ভেড়া ও দুম্বাতে এক ব্যক্তির অধিক শরীক হইয়া কুরবানি করা জায়েয নাই। অপর দিকে গরু মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে একের অধিক সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হইয়া কুরবানি করিতে পারিবে।। একজন সাত ভাগের একাধিক ভাগে শরীক হইতে পারিবে। কিন্তু সাত ভাগের এক অংশের কম হইলে কাহারও কুরবানি হইবে না। তবে গোস্ত ওজন করিয়া সমান ভাবে ভাগ করিয়া লইতে হইবে কোনরূপ অনুমান করিয়া লইলে হইবে না। তাহার পরেও কম বেশীর জন্য একে অপর হইতে ক্ষমা চাহিয়া দাবী ছাড়াইয়া নেওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : একই কুরবানির পশু দ্বারা ওয়াজিব, নফল, মান্নত, অছিয়তের কুরবানি ও আকীকা দেওয়া জায়েয হইবে কি না ?
উত্তর : একই পশু দ্বারা ওয়াজিব, নফল, অছিয়ত বিভিন্ন প্রকারের কুরবানি দেওয়া জায়েয হইবে। যেমন : একটি গাভী কুরবানি করিতে গিয়া একজন ধনী হিসাবে ওয়াজিব আদায়ের নিয়ত করিল, আরেকজন আকীকা আদায়ের নিয়ত করিল, আরেক জন মান্নত কুরবানি আদায়ের নিয়ত করিল, আরেক জন অছিয়তকৃত কুরবানির নিয়ত করিল, আরেকজন নফল কুরবানির নিয়ত করিল, আরেকজন দমে এহছার বা দামে তামাত্তোর নিয়ত করিল ইত্যাদি তাহা হইলে সকলের কুরবানি শুদ্ধ হইয়া যাইবে। কেননা সকলেরই উদ্দেশ্য হইল আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করা।
তথ্য : তরিকুল ইসলাম।
লেখক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।