প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মাঠে মাঠে সোনালী ফসল জলাবদ্ধতার শিকার
জলাবদ্ধতা নিরসনের টেকসই সমাধান দেবে কে?
চাঁদপুরে মুষলধারে বৃষ্টিতে অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ফসলি জমিতেও স্থান ভেদে জমে যায় হাঁটু পানি। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে এবং ঝড় হলে এলাকায় মৌসুমি ফল চাষীরা ও ধান চাষীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে দেখা যায়। সে কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, ফসলি জমি ভরাট হয়ে যাওয়া, পানির আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া এবং খাল খনন না করায় বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চলছেন কৃষকরা।
মাঠে মাঠে সোনালী ফসল দোল খাচ্ছে । এমতাবস্থায় মুষলধারে বৃষ্টি হলে তো আর কথা নেই। নির্ঘাৎ জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে ফসলি জমি ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়াটাই এর কারণ। কৃষকের প্রশ্ন, জলাবদ্ধতা নিরসনের টেকসই সমাধান দেবে কে?
চাঁদপুর সদর উপজেলার তরপুরচণ্ডী ইউনিয়নের কৃষক বিল্লাল গাজী জানান, এখন বর্ষা মৌসুম। প্রতি বছরই শুনি জলাবদ্ধতা দূর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বছরের পর বছর যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আর এই উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে কৃষকদের।
বৃষ্টি হলেই সেচ প্রকল্পের আওতাভুক্ত বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেয়। মতলব উত্তরে মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বাগানবাড়ি ইউনিয়নের কৃষক আফজাল জানান, জলাবদ্ধতা কয়েকদিন যাবৎ স্থায়ী হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ পানি সরানোর দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ না করায় ফসলহানি ঘটার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বহুবার। এভাবে প্রতিবছরই জলাবদ্ধতায় কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়। ওই এলাকার কৃষকরা জানান, টেকসইভাবে এ সমস্যা সমাধান তথা জলাবদ্ধতা নিরসন জরুরি। তা না হলে মূলধন হারিয়ে কৃষকরা পথে বসবে।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প এলাকার মাঝখান উঁচু থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনায় প্রকল্প বাস্তবায়ন তথা গোড়ায় গলদ, খালগুলো আবর্জনা ও কচুরিপানা দিয়ে আবদ্ধ থাকা এবং পাম্প দ্বারা দ্রুত বৃষ্টির পানি প্রকল্পের বাইরে না সরানোর ফলে ভয়াবহ এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ ও সচেতন মহল মনে করেন।
এদিকে এ জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে যে সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়েছে, সে সংগঠনের সদস্যরা জোর দাবি জানালেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। তাই তারা বারবার গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হন, সরকারকে জানান দিতে চান কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষক বাঁচানোর জন্যে তাই জলাবদ্ধতার টেকসই সমাধানের বিকল্প নেই।
এডভেঞ্জার বয়েজের সভাপতি জিএম জাহিদ হাসান জানান, চাঁদপুর পৌরসভার বিষ্ণুদী এলাকার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যাবতী খাল বহু বছর যাবৎ কোনো ধরনের সংস্কার না করায় ময়লা আবর্জনায় খালটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ময়লা আবর্জনার কারণে পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা মশা-মাছি ও দুর্গন্ধে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এবং নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদপুর মৎস্য বিভাগ থেকে গত ৪০ বছর পূর্বে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার জন্যে এই খালটি খনন করা হয়। এরপর থেকে এই খালটি ব্যবহার হয়ে আসলেও কোনো ধরনের সংস্কার কাজ করা হয়নি।
জি এম রাকিব হোসাইন জানান, খালটি চাঁদপুর পৌরসভার ৯ , ১৪ ও ১৫নং ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। শহর এলাকা বর্ধিত হওয়ার কারণে এই খালের দুপাশে বসতিও বেড়েছে। পৌরসভা কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের তদারকি না থাকায় বর্তমানে খালটির বিভিন্ন স্থান ভরাট করে চলছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোকজন। যার কারণে এই খালটি স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে এবং সরু হয়ে গেছে। নতুন করে এই খালের দুই পাশে বসতবাড়ি হওয়ার কারণে পৌরসভা থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্যে যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেই ড্রেনের পানি ও ময়লাগুলো অধিকাংশ এই খালে গিয়ে পড়ছে। এতে করে এই খালটির গুরুত্ব এখন আরো বেড়েছে।
বিষ্ণুদী এলাকার বাসিন্দা, পেশায় শ্রমিক মো. আবু সায়েদ জানান, এই খালটি বহু বছরের পুরনো। আমরা এই খালে অনেক মানুষকে মাছ ধরা, পারিবারিকভাবে বিভিন্ন কাজে পানির ব্যবহার, ফসলি জমিতে সেচের জন্যে পানির ব্যবহার দেখেছি। কিন্তু বেশ ক'বছর যাবৎ এই খালটি ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখন আর এই খালে পানি প্রবাহিত হয় না।
এলাকাবাসী আরো জানায়, খালটিতে বর্তমানে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা বিরাজ করায় পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা দুর্গন্ধে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পৌর কর্তৃপক্ষ খালটির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ করবে বলে এলাকাবাসী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
মতলব উত্তর উপজেলার ধানদিয়া গ্রামের কৃষক ওবায়দুর রহমান বলেন, মাঠে তিন বিঘা জমিতে ধান লাগানো হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি হলে জমিতে পানি জমে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এখন থেকেই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা সচল করা দরকার। তা না হলে আমাদের স্বপ্ন পানিতে ভেসে যাবে।
খোঁজ নিয়ে ও সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁদপুর সদর উপজেলার একাংশ ধরে হাজীগঞ্জের শ্রীপুর-রাজারগাঁও দিয়ে উত্তর-পূর্ব হয়ে কচুয়ার দিকে চলে গেছে জমজমিয়া খাল। দক্ষিণে ডাকাতিয়া নদী থেকে শুরু হয়ে হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার বলাখাল পূর্ব বাজার হয়ে বলাখাল রেলসড়কের পাশ দিয়ে উত্তরে চলে গেছে কুচির বিল খাল। হাজীগঞ্জ পূর্ব বাজারস্থ ডাকাতিয়ার সম্মুখ থেকে শুরু হয়ে বোয়ালজুরি খালটি চৌধুরী পাড়া এলাকার রেলপথ পার হয়ে সুহিলপুর বাজার ও ধড্ডা দিয়ে উত্তরে রঘুনাথপুর হয়ে কচুয়ায় চলে গেছে। দক্ষিণে ডাকাতিয়া থেকে শুরু করে হাজীগঞ্জ পৌরসভার আলীগঞ্জ হয়ে রেলপথ পার হয়ে হাটিলা ধরে কচুয়ার দিকে চলে গেছে শৈলখালী খাল। আর চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে সদর উপজেলার সীমানা জুড়ে রয়েছে সড়ক বিভাগের খাল। এছাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের সকল ইউনিয়নের উপর দিয়ে ছোট-বড়ো কমপক্ষে ২০ থেকে ২২টি খাল চলে গেছে। এর মধ্যে আবার পৌরসভার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু খাল।
সরজমিনে দেখা যায়, উপরোল্লিখিত বড়ো বড়ো খালের অংশবিশেষ বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজার এলাকার দখলে চলে গেছে। সড়ক বিভাগের খালের অধিকাংশ ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে মাছ চাষ, বাড়ির রাস্তা তৈরি ও দোকানপাট তুলতে দখলে করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এ নিয়ে সড়ক বিভাগকে টু শব্দটুকু করতে দেখা যায়নি।
হাজীগঞ্জ উপজেলার ছোট ছোট খালগুলোর মধ্যে রাজারগাঁও বাজারের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া খালের বেশ খানিকটা অংশ ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে একটি মহল। ৫নং সদর ইউনিয়নের সড়ক বিভাগের খাল থেকে শুরু করে কৈয়ারপুল বাজার এলাকা ধরে দক্ষিণে ডাকাতিয়ায় গিয়ে মিশেছে খালটি। কৈয়ারপুল বাজার এলাকায় এই খালের ওপর শতাধিক টং দোকান তুলে খাল দখলে রেখেছে স্থানীয়রা। যদিও টং দোকানিরা কোনো না কোনোভাবে ভাড়াটিয়া বা মালিকানা দাবি করে আসছেন। কৈয়ারপুল এলাকার পূর্বে সড়ক বিভাগের আমির বাড়ি ব্রিজের নিচ দিয়ে দক্ষিণে শ্রীনারায়ণপুর হয়ে ডাকাতিয়ায় গিয়ে পড়েছে শ্রীনারায়ণপুর খালটি। এই খালের একেবারে মধ্যখানে পাকা দোকান আর রাস্তা করে খালটি বন্ধ করে রেখেছে শ্রীনারায়ণপুর এলাকার চিহ্নিত কিছু লোক। বলাখাল পশ্চিম বাজারস্থ বলাখাল চন্দ্রবান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে সড়ক বিভাগের ব্রিজ ধরে খাস খতিয়ানের একটি খাল চলে গেছে দক্ষিণ আর পশ্চিমে। এ খালটি ইতোমধ্যে বেশ কয়েক ব্যক্তি দখলে নিয়ে খালের ওপর পাকা স্থাপনা তুলে রেখেছে। বলাখাল বাজারের পূর্ব দিকে সড়ক বিভাগের ব্রিজ ধরে বাজারের উত্তর অংশ হয়ে রামপুর সড়কের পাশ দিয়ে চলে গেছে কুচিরবিল খাল। এই খালের বলাখাল বাজারস্থ সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে বলাখাল রেল স্টেশন পর্যন্ত অধিকাংশ অংশে খালের ওপর টং তুলে ভাড়া দিয়ে সুবিধা ভোগ করছে স্থানীয়রা। হাজীগঞ্জ বাজারের পশ্চিম দিকে মিঠানিয়া খালটি দক্ষিণে ডাকাতিয়া নদী থেকে শুরু হয়ে সড়ক বিভাগের মিঠানিয়া সেতু হয়ে রেলপথ পাড়ি দিয়ে হাজীগঞ্জের উত্তরে বিস্তীর্ণ এলাকা অতিক্রম করেছে। খালটির হাজীগঞ্জ বাজার এলাকার অংশসহ উত্তরে সুদিয়া গ্রামসহ তৎসংলগ্ন এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ দখলে নিয়েছে স্থানীয়রা। হাজীগঞ্জের আলীগঞ্জ এলাকার শৈলখালী খালটি বালু ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অস্তিত্ব হারিয়ে মৃতপ্রায়।
হাজীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে মৈশামুড়া বাজার এলাকা, বটতলা এলাকা, মালিগাঁও বাজার এলাকা, কাঁকৈরতলা কলেজ এলাকা, মোহাম্মদপুর বাজার এলাকা, হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়কের হাজীগঞ্জ অংশের বেলচোঁ বাজার এলাকা ও সেন্দ্রা বাজার এলাকা দিয়ে চলে যাওয়া প্রতিটি খালের ওপর টং ঘর তুলে কেউ ভাড়া আদায় করছে, কেউবা আবার নিজেরা দখলে নিয়ে রেখেছে। অথচ প্রতিটি খাল অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ইরিগেশন আর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে।
বলাখাল এলাকার কৃষকরা জানান, বলাখাল বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল দখল আর পানি নিষ্কাশনের সমস্যার কারণে কিছুদিন আগে স্থানীয়রা পৌরসভার মেয়রের কাছে অভিযোগ দিয়েছে ।
জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মোঃ মোবারক হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এবারে চাঁদপুরে বোরো চাষ হয়েছে ৬১ হাজার ২শ' ৮৫ হেক্টর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হবে ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ১শ' ৪০ মে. টন। তিনি আরো বলেন, তবে ফসলি জমি যে হারে ভরাট করা হচ্ছে এবং খালগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে কিন্তু কৃষকের জন্যে বড়ো ধরনের ঝুঁকি থেকে যায়। বৃষ্টি হলেই সাথে সাথে পানি নিষ্কাশন হলে কৃষকদের বড়ো ক্ষতি হবে না । তবে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের খালগুলো উদ্ধার করা এবং খননের ব্যবস্থা করে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।
জলাবদ্ধতা নিরসনের টেকসই সমাধান নিয়ে কথা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সাথে। তিনি জানান, জলাবদ্ধতা নিরসন এবং জমি ভরাট নিয়ে জেলার উন্নয়ন সভায় আলোচনা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় খাল খনন কাজ নিয়ে সার্ভে করা হয়েছে। চাঁদপুর জেলায় ৪৬টি খাল খননের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল খাল সংস্কার করা হবে। যেখানেই জলাবদ্ধতা অথবা খাল ভরাটের অভিযোগ পাওয়া যাবে, সেখানেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।