প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ধান-গম আবাদ ছেড়ে উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় ভুট্টায় ঝুঁকছেন কৃষকরা
ধান ও গম চাষে খরচ বেশি। এসব বিক্রি করে বেশি লাভও হয় না। অথচ ভুট্টায় উৎপাদন খরচ কম ও লাভ বেশি হয়।
চাঁদপুরে এবার গমের আবাদ কমে গেছে। বোরো ধানের আবাদের প্রতিও আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। বেশি লাভ ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তারা ভুট্টা চাষে ঝুঁকেছেন।
কৃষকরা বলেন, গত বছর গম চাষ করে প্রতি বিঘায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ এবং এবার আমন ধানে প্রতি বিঘায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা লোকসান হয়েছে। এই কারণে চলতি মৌসুমে গম ও বোরো ধান আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেক কৃষক। গত মৌসুমের তুলনায় হাজীগঞ্জ উপজেলায় এবার ৪০ হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়েছে। বোরো ধানের আবাদও কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, গম চাষের জন্যে প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার প্রয়োজন হয়। গমগাছ বৃদ্ধির জন্যে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তীব্র শীত থাকা দরকার, যা দুই-তিন বছর থেকে অনুপস্থিত। ২০১৯-২০ মৌসুমে প্রতি একরে ১ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন, এর আগের মৌসুমে (২০২১-২২) ১ দশমিক ৪৪ মেট্রিক টন এবং ২০২৩-২৪ মৌসুমে ১ দশমিক ৪৯ মেট্রিক টন গম হয়েছিল। গত দুই মৌসুমে এখানে তুলনামূলক শীত ও কুয়াশা কম ছিলো। এজন্যে গত দুই মৌসুমে জেলায় গমের ফলন কম হয়েছে। এতে চাষিরা গমের আবাদ কমিয়ে দিয়েছেন।
জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুর সদর উপজেলায় আবাদি জমি ২৯ হাজার ৬১ হেক্টর। এর মধ্যে এবার ৪ হাজার ২০০ হেক্টরে ভুট্টা এবং ১৩ হাজার ১৬৮ হেক্টরে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর এই উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা এবং ১২ হাজার ৮০০ হেক্টরে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল। এবার গত রোববার পর্যন্ত উপজেলায় ৪ হাজার ১৫৫ হেক্টরে ভুট্টার আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের আবাদের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। এ সময়ের মধ্যে আরও কয়েকশ’ হেক্টরে ভুট্টার আবাদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলায় এবার ২ হাজার ১৫০ হেক্টরে সরিষার চাষ হয়েছে। চাষিরা সাধারণত সরিষার পরে জমিতে বোরো ধান আবাদ করতেন। কিন্তু এবারের আমন ও গতবার বোরো ধানে উপর্যুপরি লোকসান হওয়ায় কৃষকেরা এবার সরিষা তুলে ধানের বদলে ভুট্টার আবাদ করছেন।
ভুট্টা আবাদের কারণ সম্পর্কে ফরিদগঞ্জ শোভান গ্রামের ইউসুফ আলী বলেন, ‘গতবার সরিষা কেটে বোরো চাষ করে লস খেয়েছি। সরিষার জমিটা উঁচু হওয়ায় বোরোর জন্যে সেচ দিতে বেশি টাকা খরচ হয়। আর ওই জমিতে ভুট্টা চাষ করলে বেশি সেচের দরকার হয় না। ভুট্টায় খরচও কম। তাই এবার আমি ভুট্টা চাষ করেছি। ভুট্টা আবাদ করে ফলন বেশি হয় এবং বিক্রি করে লাভও পাওয়া যায় বেশি। এ ফসলে লোকসানের ঝুঁকি কম।’
হাজীগঞ্জের মেনাপুর গ্রামের সিরাজ পাটোয়ারী, রাজারগাঁও গ্রামের আলী, নাসির কোট গ্রামের চপলসহ একাধিক কৃষক সরিষা তুলে ভুট্টা আবাদ করেছেন।
শাহতলী গ্রামের নেছারউদ্দীন জানান, গত মৌসুমে তিনি গম চাষ করে প্রতি বিঘায় ১৬ মণ ফলন পেয়েছিলেন। ৬০০-৬২০ টাকা মণ দরে গম বেচে তার লাভ হয়নি, বরং বিঘাপ্রতি লোকসান হয়েছে প্রায় এক হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, গমের জমি তৈরি, সার, জৈব সার, ভিটামিন, গম কাটা, আঁটি বাঁধা, বহন, পালা করা, মাড়াইসহ সব মিলিয়ে ১১ হাজার থেকে ১১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ পড়েছে। অথচ ১৬ মণ গম বেচে পাওয়া গেছে ১০ হাজার ৮০ টাকা।
কচুয়ার নন্দনপুর গ্রামের ওছমান, সাচার গ্রামের ওমর আলী ও সুরেশ চন্দ্র রায় জানান, এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করতে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘাপ্রতি ফলন পাওয়া যায় ৫০-৬০ মণ। প্রতি মণ ভেজা ভুট্টা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে বিঘাপ্রতি ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা লাভ হয়।
মতলব দক্ষিণের নায়েরগাঁও গ্রামের বশির ও গোলাম রসুল জানান, বোরো ধান আবাদে বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা। অথচ বিঘাপ্রতি বোরো ধানের ফলন পাওয়া যায় ২৫-৩০ মণ। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সময় প্রতি মণ ভেজা ধানের দাম পাওয়া গেছে ৪০০-৪৫০ টাকা।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মোবারক হোসেন বলেন, গত মৌসুমে গমে এবং এবারের আমনে লোকসান হওয়ায় বেশির ভাগ চাষি এবার গম ও বোরো আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে ভুট্টার আবাদের দিকে ঝুঁকেছেন।