শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

দেশি ফল চাষের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
সাদিয়া সাইয়ারা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মানুষের পুষ্টি ও সুষম খাবারের জন্যে ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ফলের উৎপাদন হয় কৃষির মাধ্যমে। সুতরাং একটি সুস্থ জাতি বিনির্মাণে ফল চাষ সম্প্রসারণ তথা ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। ফল ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ বিধায় একে রোগ প্রতিরোধী খাদ্যও বলা হয়। ফলের উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত শ্রমঘন কাজ বিধায় এগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এভাবে দেশি ফল পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

নানা ধরনের দেশি ফল ও গুণাগুণ :

আমাদের নিজ দেশে যেসব ফল উৎপাদন করা হয়, সেই ফলগুলোকেই আমরা দেশি ফল বলে থাকি। এসব দেশি ফল পুষ্টিগুণ বা ঔষধি গুণেও পরিপূর্ণ।

দেশি ফল চাষের অবদান :

যেহেতু দেশি ফল হতে আমরা নানা ধরনের পুষ্টিমূল্য পেয়ে থাকি। তাই এর চাষ আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

অধিক আয় :

অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্য অপেক্ষা দেশি ফলের গড় ফলন অনেক বেশি। সে হারে ফলের মূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আয়ও অনেক বেশি। যেমন এক হেক্টর জমিতে ধান গম চাষে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ সমপরিমাণ জমিতে কলা ও আম চাষ করে যথাক্রমে আয় হয় ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা।

জাতীয় অর্থনীতিতে :

বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে আনুমানিক প্রায় ১০ শতাংশ আসে ফল থেকে। এ থেকে বোঝা যায়, জাতীয় অর্থনীতিতে তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ফল ও ফলদ বৃক্ষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দেশি ফল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিমুখী সম্ভাবনা :

বিশ্বের ফল বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবদান খুবই কম। বিদেশে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সীমিত আকারে টাটকা ফল রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত উল্লেখযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে কাঁঠাল, আম, আনারস, লেবু, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, তেঁতুল, চালতা উল্লেখযোগ্য। টাটকা ফল ছাড়াও হিমায়িত ফল (সাতকরা, কাঁঠাল বীজ, কাঁচকলা, লেবু, জলপাই, আমড়া ইত্যাদি) ইতালি, জার্মানি, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও বাহরাইনে রপ্তানি হচ্ছে।

হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, ২০০৫-০৬, ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০, ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যথাক্রমে ২২৪২ মেট্রিক টন, ১৫২৮.১৩ মেট্রিক টন, ২৬৯৪.৭০ মেট্রিক টন, ৫২০৩.৭০ মেট্রিক টন, ৫৪১১.২১ মেট্রিক টন এবং ১১৭৫৬.৬৩ মেট্রিক টন ফল রপ্তানি হয়, যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ফল রপ্তানিতেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে ফল চাষ সম্প্রসারণ :

বাংলাদেশের ফলের ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৭০ ধরনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল জন্মে, যার ক্ষুদ্র একটি অংশ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশে কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, আনারস, কলা, কুল, পেঁপে, পেয়ারা, নারিকেল প্রধান বা প্রচলিত ফল হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রামের বিপরীতে প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৭৪.৪২ গ্রাম।

সারা বিশ্বে ফল একটি আদৃত ও উপাদেয় খাদ্য। ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর এ পর্যন্ত উষ্ণ এবং অবউষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে চাষোপযোগী ৩০টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের ৬৫টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, যেগুলোর অধিকাংশ কৃষক পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে এবং দেশীয় ফলের চাষ সম্প্রসারণসহ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এসব উন্নত জাতের আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ হওয়া অপরিহার্য।

ফল চাষ সম্প্রসারণে সমস্যাবলি :

বাংলাদেশে ফল চাষে নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। এ সম্পর্কে নি¤েœ আলোচনা করা হলো--

১. কৃষকদের ফল চাষ সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব।

২. গুণগত মানসম্পন্ন কলমণ্ডচারার অভাব।

৩. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের ফল চাষ সম্পর্কিত জ্ঞানের অপ্রতুলতা।

৪. গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ও বিএডিসির সমন্বয়ের ঘাটতি।

৫. ব্যক্তি মালিকানাধীন নার্সারিতে ফলের উন্নত জাতের মাতৃগাছের অভাব।

৬. উন্নত জাতের গুণগত মানসম্পন্ন কলমণ্ডচারা উৎপাদনের জন্যে সঠিক জ্ঞানের অভাব।

৭. উন্নত উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞানের অভাব।

৮. অধিকাংশ ক্ষেত্রে বীজ থেকে ফল গাছ হওয়ায় ফলের ফলন ও গুণগতমান উভয়ই নিম্নমানের হয়।

৯. বাংলাদেশের চাষের জমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

১০. ফল পচনশীল বিধায় সংগ্রহোত্তর সঠিক পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না বিধায় প্রায় ২৫ শতাংশ ফল সংগ্রহোত্তর নষ্ট হয়ে যায়।

১১. বছরের কিছু সময় (মে-আগস্ট) ফলের সমারোহ থাকলেও অবশিষ্ট সময়ে (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) দেশীয় ফলের প্রাপ্যতা থাকে খুবই কম।

১২. ফল বৃক্ষের বাগান তৈরিতে উৎসাহ কম।

১৩. অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়াগত কারণে ফলন কম হয়।

১৪. প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফল চাষ তেমন গুরুত্ব পায় না, তাই দেশ থেকে অনেক ফল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

১৫. পাহাড়ি জমিতে ফল চাষ করা কষ্টকর বিধায় তা চাষের আওতায় আসছে না।

১৬. ফল গাছ রোপণের পর ফল আসতে দীর্ঘ সময় লাগে বিধায় অনেকে ফল চাষে আগ্রহী হয় না।

ফল চাষ সম্প্রসারণে করণীয় :

১. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত পদ্ধতিতে ফল চাষ করার মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

২. উন্নতজাতের গুণগত মানসম্পন্ন কলমণ্ডচারার উৎপাদন বৃদ্ধি করে কৃষকরা তা সহজলভ্য করতে পারবে।

৩. ফল চাষ বিষয়ে কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, যা দেশে ফল চাষের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

৪. প্রতি বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলের উন্নত জাতের মানসম্পন্ন কলমের চারা নিজস্ব নার্সারিতে উৎপাদন ও বিপণন করতে হবে।

৫. ব্যক্তিকে উন্নত জাতের মাতৃগাছের বাগান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৬. সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নার্সারিম্যান ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৭. ফলের উন্নত টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে সারা দেশে ফলচাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে।

৮. ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে ফল চাষ হচ্ছে এমন সব অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম ফলনশীল জাত পরিবর্তন করতে হবে।

৯. বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পতিত জমি রয়েছে, সেখানে অনায়াসেই উন্নত জাতের ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।

১০. ফল দ্রুত পচনশীল বিধায় এর সংগ্রহোত্তর অপচয় (২৫ থেকে ৪০ শতাংশ) রোধ করা ও সঠিক গুণগত মান বজায় রাখার জন্যে লাগসই উন্নতমানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।

১১. আমাদের দেশে বছরের কিছু সময় (মে-আগস্ট) দেশের ফলের ৬১ ভাগ উৎপাদিত হওয়ায় ফলের বিপুল সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। এ সময় তা পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

১২. বেশি করে ফলবৃক্ষের বাগান তৈরিতে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে।

১৩. প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন ফলের সঠিক জাত নির্বাচন ও রোপণ করতে হবে।

১৪. বেশি করে অপ্রচলিত ফলের চাষ করতে হবে, যাতে ফল বিলুপ্ত না হয়।

১৫. পতিত জমি চাষের মাধ্যমে ফল চাষ সম্প্রসারণ করা এবং ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।

১৬. বেশি করে কলমের গাছ রোপণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

বিদেশি ফলের তুলনায় দেশি ফলে বেশি পুষ্টিগুণ থাকে এবং দেশি ফল আমাদের জন্যে সহজলভ্য। তবে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম উপায়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফল পাকিয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। তাই দেশি ফলের স্বাদ ও পুষ্টি গ্রহণের জন্যে এর চাষ বাড়াতে হবে এবং ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

সাদিয়া সাইয়ারা : ছাত্রী, অষ্টম শ্রেণী, হলি ক্রস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়