প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শিক্ষাক্রম বিতর্ক এবং কিছু কথা
সন্তানদের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী মানুষ হলেন তাদের মা-বাবা ও পরিবার-পরিজনের সদস্যগণ। তারা নিশ্চয়ই সন্তান-সন্ততিদের মঙ্গল চান। ছেলে-মেয়েরা ভালো মানুষ হয়ে উঠুক, যোগ্য মানুষ হয়ে উঠুক, মানবিক মানুষ হয়ে উঠুক, এই প্রত্যাশা সকল মা-বাবার ও আত্মীয়স্বজনের। শিক্ষার্থীরা নিজের প্রতি, পরিবার-পরিজনের প্রতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি অবদান রাখুক, এটা প্রত্যেক মা-বাবাই চান। কিন্তু এই চাওয়াটা সব সময় সঠিকভাবে হয় না। তারা অধিকাংশই মনে করেন, পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করলেই তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। বাস্তবে তা হয় না। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সঙ্গে বা তথাকথিত প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তাদের প্রত্যাশিত মানুষ হওয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। আর এ প্রসঙ্গেই কিছু কথা বলি।
২০২১ সালের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। একশ্রেণির অভিভাবক, শিক্ষক এবং অপরিজ্ঞাত কিছু লোক এই শিক্ষাক্রম ত্রুটিপূর্ণভাবে, বিকার-বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছেন। কেউ কেউ ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়গুলোর নামে ইচ্ছা করে বিকৃত ভিডিও বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এভাবে সরকারের একটি যুগোপযোগী উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। আর সেই সব ভিডিওতে অনেক মানুষ কোনো কিছু বিচার-বিবেচনা না করে যাচ্ছে তাই প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। এদের মধ্যে সিংহভাগ পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না নিয়ে এবং তা প্রণয়ন, মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নের কোনো প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান অর্জন না করে ভুলভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার শিক্ষাক্রমটিকে হাস্যকর করে তোলার অপচেষ্টায় লিপ্ত। কঠিন কথাই বলি, মন্তব্যে তাদের বোধবুদ্ধি, ভাষাজ্ঞান, বাক্য প্রণয়ন ও বানান দেখলে বোঝা যায়, এদের অধিকাংশই অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, মূর্খ এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে ধান্ধাবাজ লোক। মূলত এরাই পরিমার্জিত শিক্ষানীতি নিয়ে ট্রল করছেন যা জাতির জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়। এমন পরিস্থিতিতে যাদের শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আছে; বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান আছে তাদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করছেন। ওইসব লেখালেখি নিয়েও ট্রল করা হচ্ছে।
প্রত্যেক নাগরিকেরই কথা বলার অধিকার আছে। তাদের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও মতামতের প্রকাশ ঘটানোর স্বাধীনতার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু সেটা যদি মতামত না হয়, বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন যুক্তি-তর্ক না হয়, তা হলে ওইসব মন্তব্য ও লেখালেখি দিয়ে সত্যিকার অর্থে কারোরই কোনো উপকার হয় না। শুধু ক্ষতি হয়। আর যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অন্যের বা দেশের ক্ষতির জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন তাকে সাইবার ক্রাইম হিসেবে গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়।
এমন পরিস্থিতিতে কথা বলা দরকার। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিভাষা ব্যবহার না করে সহজবোধ্যভাবে কিছু কথা বলি।
বাংলাদেশে যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে তা একান্তভাবেই পরীক্ষানির্ভর। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক পড়ে, স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়ে, কোচিং সেন্টারে অথবা প্রাইভেট টিউটরদের কাছে পড়ে। এর মাধ্যমে কী শিখল, কতটা মুখস্থ করতে পারল, কতটা অনুধাবন করতে পারল এই বিষয়গুলোকে পেপার-পেনসিল টেস্টের মাধ্যমে অর্থাৎ কাগজে-কলমে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধার পরিচয় নেওয়া হয়। অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থী ৫০/১০০ নম্বরের পরীক্ষায় কত নম্বর পেল, তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা হয়, আর এর মাধ্যমে সে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ পেল না ফেল করল কিংবা জিপিএ কত পেল তা নির্ধারণ করে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এই সার্টিফিকেট তার দক্ষতার কোনো স্তর নির্দেশ করে না। এই পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থীর চিন্তা করার দক্ষতা (কগনেটিভ ডোমেইন) কিছুটা যাচাই করা যায়। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর চিন্তা করার দক্ষতাই তো সব নয়। তার মূল্যবোধ আছে, আবেগ আছে, অনুভব-অনুভূতি আছে, উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে, স্বভাব-চরিত্র আছে, দৃষ্টিভঙ্গী আছে (এ্যাফেক্টিভ ডোমেইন) এগুলোর উন্নয়ন ও পরিমাপ তো লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে মূল্যবোধের একটি উদাহরণ দিই। ‘সাধারণ যাত্রীবাহী গাড়িতে নারী, গর্ভবতী মা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা শিশুদের সিট ছেড়ে দিতে হবে।’ এটি নীতির কথা, মূল্যবোধের কথা। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়তই দেখি যে, গাড়িতে কোনো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, মহিলা বা গর্ভবতী মা উঠলে তরুণ বা যুবক-যুবতীরা সিট ছেড়ে দেয় না। তার কারণ হলো, ওই নীতিকথা তাদের জানা থাকলেও তাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি হয়নি। সুতরাং এর জন্য তাদের দায়ি করা যায় না। কারণ, এই মূল্যবোধ তৈরি হয় পরিবার থেকে বা স্কুল-মাদ্রাসায় শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। তবে পরিবারের উপর এসব ছেড়ে দেওয়া যায় না। কারণ অধিকাংশ পরিবার এসব বিষয়ে প্রশিক্ষিত তো নয়ই, সচেতনও নয়। সুতারাং এ দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পুরো একটি ক্লাসকে একটি বাস হিসেবে বিবেচনা করে শিক্ষক নির্দেশনা দিতে পারেন, “তোমরা আজ একটি অভিনয় করবে। ক্লাসরুমটি একটি বাস। তোমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই বাসের যাত্রী। সামনে থাকবে একজন ড্রাভার এবং একজন হেলপার। কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্টেশন থেকে গাড়িতে উঠবে, অর্থাৎ ক্লাসরুমে ঢুকবে। যারা বিভিন্ন স্টেশন থেকে ক্লাসরুমে ঢুকবে তারা কেউ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, কেউ গর্ভবতী মা এবং কেউ শিশু, কেউ অসুস্থ ব্যক্তির ভূমিকায় অভিনয় করবে। ধরা যাক একটি স্টেশনে যাওয়ার পর একজন বৃদ্ধা ক্লাসরুমে ঢুকলেন অর্থাৎ বাসে উঠলেন। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে যাবে ওই বৃদ্ধাকে বসতে দেওয়ার জন্য। অন্য একটি স্টেশনে গাড়ি থামার পর গর্ভবতী মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করা একজন শিক্ষার্থী গাড়িতে উঠবে। তখন কিছু শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে যাবে তাকে সিট দেওয়ার জন্য। অন্য কোনো স্টেশনে গাড়ি থামার পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন অসুস্থ মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করা একজন শিক্ষার্থী গাড়িতে ঢুকবে এবং কিছু শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে যাবে তাকে সিট দেওয়ার জন্য। এই পুরো অভিনয়টি পরিচালনা করবেন একজন শিক্ষক। তাকে সহযোগিতা করবে শিক্ষার্থীরা। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের মূল্যবোধ তৈরি হবে অর্থাৎ ওই মূল্যবোধ হলো যাত্রীবাহী পরিবহনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-গর্ভবতী মা, অসুস্থ ব্যক্তি বা শিশুদের সিট ছেড়ে দিতে হয়। শিক্ষার্থীরা যদি অভিনয়ের ভেতর দিয়ে শেখে তা হলে এক জীবন শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকে এই মূল্যবোধ কখনোই বিলুপ্ত হবে না। এভাবে আমাদের যাপিত জীবনে অসংখ্য বিষয় আছে যা দলবদ্ধ কাজের মাধ্যমে, গান-নৃত্য-অভিনয়-খেলাধুলা ও বিচিত্র কাজের মাধ্যমে উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়ে বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্থায়ী মূল্যবোধ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন ধরা যাক, অভিনয়ের এই পুরো ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হলো। এখন ড্রাইভিং-এর সিটে একজন শিক্ষার্থীকে অভিনয় করতে দেখে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলতে পারেন, ‘আমার ছেলেকে তো আমি ড্রাইভিং শেখার জন্য স্কুলে পাঠাইনি।’ এমন মন্তব্য মূল্যবোধ বিবর্জিত। কারণ প্রথমত তিনি জানেনই না যে, এই অভিনয়ের সঙ্গে ড্রাইভিং-এর কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়ত, ওই বক্তব্যের মাধ্যমে যারা এই দেশে ড্রাইভিং করছেন তাদের কর্মকে হেওপ্রতিপন্ন করা হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর সব দেশেই ড্রাইভিং আছে, কেউ যদি ড্রাইভিং-এর সকল আইন-কানুন, বিধি-বিধান, নিয়মণ্ডনীতি অনুসরণ করে ড্রাইভিং করেন; যাত্রীদের প্রতি যদি তার দায়বোধ থাকে; পথচারী ও অন্যান্য পরিবহনের প্রতি তার যদি দায়িত্ববোধ থাকে, তাহলে ড্রাইভিং তো কোনো খারাপ কাজ নয়। চুরিদারি করা খারাপ কাজ, অন্যের সম্পদ হরণ করা খারাপ কাজ, ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করা খারপ কাজ। ড্রাইভিং তো খারাপ কাজ নয়। মানুষ তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী যে কোনো বৈধ কাজ করতে পারেন। তাকে ছোট করে দেখার মধ্যে মূল্যবোধের অভাব ছাড়া আর কিছু নেই। আবার এমন লোকও পাওয়া যাবে যিনি বলবেন ‘আমার মেয়েকে কি আমি গর্ভবতী মা হওয়ার জন্য স্কুলে পাঠিয়েছি?’ বুঝুন ঠেলা। এ ধরনের মূর্খদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে কার সামর্থ্য আছে বোঝানো যে, ‘বাবা রে এটি একজন শিক্ষার্থীর যাত্রী হিসেবে গর্ভবতী মায়ের ভূমিকায় অভিনয় মাত্র’।
মানুষের জীবন মূলত কর্মের জীবন। মানুষকে কাজ করতে হয়। আর এই কাজের জন্য দরকার মন ও পেশির সক্রিয়তা (সাইকোমটর ডোমেইন)। মন, চোখ, বাহু, হাত, আঙ্গুল, পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত আমাদের অনেক কাজ করতে হয়। এই কাজের কোনো অন্ত নেই। কাজ করা একটি মানসিকতা ও অভ্যাসের বিষয়। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানদের কোনো কাজ করতে দেন না। রেজাল্ট বেইজড পড়াশুনা করতে গিয়ে স্কুল, কোচিং, টিউটর ইত্যাদি করতে গিয়ে প্রতিটি দিন এমন ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে হয় যে, কাজ করার কোনো সুযোগও তাদের থাকে না। অধিকন্তু নিজের কাজগুলো নিজে কারা তো দূরের কথা, কোথাও কোথাও এমনও দেখেছি যে, দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে তার মা হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। কেন? পড়ার চাপের জন্য শিক্ষার্থী নিজের হাতে তুলে খেতেও পারছে না। এ ক্ষেত্রে একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ভালো রেজাল্ট। অর্থাৎ না-বুঝে, না-শুনে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরে পঙ্গু বানানো হচ্ছে। বলুন, আমরা এমন অকর্মণ্য, অদক্ষ, পঙ্গু শিক্ষার্থী চাই কি না? এদের খুব ভালো রেজাল্ট দিয়ে তার নিজের, পরিবার-পরিজনের বা সমাজ ও দেশের কী ফায়দা হবে? স্বার্থপরতা ছাড়া এদের অধিকাংশের মধ্যে অন্য কোনো সদগুণ তৈরি হয় কি? দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এদের অধিকাংশকে দিয়ে দেশের বা দেশের মানুষের কোনো উপকার হবে না। এমনকি মা-বাবারও তেমন কোনো কাজে আসবে না এই সব শিক্ষার্থীদের দিয়ে।
সত্তর ও আশির দশকে আমরা যারা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তাদের জীবনযাপনের দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন। আমরা কি পরিবারের কাজ করিনি? যখন ফোর-ফাইভে বা সিক্স-সেভেনে পড়তাম তখন থেকেই ভোরে উঠে বড় ভাই ও বাবা-চাচাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতাম। খেতে মাটির বড় বড় চাকা ভাঙা, বেড়া দেওয়া, মই দেওয়ার কাজ করা, খেত নিড়ানো, ফসল তোলা, আগাছা পরিষ্কার করা, ফসল মারানোর কাজ করা, পাট তোলা, ধোয়া, শুকানো, মাছ ধরা, বাড়িঘর পরিষ্কার করা, বাজার করা ইত্যাকার কত কাজ যে আমাদের করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাতে আমাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়নি, মানসম্মানও যায়নি।
একজন শিক্ষার্থীকে পরিবারের সকল কাজ দক্ষতার সঙ্গে শিখতে হবে। কারণ ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন কোনো না কোনো পরিবার এবং কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তার এক জীবন কাটাতে হয়। সেখানে তাকে কাজ করতে হবে। সেই কাজের তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলো তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করা। এই পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য তার মধ্যে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজের মানসিকতা ও দক্ষতা (সাইকোমটর ডোমেইন) তৈরি করাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এতকাল একজন শিক্ষার্থীর মুখস্থ রাখার ও চিন্তা করার ক্ষমতা কিছুটা পরিমাপ করা গেলেও তার স্বভাব-চরিত্রের উন্নয়ন ও তা যাচাই করার পদ্ধতি শিক্ষাক্রমে থাকলেও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ছিল না। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী মানুষ হিসেবে কেমন, বিচিত্র কর্মকাণ্ডে সে কতটা দক্ষ, জীবনযাপনে সে কতটা পরিশীলিত, কতটা সুশৃংখল; মানুষের ও প্রকৃতির প্রতি তার মমত্ববোধ আছে কি না; একজন শিক্ষার্থী কতটা অসাম্প্রদায়িক জীবনভাবনায় সমৃদ্ধ; তার মধ্যে কতটা সততা ও সৌন্দর্যবোধ আছে, দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি তার দায়বোধ কতটা ইত্যাকার বিচিত্র বিষয়ে তাকে সমৃদ্ধ করে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ একবিংশ শতকের আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো শক্তি, সামর্থ্য ও দক্ষতা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তৈরি করা অপরিহার্য। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা এবং পরীক্ষায় ভালো ফলাফলই যে একজন মানুষকে যোগ্য মানুষ করে তুলতে পারে না, তার প্রমাণ প্রতিনিয়তই আমরা পাচ্ছি। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক পরিবেশে আমরা যে কতটা পিছিয়ে আছি, তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি, কি পরিমান অসহিষ্ণু, অসুন্দর, অবিবেচক ও অপরিজ্ঞাত মানুষ হয়ে উঠছি আমরা! নিজের প্রতি দায়-দায়িত্ব; সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়-দায়িত্ব; সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়-দায়িত্ব; দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি দায়-দায়িত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষতা; বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা; শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা ইত্তাকার সব দিক থেকে আমরা বাদবাকি বিশ্ব থেকে অনেকাংশেই পিছিয়ে আছি। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও তা বাস্তবায় করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার দক্ষতার পাশাপাশি মানুষ হিসেবে তাদের যোগ্য মানুষ করে তোলার জন্য নানা রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাটা ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে করা হচ্ছে। যারা বলেন, বর্তমান শিখন-শেখানো কার্যক্রমে পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে, এই কথাটি সম্পূর্ণরূপে ভুল। অধিকন্তু ছয় মাস ও বারো মাস অন্তর দুটি পরীক্ষা তো আছেই তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীর নিরন্তর উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং এই উন্নয়নের পথে কি ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে তা যাচাই করার জন্য প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হচ্ছে। উল্লেখ থাকে যে, বছরান্তে ধারাবাহিক মূল্যায় ও দুটি সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত স্কোর নির্ধারণ করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে ধারাবাহিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের সমন্বয় সাধনের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি না তা জানা নেই। ওই ব্যবস্থা থাকলে সামষ্টিক মূল্যায়নে দুর্নীতির আশঙ্কা থাকবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, পাঠ্যপুস্তকে তেমন কোনো টেক্সট নেই। পড়ানোর জন্য কোনো নির্দেশনাও নেই। তাদের এই মনে করাটা অবান্তর নয়। করাণ আমরা যে ধরনের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে পরিচিত, পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুসারে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকগুলো সে রকম নয়। সম্পূর্ণরূপে পাঠ্যপুস্তক নির্ভর পড়াশোনা থেকে বের হয়ে আসার জন্যই এই উদ্যোগ। এই পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর জন্য দেশের প্রায় সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং রচনা করা হয়েছে টিসার্স গাইড। সুতরাং অভিবাবকগণ এই পাঠ্যপুস্তক পড়াতে পারবেন না। এই না পারাটা কোনো অপারগতা নয় বা অন্যায়ও নয়। কারণ শিক্ষার্থীদের পড়ানোর দায়িত্ব শিক্ষকদের, অভিভাবকদের নয়। কারো পোশাক বানানোর দায়িত্ব যেমন দরজির, চুল কাটার দায়িত্ব যেমন নরসুন্দরের, চিকিৎসা করার দায়িত্ব যেমন ডাক্তারের, তেমনি পড়ানোর দায়িত্বও শিক্ষকের। সারা পৃথিবীতেই এই বিধান প্রচলিত। আমার বাবা বলতেন, “যার কাজ তার সাজে, অন্য লোকের লাঠির মাঝে।” সুতরাং চলুন, আমরা যার কাজ তাকে করতে দিই।
দুঃখের সঙ্গে বলি, আমরা অধিকাংশই যে যোগ্য মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, তার দায় আমাদের নয়, আমাদের অভিভাবকদের নয়, আমাদের শিক্ষকদেরও নয়- তার দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। আবারও বলি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য, সুন্দর ও সুন্দরের পার্থক্য, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারিনা। আমরা বুঝতে যে পারিনা, সেটাও বুঝতে পারি না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আগে থেকেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়গুলো থাকত, তাহলে প্রতিনিয়ত আমাদের স্বভাব-চরিত্রের ও কর্মকাণ্ডের পরিমার্জন করে করে আমাদের শিক্ষকগণ আমাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের সময় এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। ফলে আমরা অনেকেই শিক্ষিত হয়েছি, কিন্তু ভালো মানুষ হতে পারিনি, হৃদয়বান মানুষ হতে পারেনি, দক্ষ নাগরিক হতে পারিনি, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হতে পারিনি, শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের মানসিকতা লাভ করিনি। আমাদের এই সীমাবদ্ধতার কথা আপনারা স্বীকার করতে পারেন, নাও করতে পারেন। কিন্তু এটাই বাস্তবতা।
নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন পথে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতেই পারে। বিশেষ করে নতুন একটি ব্যবস্থা যখন বাস্তবায়ন করতে যাওয়া হয়, তখন নানা রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, নানা রকমের ভুল-ভ্রান্তি হয়। অভিভাবক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে কিংবা দেশপ্রেমিক একজন মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত, ব্যবস্থাটি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে সততার সঙ্গে সংশ্লিষ্টি ব্যক্তিদের পরামর্শ দেওয়া। একটি আশঙ্কার কথা বলে শেষ করি। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এবং উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তাঁদের সহকর্মীগণ এই ব্যবস্থাটিকে মনেপ্রাণে ধারণ করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা পিছপা হবার মানুষ নন। কিন্তু আগামী ৭ জানিুয়ারি, ২০২৪-এর নির্বাচনের পরে কী হবে তার উপর কি এই ব্যবস্থার নিয়তি নির্ভর করবে? নাকি ব্যবস্থাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে থাকবে? যদি তাই থাকে তা হলেই জাতির মঙ্গল।