প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৫.
ড. সরকার আবদুল মান্নান স্বীকার করতে মোটেই কসুর করেন না, ‘শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় সম্মানের স্থান হলো তাদের শিক্ষার্থী। সেই শিক্ষার্থীরাই যদি তাদের ঘৃণা করে তা হলে সমাজের আর কোথাও তাদের মর্যাদা পাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং শিক্ষকগণ যদি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে চান তা হলে প্রথমেই মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষার্থীদের মনোজগতের দিকে। আবার অনেক শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। তাদের এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূলে আছে শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের মমত্ববোধ। তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাদের বিবেচনায় রাখেন এবং শিক্ষার্থীদের সকল সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে প্রশংসা করেন। তারা সব ধরনের শিক্ষার্থীকে ক্লাসে অংশগ্রহণ করার পরিবেশ তৈরি করেন। এবং ক্লাসরুমটিকে আনন্দঘন করে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হয় এবং আনন্দের সঙ্গে শিখন-শেখানো কর্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার শক্তি লাভ করে। ফলে এই ধরনের শিক্ষকগণ সর্বদা সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন।’
১৬.
নিবিড় পাঠ ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় পাই ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর বিভিন্ন প্রবন্ধে। যেমনটি আলোচিত রচনাতেই দেখি। তিনি শেষ করছেন এভাবে, ‘অমর্ত্য সেন তাঁর জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি গ্রন্থে ‘পড়সসড়ফরঃু ভবঃরংযরংস’ বা পণ্যমোহবদ্ধতা বলে একটি অভিধা ব্যবহার করেছেন। এই অভিধাটি তিনি নিয়েছেন কালমার্কস-এর দর্শন থেকে। এর মানে হলো ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পণ্যের প্রতি মানুষের লোভাতুরতা যা অনেক সময় অসুস্থতার পর্যায়ে উপনীত হয়। একবিংশ শতকে এসে আমরা লক্ষ্য করছি যে, পণ্যের কাছে এখন মানবিক মূল্যবোধগুলো পরাস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষকও এখন পণ্যমোহাবদ্ধ হয়ে উঠেছেন। ফলে কতভাবে টাকা উপার্জন করা যায় এবং আর দশজন অশিক্ষক মানুষের মতো বিলাসবহুল জীবন যাপন করা যায় তার চেষ্টায় তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে তারা শিক্ষকের মর্যাদার আসন থেকে নেমে আর দশজন মানুষের কাতারে কিংবা তারও নিচে নেমে গেছেন। তাদের এই পণ্যমোহবদ্ধতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। একটি সেবার পেশাকে তারা ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে তাদের সময় কিনে নিচ্ছে এবং সেই কিনে নেওয়া সময় যথাযথভাবে দেওয়ার জন্য শিক্ষকগণ দৌড়ের উপর থাকছেন- কোচিং থেকে দৌড় দিচ্ছেন ক্লাসে আর ক্লাস থেকে দৌড় দিচ্ছেন কোচিং-এ। এই জীবন সম্মানের হতে পারে না- না শিক্ষার্থীদের কাছে, না সমাজের অন্য সদস্যদের কাছে। অথচ কথা ছিল তাদের দরজা সকল শিক্ষার্থীর জন্য সব সময় খোলা থাকবে এবং সন্তান-সন্ততির মতো তারা শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো রকম আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন না। তারা সংসার চালাবেন বেতনের টাকা দিয়ে-তাতে যত সমস্যাই হোক না কেন। এবং পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে, নিষ্ঠায়, সততায় ও ন্যায়পরায়ণতায় তিনি হবেন আদর্শস্থানীয়। শিক্ষকের ঘর আসবাবপত্র ও নানা রকম পণ্যে ঠাসা থাকবে না। তার ঘরে থাকবে বই আর বই। তা হলেই তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে এবং সমাজের কাছে সম্মানিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন, সম্মানিত হতে পারতেন। এবং এই পথে আমাদের সম্মান আমাদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
১৭.
লেখক হিসেবে ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর আরেকটি প্রয়োজনীয় ও প্রিয় রচনা ‘ নারীর ভাষিক জগৎ’। রাজনীতির ছাত্র হিসেবে জেন্ডার ইস্যুটি পাঠ থাকায় ভাষার রাজনীতির পাঠ নিতে হয়েছিলো একসময়। সেই পাঠেরই প্রয়োজনীয় ও সহায়ক পাঠ্য হিসেবে মান্নান ভাইয়ের এই রচনাটি গুরুত্বর্ণৃ বিবেচিত হলেও কিছুটা অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়েছে। রচনায় ভাষার ইতিহাসে নারীর ভূমিকা এবং ভাষার রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি কিছুটা হলেও উল্লেখ থাকা জরুরি ছিলো বলেই মনে করি। তারপরও রচনাটি সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে যখন তিনি নানা পাঠের অভিজ্ঞতায় উল্লেখ করেন, ‘মানুষ ভাষিক প্রাণী। মূকপ্রতিবন্ধী না-হলে জন্মের অব্যবহিত পর থেকে মানুষ ভাষা ব্যবহার করে বস্ত্ত ও ভাবময় বিশ্বকে প্রকাশ করে। আর এই ভাষিক জগৎ হলো কোডিং, ডিকোডিং ও এনকোডিংয়ের জগৎ। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতীক, প্রতীকের অর্থময়তা ও সেই অর্থময়তাকে বুদ্ধিমত্তার মধ্যে ধারণ করে ভাষিক জগৎ তৈরি করে। মানবীয় বিশ্ব বলতে মূলত এই ভাষিক জগৎকে বোঝায়। ভাষা ছাড়া চিন্তার কোনো রূপ তৈরি হতে পারে না। সুতরাং চিন্তার বাহন হলো ভাষা। উচ্চারিত-অনুচ্চারিত যাই হোক না কেন, ভাষা ছাড়া মানুষ ভাবতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। তাই ভাষার মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষের মানবীয় অসিন্তত্বের রকমফের। মানুষের অর্থনৈতিক পরিচয়, সামাজিক মর্যাদার পরিচয়, সংস্কৃতিগত অবস্থার পরিচয় এবং বিশেষ করে লৈঙ্গিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় ভাষিক জগৎ। সুতরাং নারী ও পুরুষের ভাষিক জগৎ যে এক হতে পারে না, এ-বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। বিশেষ করে যে-সমাজে জেন্ডার-বৈষম্য চরম, যেখানে ক্ষমতায়নের পাল্লা পুরুষমুখী, সে-সমাজে ভাষিক জগতেও তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকে নারীরা প্রামিন্তক জনগোষ্ঠী এবং ন্যূনতম ক্ষমতা থেকেও বঞ্চিত। ফলে তাদের ভাবনা ও ভাবনা-প্রকাশ চিরকালই দ্বৈরথে নিমজ্জিত। গভীর অনুভব ও তীব্র স্পর্শকাতরতার যে-জগৎ তারা লালন করে তা চিরকালই অবহেলিত এবং তাদের অনিশ্চয়তার ভাষা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে একটি স্থায়ী কাঠামো লাভ করেছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রবিন লেকফ ‘Language and woman’ s place' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন : In appropriate women's speech, strong expression of feeling is avoided, expression of uncertainty is favored, and means of expression in regard to subject-matter deemed 'trivial' to the 'real' world are elaborated. Speech about women implies an object, whose sexual nature requires euphemism, and whose social roles are derivative and dependent in relation to men. The personal identity of women thus is linguistically submerged; the language works against treatment of women, as serious persons with individual views. তার মানে প্রতিটি ভাষারই একটি লৈঙ্গিক পরিচয় আছে এবং এই পরিচয় নির্ধারিত হয় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংসৃকতিক পটভূমির আলোকে এবং এই পটভূমিতে পুরুষগণ চিরকালই অসামান্য প্রাধিকারপ্রাপ্ত। শুধু তাই নয়, ভাষা সংগঠনের যে নিরবচ্ছিন্ন ধারাক্রম সেই ধারা পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত। অতি সাম্প্রতিককালে ভাষাতাত্ত্বিক ডেবোরা টানেন (Deborah Tannen), একেই জেন্ডারলেক্ট (Genderlect) বলে অবহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, নারী-পুরুষের ভাষা শুদ্ধ কি অশুদ্ধ, ঊর্ধ্বতন কি অধস্তন সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো, তাদের ভাষা আলাদা। এই স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ এতটাই যে, একজন ব্রিটিশ ও একজন জাপানির সংস্কৃতিগত ভিন্নতার জন্য বাচনে যে ভিন্নতা দেখা যায় নারী ও পুরুষের বাচনে সেরূপ ভিন্নতা পরিলক্ষেত হয়। এই ভিন্নতার পরিচয় উল্লেখ করা যায়।’ আমার রচনার পরিসর বৃদ্ধির আশংকায় আরও বেশি অংশ সংযোজন থেকে নিবৃত থাকতে হলো। (সমাপ্ত)
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা।