প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শিক্ষা আমার অধিকার, এই অধিকার সবার চাই। শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষা আমার অধিকার। শিক্ষা মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে, মানবিকতা সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলে। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার আর তাই শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। পৃথিবীর যে দেশ শিক্ষাখাতে যত বেশি বিনিয়োগ করেছে সেই দেশ ততো বেশি উন্নত হয়েছে এবং সেই সাথে সভ্যতা বিকাশেও রেখেছে অনন্য উচ্চতার ভূমিকা। আমরাও শিক্ষায় উন্নত হতে চাই, মানবিক, দেশপ্রেমিক, উন্নত রুচির মানুষ হতে চাই। দেশপ্রেমবর্জিত শিক্ষা এবং নামমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কো-কারিকুলাম শিক্ষা দিয়ে আমরা কখনোই শিক্ষার এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নতির লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো না। একটি সার্বজনীন, সেক্যুলার, বিজ্ঞানভিত্তিক একই পদ্ধতির মানবিক, সৃজনশীল শিক্ষার মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব সরকার শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার রুখে দাঁড়ানোর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যা আজও শিক্ষা আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে আছে।
গণবিরোধী ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আগুন জ্বেলে রুখে দাঁড়িয়েছিল এদেশের ছাত্রসমাজ। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২, এই শিক্ষা সংকোচন নীতি বাতিলের দাবিতে আহ্বান করা হয় সর্বাত্মক হরতাল। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে সর্বস্তরের জনতার মিছিলে দফায় দফায় পুলিশ হামলা চালায় ও গুলিবর্ষণে ঢাকায় শহিদ হন বাবুল (ছাত্র), গোলাম মোস্তফা (বাস কন্ডাক্টর) ও ওয়াজিউল্লাহ (গৃহভৃত্য)। টঙ্গীতে শ্রমিকদের মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হন সুন্দর আলী নামে একজন শ্রমিক। তাই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আইয়ুব সরকারের যে শিক্ষা সংকোচন নীতি এদেশের ছাত্রসমাজ প্রতিহত করেছিল। শরীফ কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি আর স্বাধীনতাত্তোর দেশে প্রণীত সবকটি শিক্ষানীতির অন্তর্গত মৌল চরিত্র এক ও অভিন্ন। নতুন মোড়কে হাজির করা হয়েছে শিক্ষার বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার বৈষম্যহীন একই ধারার গণতান্ত্রিক শিক্ষার দাবি উপেক্ষিত। শিক্ষার প্রধান ধারাই এখন বেসরকারি ধারা। বর্তমানে দেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগই বেসরকারি। শিক্ষার মর্মবস্তুকে ধ্বংস করে সিলেবাসে যুক্ত করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা। শিক্ষা আজ বহুধারায় বিভক্ত। শিক্ষার সংকট বহুগুণে বেড়েছে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমছে প্রতি বছর। এ বছর শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের মাত্র ১১.৫৭ শতাংশ। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশ বহন করে শিক্ষার্থীদের পরিবার। পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় এই হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। দেশের ৫৫ শতাংশ শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। প্রাথমিক স্তরে মোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হার ২২ শতাংশ, সংখ্যায় ২৯ হাজার।
মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ৯৪ শতাংশ, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ছয় হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ৯০০টি। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সম্প্রতি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২০’-এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কারিকুলামে বিজ্ঞান শিক্ষাকে সংকুচিত করা হয়েছে, শিক্ষাকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কারিগরিকরণের দিকে। পাঠদান ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা চমকপ্রদ হলেও অবকাঠামোসহ শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদল ব্যতীত এটির প্রয়োগ নতুন করে শুধু জটিলতাই তৈরি করবে। নতুন পদ্ধতির সাপেক্ষে দক্ষ শিক্ষক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। বছরের শুরুতে নিম্ন মানের পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে। অর্ধেক বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক শিক্ষার্থীর হাতে এখনও বই পৌঁছায়নি। প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের নাম ঊর্ধ্বমুখী। তার সাথে যুক্ত আছে বর্ধিত বেতন ফি। এই ক্রমবর্ধমান শিক্ষা ব্যয়ের ফলে সৃষ্ট আর্থিক সংকটে করে পড়ছে দেশের বিশাল অংশের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের অনুগামী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকার আয়োজন চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে বজায় সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন বহু ধারায় বিভক্ত তেমনি সমগ্র জাতিও আজ বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্প্রীতির পরিবর্তে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন, হত্যা, সাম্প্রদায়িকতা বহুগুণে বেড়েছে। বেড়েছে আত্মহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং বলাৎকারের মতো ঘটনাও। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যেণের লক্ষ্যে শিক্ষার চলমান সংকট ও সংকোচন নীতির পরিবর্তে সবার জন্য একই ধারার, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণসমৃদ্ধ শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করতে একই ধারার, বিজ্ঞানভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বাস্তব জ্ঞানসমৃদ্ধ মানবিক শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার যারা কারিগর তাদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার সামগ্রিক বৈষম্য রোধে সরকারগুলোকে পাঁচ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে ইউনেস্কো।
প্রাক-প্রাথমিকে এক বছর এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ১২ বছরের শিক্ষা বিনামূল্যে নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা। সরকারি ও বেসরকারি সব শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মানদ- নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যে একই ধরনের কর্মপদ্ধতি ও তদারকি ব্যবস্থা প্রণয়নের সুপারিশ করে সংস্থাটি। এছাড়া সুপারিশ রয়েছে, সর্বজনীন কল্যাণে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্ভাবনের প্রসার ঘটানো এবং সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি শিক্ষানীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও একাগ্রতা নিশ্চিতকরণের। ইউনেস্কোর এই সুপারিশের সাথে আমরাও একমত পোষণ করছি রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক চেতনার সমৃদ্ধি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং দেশপ্রেমসমৃদ্ধ মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার জন্য। শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা বাংলা।
যারা সার্বজনীন, সেক্যুলার, বিজ্ঞানভিত্তিক একই পদ্ধতির মানবিক, সৃজনশীল শিক্ষার জন্য জীবন দিলো এই শিক্ষা দিবসে সার্বজনীন, সেক্যুলার, বিজ্ঞানভিত্তিক একই পদ্ধতির মানবিক, সৃজনশীল শিক্ষা প্রচলনের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র এবং সরকার তাদের জীবন দানের যথাযোগ্য মর্যাদা দিবেন বলে আমরা বিশ্বাস রাখি এবং এর মাধ্যমে আমাদের সোনার বাংলা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করবেন। শিক্ষা হয়ে উঠবে সবার এবং মানবিক। প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার মৌলিক অধিকার।