প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর সিদ্ধান্ত জারির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারির আগে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করতে হলে আরও শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন। বাড়াতে হবে ক্লাসরুমের সংখ্যা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও ক্লাসরুমের সংখ্যা না বাড়িয়ে বাস্তবতা বর্জিত নির্দেশনা জারির বিষয়টিকে সবাই ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয় বলছে, পাশাপাশি অবস্থিত দুই বা ততোধিক স্কুল সমন্বয় করে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে আর এতে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা বেচে যাবে।
এরই মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরিদর্শন শুরু করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যাচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরো বিষয় ম্যানেজ করতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা সময়মতো বিদ্যালয়ে আসছেনই না। এছাড়া মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু প্রতিষ্ঠানে ৫ থেকে ৭ জন শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী আছেন ৫ থেকে ৬ জন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে ২ থেকে ৩ জন শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা কয়েকশ’। কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় ৬৬ হাজার। এদের মধ্যে সারাদেশে ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী থাকা স্কুল আছে হাজারখানেক। এগুলোর অধিকাংশতেই শিক্ষার্থী আছে ১০ থেকে ১২ জন। আর ১০০ জনের কম শিক্ষার্থী আছে কয়েক হাজার স্কুলে। এমতাবস্থায় ও শিক্ষক সংখ্যায় ভারসাম্যহীনতা, দূরত্ব, শিখন ঘণ্টা বাড়ানো ও শিফট ইত্যাদি বিবেচনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এক শিফট করার যৌক্তিকতাসমূহ : প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা নিদের্শনায় বলা হয়েছে, যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক রয়েছেন, সেগুলোতে অবিলম্বে এক শিফট চালু করতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক বা শ্রেণিকক্ষ নেই বা উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে সেসব বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এমন দুটি বিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে দুই ভাগ করে একক শিফটে পাঠদান পরিচালনা করতে হবে। এই বিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একটি বিদ্যালয়ে এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অন্য বিদ্যালয়ে পাঠদান করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। দেখা যায় কোন প্রতিষ্ঠানে তিনটি কক্ষ আছে। পাশের একটি বিদ্যালয়েও হয়তো তিনটি কক্ষ রয়েছে। এ ধরনের স্কুলগুলোর মধ্যে পাঠদান সমন্বয় করা হবে।
এতে কোন শিক্ষক বাদ যাবেন না, বা কোন স্কুল বিলুপ্ত হবে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কোন সমস্যা হবে না। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, অনেক স্কুলে বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও সে স্কুলের অবকাঠামোগত সক্ষমতা নেই। আবার পাশের স্কুলেই শিক্ষার্থী কম। এ ধরনের দুটি বিদ্যালয় সমন্বয় হলে বেশি শিক্ষার্থী থাকা প্রতিষ্ঠানটির জন্য নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন হবে না। ফলে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা বেচে যাবে। এক শিফট হলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষকরা শ্রেণি পাঠদানের সময় বেশি পাবেন। তাই শিখন-শেখানো কার্যক্রম অধিক ফলপ্রসূ হবে। শিক্ষার্থীরা বেশি করে কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। দুই শিফটে সময়ের অভাবে সংগীতচর্চা , কবিতা আবৃত্তি, শ্রুতিলিখন ও দেয়াল পত্রিকা তৈরি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এক শিফট মানে হচ্ছে সব শিক্ষার্থীর একই পরিমাণ সময়। ফলে শিশুরা খেলাধুলা করার সুযোগ পাবে। কিন্ডারগার্টেন ও হাইস্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সময়সূচিও একই করা উচিত বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে : এ নির্দেশ জারির পর বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাস্তবে এ আদেশ প্রতিপালন করা কঠিন। সব বিদ্যালয়ে এক শিফট করতে গেলে আরও শিক্ষক প্রয়োজন। দরকার হবে বাড়তি ক্লাসরুমেরও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুরা পড়ে। রয়েছে প্রাক-প্রাথমিকের খুদেরাও। তাদের পক্ষে এক কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা বাস্তবসম্মত নয়। এ সিদ্ধান্তের কারণে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে ছাত্রীদের পক্ষে দূরের স্কুলে গিয়ে পাঠগ্রহণ সব সময় সম্ভব হবে না। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যাও কমে যেতে পারে। নষ্ট হবে ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যার ভারসাম্য। উপরন্তু চর, হাওর-বাঁওড় ও পার্বত্য অঞ্চলের মতো দুর্গম এলকায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। দুই পৃথক বিদ্যালয় একীভূত করা হলে যে বিদ্যালয়ে ক্লাস হবে না, সেই বিদ্যালয়ের ভূমি, ভবন, পুকুর অন্যান্য সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে হবে- এসব প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছে না।
বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৫৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে এক কোটি ৪২ লাখ ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে। শিক্ষক রয়েছেন সাড়ে তিন লাখ। সাড়ে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯০ ভাগই ডাবল শিফটের স্কুল। এ সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। এক শিফটের স্কুলগুলোতে সকাল ৯টায় পাঠদান শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৩টায় শেষ হয়। আর দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শিফট সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা, ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সমাবেশ ও পিটি এবং দ্বিতীয় শিফটে সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত টানা পাঠদান চলে। ঢাকা মহানগরীরর ক্ষেত্রে (শীতকালীন) ডাবল শিফটের স্কুল সকাল সোয়া ৮টা থেকে সোয় ১১টা, দ্বিতীয় শিফট সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত পাঠদান চলে।
গ্রামীণ অনেক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ এক শিফট চালানোর মতো উপযুক্ত নয়। পাশাপাশি বিদ্যালয় অবস্থিত হলেও দুটির দূরত্ব কোথাও এক, কোথাও দুই কিংবা তিন কিলোমিটারের মধ্যে। এভাবে এক বিদ্যালয় থেকে আরেক বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতে শিক্ষার্থীদের কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কারণে বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য বিকল্প প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা ভাবছেন। তাছাড়া বাচ্চারা তো নতুন পরিবেশে, নতুন জায়গায় খাপ খাওয়াতে পারবে না। রাজধানীর এক প্রধান শিক্ষক বলেন, এক শিফটের ক্লাস চালু করতে হলে ন্যূনতম ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। তবুও তাদের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটানা ক্লাস নিতে হবে। কোন কারণে একজন শিক্ষক ছুটিতে থাকলে সেদিন সব বিষয়ের ক্লাস হবে না।
এই অবস্থায় এক শিফট চালু করতে গিয়ে বিদ্যালয় ভাগাভাগি করলে বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটের মুখে পড়বে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সব স্কুল এক শিফট করা খুব সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়। এক শিফটের স্কুলের সময় দাঁড়ায় সাত ঘণ্টা যা প্রাথমিকের শিশুদের জন্য উপযোগী তো নয়ই বরং বিরক্তিকর। এক সময় বাচ্চাদের পুষ্টিমানের বিস্কুট দেয়া হতো যা এখন আর নেই। তাহলে এতক্ষণ ছোট ছোট শিশুরা না খেয়ে কিভাবে দীর্ঘসময় বিদ্যালয়ে থাকবে সেটি একটি প্রশ্ন। তারা সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে অতিরিক্ত হলে ২টার মধ্যে যদি বাসায় আসতে পারে তাহলে দুপুরে বাসায় খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে পারে, বিকেলে খেলাধুলা করতে পারে। এটি হলে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ভালো।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে দু-একটি বিষয় কিন্তু স্পষ্ট যে, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হয়েছে অথচ জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুযায়ী বিদ্যালয় স্থাপন, শিক্ষার্থী সংখ্যা ইত্যাদি কিছুই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। শুধু শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে। এত বছরে আবিষ্কৃত হলো যে, প্রচুর সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে যার ফলে মন্ত্রণালয় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। এখানে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত মূলত নেয়ার কথা জনপ্রতিনিধিদের, সরকারি কর্মকর্তাদের নয়। এখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই নিয়েছেন এবং তারা কিন্তু কেউই শিক্ষক নন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। শিক্ষক থেকে যদি এই ধরনের পদে কেউ আসেন তাদের ক’জনের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে সেটিও একটি প্রশ্ন।
বর্তমান সচিব যেটি বলেছেন তা অত্যন্ত যৌক্তিক কথা। তিনি বলেছেন, ‘সব বিদ্যালয়ে এক শিফট একসঙ্গে হবে না, করাও যাবে না। প্রাথমিকভাবে ১২ হাজার বিদ্যালয় নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গবেষণা আছে এবং এই বার হাজারে এক শিফট করতে সমস্যা নেই। পরের ধাপে আরও কিছু বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করা হবে। কাজটি হবে ধাপে ধাপে। এটি করার কারণ হচ্ছে দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে মন্ত্রণালয় চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে সেখানে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে এটি তারা করতে নাকি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, কোন কোন বিদ্যালয়ে মাত্র ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী আছে। কোথাও আধা কিলোমিটারের মধ্যে দুটি স্কুল, কোথাও আবার ২০ গজ, ৫০ গজের মধ্যে দুটি স্কুল রয়েছে। সেখানে এত সংখ্যক শিক্ষক রাখা যৌক্তিক নয়। কোন বিদ্যালয়ে নাকি ১৭ জন পর্যন্ত শিক্ষক আছেন। আবার কোথাও তিনজন। তাই এই উদ্যোগ।’
সচিব মহোদয় অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমাদের সঠিক পরিকল্পনার ভুলের খেসারত দিতে হচেছ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। জাতীয়করণ করার সময় বিষয়গুলো সঠিকভাবে বিবেচনায় নিলে শিশুদের কষ্ট হতো না। তারা পাশের নতুন বিদ্যালয়ে গিয়ে খাপ খাওয়াতে পারবে না বা খাওয়াতে কষ্ট হবে, তারপরেও এই সিদ্ধান্তে না গিয়ে তো উপায় নেই। একটি বিদ্যালয়ে ৪/৫ শিক্ষার্থী আর সরকারি শিক্ষক থাকবেন ৫-৬ জন এটিওতো কোন যুক্তির কথা নয়। অতএব সচিব যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিষয়টি এখন আর ঘোলাটে থাকার কথা নয়।