প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। আমাকে হাই স্কুলে ভর্তি হতে হবে। বাড়ির তিন দিকে তিনটি স্কুল। দক্ষিণে নাওভাঙ্গা-জয়পুর উচ্চবিদ্যালয়, পুবে চরকালিয়া উচ্চবিদ্যালয় এবং উত্তরে এখলাসপুর উচ্চবিদ্যালয়। কিন্তু কোনোটিই কাছে নয়। তবে এলাকার স্কুল নাওভাঙ্গা-জয়পুর উচ্চবিদ্যালয়। গ্রামের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। আমাদের এলাকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চরকালিয়া উচ্চবিদ্যালয়। ওই স্কুলে গ্রামের কেউ যায় না। আর এখলাসপুর উচ্চবিদ্যালয়ও দূরে, তবে আমাদের গ্রাম জহিরাবাদের উত্তরাঞ্চলের কেউ কেউ ওই স্কুলে পড়ে।
তখন গ্রামের মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকত না। অতি সামান্য কৃষিজমির উপর ভর করে চলত অধিকাংশ মানুষের সংসার। কিন্তু ওই জমিটুকুর ফসলে সংসার চলত না। সুতরাং অন্যের জমি চাষাবাদ করা; খেতে বদলি দেওয়া বা মজুর খাটা; মাটি কাটার কাজ করা; ঘর বানানোর কাজ করা; ফলমূল, সাক-সবজি বাজারে বিক্রি করা- এ রকম জোড়াতালি দিয়ে চলত অনেকের সংসার।
আমাদের মহল্লায় কয়েকটি বাড়িতে ছিল মাছ ধরে রাখার ডুলা বানানোর কুটির শিল্পের কাজ। আমাদের বাড়িতেও কয়েকটি পরিবার বাঁশ, গুনা বা তার ও বেত দিয়ে এই ডুলা বানানোর কাজ করত। আবার কেউ কেউ বানাত ডালা, চালুন, ঠেলা জাল, পলো, চাঙ্গাড়ি এইসব। এই হতদরিদ্র মহল্লাটিতে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা কারোরই ছিল না। তবে যে বয়সে শিশুরা উপার্জনের যোগ্য হতো না সে সময় তাদের কেউ কেউ বাড়ির কাছে প্রাইমারি স্কুলে যেত। সেটাও আবার দুই থেকে তিন বছরের বেশি নয়। ওইটুকু পড়তে খরচ তেমন ছিল না বললেই চলে। এক-দুটি বই, কাঠের বা পোড়ামাটির স্লেট; কখনো কখনো খাতা, কাঠপেনসিল এবং ফাউন্টেন পেন। সবসময় যে এইসব পাঠসামগ্রি কিনতে হতো, তাও নয়। আর স্কুল তো ছিল ফ্রি। মাসে মাসে বেতন দিতে হতো না। এমন নিখরচার মধ্যেও শিশুদের স্কুলে যাওয়া নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ ছিল না। পুরুষানুক্রমে যে পেশায় তারা নিয়োজিত, সন্তানরা সে পেশায় বেঁচে থাকবে- এমনই ছিল তাদের জীবনযাপনের ধারা। শিক্ষা যে অন্যরকম একটা ব্যাপার, সবকিছু পালটে দেয়- এ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা ছিল না। তবুও প্রাথমিক শিক্ষাটা যেহেতু ঘরের কাছে এবং বিনামূল্যে সেহেতু ওই শিক্ষার কিছু তাপ শিশুদের গায়ে লাগত। কিন্তু ওর আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার আগেই তারা পূর্বপুরুষদের ধারায় ফিরে যেত।
খুব মনে পড়ে, আমাদের প্রিয় খইল্যাইজুর (খলিল ভাইজু। তার দোকান ছিল। ওই দোকানটি ছিল আমাদের স্বপ্নের যাদুঘর।) একটি ছেলে মিনহাজ সানকি ভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে খুব আলোড়ন তুলেছিল। মুখে মুখে সে বইয়ের সব অংক করে ফেলত। স্কুলের শিক্ষকগণ ওকে খুব প্রশংসা করতেন। আর আমাদের মা-বাবারা খুব খেপে গেলেন, বিশেষ করে মায়েরা। কারণ, মায়েদের শাড়ীর আঁচলের কাছেপিঠেই তখন ছিল আমাদের জগৎ। তাই মা আমাদের খুব পেয়ে যেতেন এবং বলতেন, “খইল্লার পুতে ভাত খায় আর তোর কি গু খাস? অংক পারছ না কিলিগা? যা, মিনহাজের পা ধুইয়া পানি খাইয়া আয়।” কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না যে, মা আমাদের বকেন কেন? মিনহাজ অংকে ভালো, এই দোষ তো ওর- আমরা তার কী করব? আর পড়াশুনায় ভালো-মন্দ, পাস-ফেল সম্পর্কেও আমদের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু মিনহাজকে আমরা শত্রু মনে করতাম। পরিষ্কার মনে আছে, গাছে উঠতে হবে। আমাদের বন্ধুদের সবাইকে আমরা পিছন দিক থেকে ঠেলে গাছে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মিনহাজকে ঠেলে দিইনি, ও গাছে উঠতে পারেনি।
পরে দেখেছি, পরীক্ষায় পাস-ফেল নিয়ে আমার মেয়ে সেঁজুতিরও একই রকম ধারণা ছিল। সেঁজুতি এখন বুয়েটে পড়ে। মেডিকেলেও সে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু পড়েনি। অথচ যখন সে একদম শিশু তখন তার অবস্থা কেমন ছিল! খিলগাঁওয়ের বাসাসংলগ্ন উদয় শিশু নিকেতন নামে একটি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করেছিলাম তাকে। ওটা তার প্রথম স্কুল। শিশু শ্রেণিতে সে ফেল করে খুব খুশি হয়েছিল। রেজাল্ট নিয়ে বাসায় এসে সে গদগদ হয়ে বলেছিল “আম্মু আম্মু, আমি ফেল করতে পেরেছি।” এবং এ অবস্থায় তার রোল যখন অনেক পিছিয়ে ১৪-১৫ হয়ে যায়, তখনও সে খুব খুশি হয়েছিল। কারণ ১-২ এর চেয়ে ১৪-১৫ অনেক বেশি। ১-২ এর চেয়ে ১৪-১৫ যে অনেক বেশি, তার এই বুদ্ধি হয়েছে জেনে আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম “বাহ! তাই তো, তুমি অনেক বেশি রোল নম্বর পেয়েছ।” আমার এই কন্যার মতোই শৈশবে পরীক্ষা নিয়ে আমাদের ধারণা এমনই ছিল। ভালো-মন্দ রেজাল্টের বিষয় বুঝতাম না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বছর তিনেক পরে খলিল ভাইজুর ছেলে মিনহাজ আর স্কুলে যায়নি। সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এতে আমরা যারা অংক পারতাম না তারা খুশি হয়েছিলাম কি না তা আর আজ মনে নেই।
দুই.
কিন্তু হাইস্কুল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওখানে পড়ার বয়সটা প্রথমত রোজগারের উপযোগী এবং দ্বিতীয়ত রোজগার না করে উলটো মাসে মাসে স্কুলে বেতন দিতে হয়। টাকা খরচ করে প্রচুর বইপুস্তক খাতাণ্ডকলম কিনতে হয়। আর অনেকেরই যেতে হতো বাড়ি থেকে বহু দূরের স্কুলে। বিশেষ করে বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি এ যুগের ডিটেকটিভ কাহিনিকেও হার মানাবে। কত বন্ধুর পথ, খাল-বিল, নদীনালা পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো! আলাদা তেমন কোনো রাস্তা ছিল না। বাড়ির পর বাড়ি করে করে যে গ্রাম তৈরি হয়েছে তাই ছিল রাস্তা। আবার কিছু রাস্তাও ছিল। সেই রাস্তার শ্রীছাঁদ আজকে কল্পনাও করা যাবে না। মানুষের ঘরের ভিটির পেছন দিয়ে কিংবা ভিটি বেয়ে; খড় বা টিনের চালের নিচ দিয়ে; দুই ভিটির মাঝখানের সংকীর্ণ সুরঙ্গ পার হয়ে; রান্না ঘরের ধুমায়িত বাতাস পার হয়ে; গোয়াল ঘরের পেছন দিয়ে গোবর আর চনা মাড়িয়ে; খোলা পায়খানার সামনে দিয়ে; পুকুরের পাড় দিয়ে; রোদে দেওয়া ছেড়া কাপড়ছোপড়, তেলচিটচিটে কাথা, লুঙ্গি, গামছা আর বস্তাবাস্তির ফাঁকফোকর গলিয়ে, লাউ-কুমড়ার মাচানের নিচ দিয়ে; উচিয়ে থাকা পেড়েক, কাঁটা, বাঁশ আর কঞ্চির আঘাত বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এবং কর্দমাক্ত রাস্তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভাঙা চুড়ি, কাচ, কাঁটা, বাঁশের ধারালো কঞ্চি, ইট-সুরকির কৌণিক টুকরো, ভাঙা শামুক এবং এহেন নানারকম শত্রু মোকাবেলা করে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হতো।
বর্ষাকালে নৌকায় স্কুলে যাওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু নৌকা যে সবসময় পাওয়া যেত, তা নয়। আবার ওই নৌকা যে সবসময় নিরাপদ ছিল তাও নয়। দুষ্ট ছেল-মেয়েরা হাসির খোরক তৈরি করার জন্য নৌকা দোলানো শুরু করত। এমন পরিস্থিতিতে সবাই যখন হৈহৈ রৈরৈ করে উঠত তখন কিছুতেই নৌকাডুবি থেকে বাঁচা যেত না। সে সময় একমাত্র চেষ্টা থকত, দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য বইগুলোকে বাঁচানো।
নৌকা যখন থাকত না তখন একমাত্র বিকল্প ছিল পাজোড়া। স্রোতের তোড়ে ভেঙে যাওয়া রাস্তা, সাঁকো বা পুল, বাঁধ ভেঙে যাওয়া শরুপথ পার হতে হতো নানা কায়দায়। কখনো কখনো এদিক-সেদিক তাকিয়ে লুঙ্গি বাঁচিয়ে পাড় হতে হতো আঠাঁই খাল। এক হাতে বই উচিয়ে ধরে সাঁতরিয়ে খাল-বিল পাড় হওয়ার দৃশ্য তো খুব পুরনো নয়।
অতিরিক্ত টাকা খরচ করে সীমিত পরিসরে প্রাইভেট পড়ার প্রচলন তখনো ছিল। সার্ট-প্যান্ট-জুতা পরতে না হলেও একটু ভালো ও পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয় তো ছিলই। তার জন্য টাকা খরচের সামর্থ্যরে বিষয় ছিল। আর সকালে খেয়ে বা না-খেয়ে যেতে হতো স্কুলে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। মাঝে অঞ্জুলিতে করে কলের পানি পান করা ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। স্কুলব্যাগ বহন করতে দেখিনি কাউকেই। বাড়ি থেকে নাস্তা নিয়ে আসার সামর্থ্য ও সংস্কৃতি ছিল না। তবে স্কুলের বাইরে দুই-একজন হকার বসে থাকতেন। দু-চার পয়সা খরচ করে ওদের কাছ থেকে চাল ভাজা, চিড়া বা মুড়ির মোয়া, তিলের খাজা, চিৎমিঠাই, কাচকলার ভর্তা, বরুইর ভর্তা, আমের ভর্তা, নানা রকম আচার, সাদা ও রঙিন কদমা (ওই কদমার গায়ে কদম ফুলের মতো দাগকাটা থাকত), চিনি দিয়ে তৈরি হাতি-ঘোড়ার ছাঁচে বানানো কদমা, বেলপুরি, মুরালি, নোনতা নিমকি, গুরের বাতাসা, খাগড়াই, বরফে সামান্য মিষ্টি ও রং দিয়ে তৈরি আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, চানাচুর এইসব খাবার পাওয়া যেত। সব যে একই সময় একসঙ্গে পাওয় যেত, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফেরিওয়লা ঘুরেফিরে এইসব খাবারই রাখতেন। যাদের হাতে দু-চার পয়সা থাকত তারা এইসব খাবার কিনে খেত। জাঙ্ক ফুডের নাম অমরা শুনিনি এবং ওইসব খাবারে কৃত্রিম রং, ইস্ট, ই-কোলাই, কলিফর্ম, মাইকোটক্সিন ও সালমোলিনারের মতো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ছিল কি না তা কখনোই কারো মাথায় আসেনি। আমাদের মাথায় তো নয়ই, এমনকি আমাদের শিক্ষকগণ এই নিয়ে কখনো চিন্তা করেননি।
এমন অবস্থায় প্রাইমারি পাস করার পর অধিকাংশ মেয়ে আর হাইস্কুলে যেত না। ড্রপ আউট। ছেলেদের মধ্যে যারা যেত তাদের সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। আগে যাকে মাইনর পাস বলত মানে ফাইভ পাস, সেই মাইনর পাস ডিগ্রি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো আমাদের গ্রামের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েদের। আর হাইস্কুলে যারা যেত তাদের মা-বাবার সারাক্ষণ চিন্তা থাকত প্রায় বিনা পয়সায় পড়ানো যায় কোথায়। একটু ভালো ছাত্র হলে তাকে নিয়ে আবার ছিল স্কুলগুলোর কাড়াকাড়ি।
তিন.
আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। আবার একদম খারাপও ছিলাম না। আমার বাবা আমাকে ভর্তি করে দিলেন আমাদের অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং পাঁচণ্ডছয় কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে- নাম চরকালিয়া উচ্চবিদ্যালয়। ওখানে শিক্ষকতা করতেন আমাদের পাশের গ্রাম সানকিভাঙ্গা সরদার বাড়ির এক বড় ভাই খায়ের স্যার। তিনি হয়তো বাবাকে বলেছেন যে, তার সঙ্গে যাব-আসব, কোনো অসুবিধা হবে না এবং এমনও আশ্বাস দিয়ে থাকতে পারেন যে, ওই স্কুলে আমি ফুল ফ্রি পড়াশোনা করতে পারব। কারণ, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমাদের পরিবারের খুব পরিচিত বিভূতিভূষণ স্যার। এসবের কিছুই আমি জানি না এবং কখনো জানতে পারিনি।
(পরের সংখ্যায় সমাপ্য)