প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
প্রত্যেক মানুষের নিজেকে জানা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি আগে নিজেকে জানতে পারবে সে-ই পারবে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে, আশপাশের মানুষ সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে। আর তখনই সে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে কিছু করতে পারবে। যে ব্যক্তি নিজেকেই ঠিক করে জানে না সে কী করে পারবে দেশ ও জনগণের সেবা করতে। তাই দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে কিছু করতে হলে আগে জানতে হবে নিজেকে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে-নিজেকে আমরা জানবো কীভাবে? নিজেকে জানার প্রকৃত উপায় কী? আমি কে, কীভাবে এই পৃথিবীতে এসেছি, আমাদের এই জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে ইত্যাদি সম্পর্কে জানা আমাদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে বলছি, কেননা আমরা নিজেকে যেভাবে জানি তার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের বাস্তবজীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিই। আমরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিজ্ঞানী, কেউ পরিসংখ্যানবিদ কেউ-বা আবার অর্থনীতিবিদ হতে চাই। মানুষের এ লক্ষ্যগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে কতটা কাজে লাগবে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও আমাদের লক্ষ্য কী হবে আমরা যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে একটা বিচারমূলক সিদ্ধান্ত নিতে চাই, তাহলে আমাদের উচিত দর্শন বিষয়টি নিয়ে পড়া। তাছাড়া একজন যুক্তিবাদী, নান্দনিক এবং নৈতিক মানুষ হওয়ার জন্যেও আমাদের এ শাস্ত্রটি পড়া আবশ্যক বলে আমার মনে হয়।
দর্শন বিষয়টির নাম শুনলে অনেকে প্রথমেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে। অনেকের ভাবনা-এই বিষয়টি পড়ে একজন মানুষ জীবনে কিছুই করতে পারে না বা পারবে না। মানুষের জীবনে দর্শনের কোনো মূল্যই নেই। এই ধরনের মন্তব্য যারা করে থাকেন, তাদের আসলে দর্শন বিষয়টি নিয়ে মূলত বাস্তব এবং গ্রহণযোগ্য কোনো ধারণাই নেই। তারা এসব বলে থাকেন তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও অজ্ঞতার কারণে। অনেকে আবার দর্শন বিষয়টির নাম শুনলেই শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়েন। প্রকৃতপক্ষে দর্শনশাস্ত্র পাঠের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন। দর্শন পাঠের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা ও যুক্তি বিশ্লেষণ করে উত্তম সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে। যা ওই শিক্ষার্থীকে সামগ্রিক জীবনে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ¯œাতকের বিষয় হিসেবে দর্শন বিষয়টি নিয়ে পড়তে পারেন। অন্যান্য বিষয়ের মতো দর্শনের ভবিষ্যতও চমৎকার। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অন্য যে কোনো বিষয়ের সমান কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি উজ্জ্বল। সমান বলার কারণ, যারা দর্শন পড়ে তারা সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ভালো করে আসছে। আর বেশি বলছি এ কারণে যে, একজন মানুষকে পরিপূর্ণ একজন মানুষ ও ব্যক্তি হয়ে উঠতে হলে তাকে আশপাশের সমণ্ডসাময়িক ঘটনাবলির মধ্যে যে সংযোগ তা ধরতে হবে, বুঝতে হবে এবং শিখতে হবে। আর এজন্যে চাই একটি দার্শনিক মন বা চিন্তাশীল মন। দার্শনিক মন না থাকলে একজন ব্যক্তি পারিপার্শ্বিক এই ঘটনাগুলো উপলব্ধি করতে পারবে না। দর্শন হচ্ছে মূলত, আমাদের ব্যক্তি মানুষের সর্বমুখী অভিজ্ঞতার এক অনবদ্য ফসল, সমালোচনা ও তা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।
হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বের নামীদামী বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলে দেখতে পাওয়া যায় সেখানে রয়েছে ‘ব্যবহারিক দর্শন’, ‘দর্শন ও ব্যবসা’, ‘দর্শন ও কম্পিউটার প্রকৌশল’-এর মতো আরও অনেক বিষয়। তাই যে যতো বেশি ভাবনার গভীরে যেতে পারে সে ততো বেশি বিজনেস এক্সিকিউটিভ বা পরামর্শক, সফল উদ্যাগক্তা, দক্ষ প্রশাসক এবং অনেক বড় কম্পিউটার বিজ্ঞানী হতে পারে। আর এ সকল অবস্থায় নিজেকে মেলে ধরার জন্যে প্রয়োজনীয় ক্রিটিক্যাল মাইন্ডের শিক্ষা অর্জন করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয় একমাত্র দর্শন বিভাগেই।
দর্শনে ¯œাতক সম্পন্ন করা একজন ব্যক্তি ভালো ও দক্ষ প্রশাসক হতে পারে। সাথে হতে পারে ভালো সম্পাদক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেখানে জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হয় সেখানেও ভালো করতে পারেন। চাকরির বাজারের ক্ষেত্রে এখন এমন শিক্ষার প্রয়োজন যা ব্যবহারিক। আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ’। তাই প্রত্যেক মানুষের মাঝে এই কল্পনার জ্ঞান থাকা অতীব জরুরি। কল্পনা বিষয়ে এমন জ্ঞান লাভ করা যায় দর্শন পাঠের মাধ্যমে। তাই প্রত্যেক মানুষের দর্শন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক।
এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে বসে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করে আর কী কী হওয়া যায়? তাহলে সহজে বলা যায়-
এক. একজন সংশয়বাদী হওয়া যায়। যে যুক্তিতর্ক ব্যতীত কোনো কিছুর উপর অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না।
দুই. বুদ্ধিভিত্তিক আড্ডার মধ্যমণি হওয়া যায়। যেখানে বিশ্লেষণ শুনিয়ে শ্রোতাকে মুগ্ধ করা যায়।
তিন. নীতিবর্জিত না হলে সকলের কাছে আমৃত্যু সম্মান ও ভালোবাসার মানুষ হয়ে থাকা যায়। তাই দর্শনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের উচিত সৃষ্টিশীল, চিন্তাশীল, নান্দনিক, নৈতিক বুদ্ধিভিত্তিক মানুষ হওয়ার জন্যে দর্শনের বইগুলো পড়া। দার্শনিকদের চিন্তা-ভাবনাকে জানা। জীবনে ভালো কিছু করতে চাইলে, নিজেকে জানতে চাইলে, মূল্যবোধ অর্জন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্যে প্রত্যেক মানুষের দর্শনের সাথে সংশ্লিষ্ট যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, নন্দনতত্ত্ব, জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা, মূল্যবিদ্যা, ধর্মদর্শন, মনোদর্শন ইত্যাদি বিষয় পাঠ করা উচিত। এতে করে একজন মানুষ পরিশীলিত, নৈতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন যুক্তিবাদী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। যা অন্য অপরাপর মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা করে দিবে খুব সহজে। তাই যারা ¯œাতকে দর্শন নিয়ে পড়তে চান, নির্ভাবনায় কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে পড়ার বিষয় হিসেবে নিয়ে নিতে পারেন এ বিষয়টি। এ বিষয়টি সত্যিই চমৎকার এবং জ্ঞানের সাগরে নিজেকে নিয়ে নিজের মনের কৌতুহল, নানা জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে পারেন। সাথে নিজেকে করে তুলতে পারেন সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটলের যোগ্য উত্তরসূরি, যারা জ্ঞানের জগতে এক অনবদ্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন আর সময় থেকে সময় ধরে জ্বালিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানের উজ্জ্বল মশাল।
আফসানা আক্তার আমেনা : অনার্স ১ম বর্ষ,
সেশন : ২০২০-২০২১, দর্শন বিভাগ,
চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।