প্রকাশ : ৩১ মে ২০২২, ০০:০০
সকাল থেকেই মনটা আনন্দে ভরপুর। ক্যাম্পাসের প্রথম দিন বলে কথা। এই দিনটির জন্য অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছি। যদিও করোনার প্রকোপের জন্য আমরা প্রায় এক মাসের মতো অনলাইনে ক্লাস করেছি। কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস করতে আমার বেশি একটা ভালো লাগেনি। যা হোক, আমাদের ক্লাসের সময় নির্ধারণ করা হলো সকাল ৯.৪৫ মিনিট। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ক্লাস শুরুর আধঘণ্টা আগে ক্লাসে হাজির থাকা আমার একটি নিয়মিত অভ্যাস। তাই বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম। আমার বাসা থেকে ক্যাম্পাস বেশি দূরে নয়, বলতে গেলে পায়ে হেঁটে ২৫ মিনিটের পথ। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় সকলেই পা রাখে নতুন এক ঠিকানায়। ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে এগুতে থাকে। কারণ জীবন গড়ার মূখ্য অধ্যায় হলো উচ্চ শিক্ষা। অনার্সে ভর্তির আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রীর অনেকটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো পাড়ি দিতে হয়। এ যুদ্ধ ক্ষেত্রে জয়ী হয়ে নিজের লক্ষে পৌঁছানো ও শত-শত ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরা, খুব কম ছাত্র-ছাত্রীর ভাগ্যেই জোটে। ক্যম্পাসের প্রথম দিনটার আনন্দ আকাশ ছোঁয়া। আমার জন্যও তেমনটাই ছিলো। যদিও ক্যাম্পাসে ভর্তি হওয়ার আগে অনেকবার এখানে আসা হয়েছিল। কিন্তু তা শুধু ঘুরতে আর খেলতে। খেলার জন্য এক অসাধারণ জায়গা হলো আমাদের ক্যম্পাসের মাঠটি। সহপাঠীদের সাথে মাঝে মাঝে খেলতে আসা হতো। ছোট-বড় গাছপালা দিয়ে সাজানো পাঁচটি ভবন, একটি মসজিদ, একটি পুকুর ও একটি বিশাল বড় খেলার মাঠ নিয়ে আমাদের চাঁদপুর সরকারি কলেজের অবস্থান, চাঁদপুর শহরের ঠিক মাঝে বললেই চলে। ক্যাম্পাসের গেইট দিয়ে প্রবেশ করার পর মনে হলো, চেনাজানা সেই পাঁচটি ভবন আর উঁচু গাছগুলো যেন আমাকে ডেকে বলছে, ‘অবশেষে তুমি আমার কাছেই এলে! আজ থেকে তুমি এই ক্যাম্পাস এরই একটা অংশ’। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে নবীনদের আগমনে যেন এক আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করেছিল। ভবন-১-এর তৃতীয় তলায় আমাদের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগটি। এই ভবনটিকে পুরাতন ভবনও ডাকা হয়। ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিকে রয়েছে যথাক্রমে ভবন-২ ও ভবন-৩ এবং পূর্বদিকে রয়েছে পুকুর। আগে প্রশাসনিক কার্যক্রম চলতো পুরাতন ভবনে। আর এখন ওই জায়গায়টির নাম হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগটি অসংখ্য গুল্ম আকৃতির গাছপালা দিয়ে সাজানো। আমার মনে হলো, ‘পুরো কলেজের সব থেকে সুন্দরতম বিভাগ এটি’। আর গাছগুলো যেন আমায় স্বাগতম জানাচ্ছে। বিভাগে যাওয়ার পর অফিস সহায়ক-এর কাছ থেকে জানতে পারলাম, কিছু সমস্যার কারণে কিছুদিন বিভাগে ক্লাস হবে না। দ্বিতীয় তলায় ২০৬ নম্বর রুমে ক্লাস হবে। অফিস সহায়ক আমাদের ক্যাম্পাসেরই ছাত্র। পড়ালেখার পাশাপাশি উনি বিভাগেও কাজ করেন। যা হোক, ক্লাসে যাওয়ার পর দেখলাম অনেকেই আমার আগে ক্লাসে চলে আসছে। নবীনরা প্রথমদিন ক্লাসে একটু তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করে, যদিও এই ইচ্ছাটা সবার ভেতরে থাকে না। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষগুলো অনেকটা আপন করে কাছে নেয়, যদিওবা অনেকেই সেদিন অপরিচিত। অনেকের সাথেই অনলাইনে কথা হয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবে চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছিল, কারণ করোনার প্রকোপের জন্য সবাই মাস্ক পরা ছিলো। তারপরও নতুন কয়েকজন এর সাথে পরিচয় হলো। আর অফিস সহায়ক আমাদের আপ্যায়নের জন্য কাজ করেই যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর শিক্ষকগণ এলেন। ভর্তির সময় কলেজে আসা ও অনলাইনে ক্লাস করার জন্য মোটামুটি সবাইকেই আমার চেনা। বিভাগীয় প্রধান হিসাবে আছেন মোঃ ইকবাল হোসেন খান স্যার, সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছেন মোহাম্মদ কামরুল হাছান স্যার। তিনি আগে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এবং আরেকটি মজার ব্যাপার হলো মোহাম্মদ কামরুল হাছান স্যার এই বিভাগেরই ছাত্র ছিলেন। কথাটি শোনার পর নিজের ভেতর কিছুটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিলো। প্রভাষক হিসেবে আছেন মহসীন আরাফাত স্যার ও শেখ সাদী স্যার। প্রদর্শক হিসেবে রয়েছেন মোহাম্মদ জাকির হোসেন খান স্যার। করোনার প্রকোপের জন্য সবাই নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করছিলো, এমনকি আমরাও। ডিপার্টমেন্ট প্রধান থেকে শুরু করে সব শিক্ষকগণ তাঁদের নিজ নিজ পরিচয় তুলে ধরেন, নিজ নিজ অভিজ্ঞতা নতুনদের সাথে শেয়ার করেন এবং করোনার সর্তকবার্তাও।
সেদিনের শিক্ষকগণের প্রত্যেকটা কথা আজও আমায় অনুপ্রাণিত করে। সবার প্রথমে বক্তব্য রাখলেন মোহাম্মদ কামরুল হাছান স্যার। ওই দিন তাঁর একটি জরুরি কাজ ছিলো, তাই নবীনবরণ অনুষ্ঠানের পুরো সময় থাকতে পারেননি। আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি যেভাবে হওয়ার কথা- করোনার প্রকোপের কারণে ওইভাবে হয়নি, শুধু ক্লাস চলাকালে কিছু সময় নিয়ে স্যাররা আমাদের স্বাগতম জানালেন। সবার শেষে কথা বললেন মহসীন আরাফাত স্যার। ওইদিন স্যারের শৈবালবিদ্যার প্রথম ক্লাস ছিলো। এবং ২য় ক্লাস ছিলো ইকবাল স্যারের অণুজীববিজ্ঞান। পরিস্থিতি প্রতিকুলে থাকার কারণে আমাদের সপ্তাহে তিনদিন, দুটি করে ক্লাস হবে। ১১.৪৫ মিনিটের সময় আমাদের ছুটি হলো। কখন যে সময়টা চলে গেলো, বুঝতেই পারলাম না। পুরো সময়টা আমার আনন্দের সাথেই কাটলো। দেশে পরিস্থিতি ভালো থাকলে হয়তো সময়টা আরো ভালোভাবে কাটতো। এমন একটি দিনে সবার সাথে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করতে আমার মোটেও ভালো লাগেনি।
আমার জীবনের সেরা দিনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। মানুষের কিছু স্মৃতি থাকে স্মরণীয়। যা মুছে যাবার নয়। তেমনি আমার একটি স্মৃতি হলো ক্যাম্পাসের প্রথমদিনের স্মৃতি। ক্যাম্পাসের সাথে সম্পর্কের সূত্রপাত এই দিনেই। সব মিলিয়েই প্রথম দিনটা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুশফিকুর রহমান ভূঁইয়া ইফতি : শিক্ষার্থী,
অনার্স শিক্ষাবর্ষ ২০২০-২১।