সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২২, ০০:০০

শিক্ষকদের জন্য টিএমটিই কোর্স
মাছুম বিল্লাহ

বিশাল বহরের প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার আমাদের। এই বৃহৎ পরিবারে শিক্ষক নিয়োগ, তাদের পদায়ন, বেতন-ভাতা, অবসরগ্রহণ ইত্যাদি জাতীয় অফিসিয়াল কাজকর্মেই পুরো প্রশাসন ব্যস্ত থাকে। তাই শিক্ষাদান বিষয়ে তদারকি করা ও শিক্ষার মান নিয়ে কাজ করার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয় না।

২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯০২টি (আবার কোথাও দেখেছি ৬৫ হাজার ৬৫০)। ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অবশ্য ২০২০ সালে প্রাকপ্রাথমিক পর্যায়ে ২৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালে ৩২ হাজার সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নেয়া হয়। ২০১৭ সালের তথ্যানুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৯ লাখ ১৯ হাজার ২০১ জন।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকার ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। তবে বিগত এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথচ এখন সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে।

এমনকি সরকারি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বছরে ৪০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান তদারকির জন্যে প্রাাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে কয়েকজন কর্মকর্তা না কি আছেন, তবে তাদের দৃশ্যমান কোনো কর্মকা- আমরা খুব একটা প্রত্যক্ষ করছি না। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের সবাই সবেতনে পিটিআই প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়াও নিয়মিত বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করে থাকেন। এগুলো সবই প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু আমরা শিক্ষার মানের জায়গাটিতে প্রশংসা করতে পারছি না।

এই হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে পিইডিপি-৪ প্রোগ্রামের অধীনে। এর সাথে ব্রিটিশ কাউন্সিলকে প্রাথমিক শিক্ষকদের ইংরেজি প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয় যেটি বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩ কোটি টাকার সমপরিমাণ।

২০১৯ সালে সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইন্টারভেনশন হিসেবে টিএমটিই (ট্রেনিং অব মাস্টার ট্রেইনার্স ইন ইংলিশ) অনুমোদন দেয়। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষকদের ৪৭ কোটি ব্যয়ে এই প্রকল্পটি পরিচালনার কথা বলা হয়। এটি ১৩ সপ্তাহব্যাপী ইংরেজি প্রশিক্ষণ। দেশের ১৫টি পিটিআইতে ২০০০ প্রাথমিক শিক্ষককে ইংরেজি মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে তৈরি করা হবে, যারা ইংরেজিতে দক্ষ হবেন এবং ফলপ্রসূ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকবে। প্রাথমিক পর্যায়ে সেভাবে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। তবে মোটামুটি ১৩০০০০ প্রাথমিক শিক্ষক ইংরেজি পড়িয়ে থাকেন।

মাস্টার ট্রেইনারগণ ইংরেজি শিক্ষকদের ইংরেজির চারটি দক্ষতা (লিসেনিং, স্পিকিং, রিডিং, রাইটিংসহ) বৃদ্ধির জন্য কাজ করবেন। এছাড়াও তাদের উপস্থাপন দক্ষতা, ফলপ্রসূভাবে ভাষার ক্লাস পরিচালনা করা এবং পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার বিষয়ে কাজ করবেন। আমরা জানি ইংরেজি এখন শুধু একটি ভাষা নয়। এটি বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, সম্পর্ক স্থাপন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার। এই ভাষায় আমরা পিছিয়ে আছি। আর এর প্রথম দুর্বলতাই শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে, সেই দুর্বলতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করে যায় কিন্তু ভাষার ভীত আরে গড়ে উঠে না।

অনেকে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বা পরিবেশের কারণে পরবর্তী সময়ে এই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেটি হচ্ছে না। তাই বিদেশে গিয়েও অন্যান্য দেশের গ্রাজুয়েটদের কাছে হেরে যেতে হয়। এর প্রধান কারণ ইংরেজি আমরা পড়াই একটি বিষয় হিসেবে, এটিতে দক্ষতা অর্জন করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কাজে লাগানোর জন্য নয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের এই ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং তাদের মাধ্যমে অন্যান্য শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটি একটি চমৎকার উদ্যোগ।

বিভিন্ন দলে ভাগ করে কমবেশি দুই হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের ইংরেজি ভাষা বিষয়ক দক্ষতা ও শিক্ষা প্রদানের বিষয়ে উন্নতি করার লক্ষ্যে বিস্তৃত পরিসরের প্রকল্প হলো টিএমটিআই (ট্রেনিং অব মাস্টার ট্রেইনার্স ইন ইংলিশ)। এর প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে ১৭ জুন ২০২১। তারা শুরু করেছিলেন ৩১ জানুয়ারি ২০২১। এটি মূলত ১৪ সপ্তাহের জন্য গাজীপুর ও ঢাকার দুটো পিটিআইতে শুরু হয় কেউ কেউ এটি ২০২০ সালের নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বরে শুরু করেন যখন ছোট একটি দল অনলাইনে লার্নিং ম্যাটেরিয়ালস্ ট্রায়ালিং করেন; কিন্তু করোনার কারণে তারা পিটিআই ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। তবে প্রশিক্ষকগণ অনলাইনে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। প্রতি সপ্তাহে সেখানে সেলফ-স্টাডি, প্রাকটিস, লাইভ ওয়েবনারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হয়।

দ্বিতীয় ধাপে ব্রিটিশ কাউন্সিল ৬ জেলায় ২২০ জন প্রাথমিক শিক্ষকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। যারা নিজস্ব এলাকার স্কুলগুলোতে উন্নত ও গুণগতমানের ইংরেজি শিক্ষা দিতে পারবে। দ্বিতীয় গ্রুপের শিক্ষকগণ ১৪ সপ্তাহের পেশাদার দক্ষতা অর্জনের পথচলা শুরু করেছিলেন ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর এবং শেষ হয়েছে ২৭ জানুয়ারি ২০২২।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজি ও শিক্ষা পরিচালক ডেভিড আর মেনার্ড বলেন, ‘এটি আমাদের সবার জন্য একটি কঠিন যাত্রা ছিল; কিন্তু আমি নিশ্চিত যে প্রশিক্ষণটি অনুপ্রেরণাময়, আনন্দদায়ক এবং কার্যকরী ছিল-এ ব্যাপারে আপনারা সবাই একমত হবেন। আপনারা যখন আপনাদের স্কুলে ফিরে যাবেন এবং তরুন শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করবেন, তখন আপনি এই প্রশিক্ষণটিকে কার্যকর করতে এবং মানসম্পন্ন ইংরেজি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে অন্য শিক্ষকদের সহায়তা করতে পারবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সবার জন্য ইংরেজির মান উন্নত করাই এ প্রোগ্রামের মুখ্য উদ্দেশ্য।’

বর্তমানে তৃতীয় ব্যাচ চলছে এবং আমি ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। তাদের মধ্যে নতুন এক উদ্দীপনা কাজ করছে, যা নিশ্চয়ই ভালো লাগার একটি বিষয়।

টিএমটিই প্রজেক্টের ইংরেজি ভাষার দক্ষতা মূল্যায়নের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রাক-প্রশিক্ষণ ভাষা মূল্যায়ণ রূপে তিন হাজারের বেশি ‘অ্যাপটিস টেস্ট’ পরিচালনা করে। ‘অ্যাপটিস’ হচ্ছে আধুনিক ও নমনীয় ইংরেজি ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা। এটি তৈরি করা হয়েছে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংস্থা কিংবা ব্যক্তির বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভাষাবিদগণ এটি উদ্ভাবন করেন। মূল্যায়ণের সর্বশেষ গবেষণার ফল এটি। কোন ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য একটি ফল এবং মাইলফলক। এ টেস্টে গ্রামার এবং ভোকাবিউলারী অংশের পরীক্ষা হয় -২৫ মিনিট, স্পিকিং-১২ মিনিট, লেখা-৫০ মিনিট, পড়া-৩৫মিনিট এবং শ্রবণ-৪০মিনিট। তবে, এর হেরফের আছে টেস্ট বুঝে। যেমন- অ্যাপটিস টেস্ট অ্যাডভান্সড, অ্যাপটিস ফর টিচার্স কিংবা অ্যাপটিস ১৩-১৯বয়সীদের জন্য।

প্রাথমিক অবস্থায় সরাসরি পরীক্ষাগুলো হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কভিড-১৯এর কারণে পরীক্ষাগুলো অনলাইনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ পরীক্ষায় ৯৪ শতাংশের বেশি প্রশিক্ষাণার্থীরা ইউরোপিয়ান ফ্রেমওয়ার্কের ‘এ-২’ কিংবা তারও ওপর যোগ্যতা অর্জন করেছেন।এটিও একটি আনন্দের সংবাদ।একজন প্রশিক্ষনার্থী যথার্থই বলেছেন, এই প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আমরা জেনেছি বইয়ের একটি পাঠকে যায় শিক্ষার্থীদের জন্য কিভাবে সহজ ও আনন্দদায়ক করা যায়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে এবং শিক্ষাদানের চমৎকার পরিবেশ কিভাবে সৃষ্টি করতে হয় সেটিও জেনেছি। আমরা এর অংশীদার হতে পেরে গর্বিত।’

ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক মিসিইওসসিয়া বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে আরও বহু প্রাথমিক শিক্ষক এই প্রশিক্ষন সমাপ্ত করবেন যা তাদের শিক্ষার্থীদের ওপর এক ধরনের ধনাত্মক প্রভাব ফেলবে, তারা তাদের ইংরেজি ভাষার উন্নয়ন ঘটাবে যেহেতু প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে পদার্পন করবে সেই বিষয়টি তাদের খুব কাজে লাগবে। উন্নতমানে ইংরেজি পড়ানোর বিষয় বিশ্চয়ই বাংলাদেশের ভবিষ্যত বংশধরদের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনেক সুফল বয়ে আনবে।’

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার বড় অংশটিই পরিচালিত হয় রাষ্ট্রের সরাসরি তত্ত্বাবধানে, এর বাইরেও কিন্তু বিশাল একটি অংশ রয়েছে (কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি প্রাইমারি)। এখানকার শিক্ষকদের জন্যও টিএমটিই-র অনুরূপ কোনো প্রশিক্ষন প্রয়োজন।

ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব) বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারে। এটি অনলাইন কিংবা অফলাইনে করা যেতে পারে, অথবা ব্লেন্ডেড লার্নিং মোডেও করা যাবে। বেসরকারি প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়