রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩, ০০:০০

চতুরঙ্গ সাংস্কৃতিক সংগঠনের ৪০ বছর পূর্তি
গোলাম মোস্তফা ॥

বাংলাদেশের মধ্যে মফস্বল শহরে জন্ম নেয়া কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন ৪০ বছর পূর্তি করে গৌরব ও ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকার বিরল রেকর্ড অর্জন করেছে চাঁদপুরের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন চতুরঙ্গ সাংস্কৃতিক সংগঠন। শুধু টিকে থাকার লড়াই নয়, সংগঠনটি এখন মফস্বল থেকে জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত কুড়িয়েছে ব্যাপক সুনাম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি ধরে রেখেছে সংগঠনটির অতীত ঐতিহ্য ও সুনাম। দেশের ইতিহাসের পাতায় নাম লেখিয়েছে এ সংগঠনটি জাতীয় মাছ বা মাছের রাজা ইলিশ উৎসবের আয়োজন করে।

ইলিশ ধীরে ধীরে যখন হারিয়ে যাচ্ছে, তখন এই সংগঠনটির ব্যানারে দীর্ঘ ১৪ বছর যাবত করা হচ্ছে ইলিশ উৎসব। সময়ের প্রয়োজনে যেটিকে জাতীয় উৎসব করার দাবি করা হচ্ছে। এই উৎসবের প্রথম থেকে অদ্যাবধি একজন ব্যক্তিই আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি হলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক রোটাঃ কাজী শাহাদাত পিএইচএফ। সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন চেয়ারম্যান অ্যাডঃ বিনয় ভূষণ মজুমদার (প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ) আর মহাসচিব (ইলিশ উৎসবের রূপকার হিসেবে খ্যাত) হারুন আল রশীদ।

৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘সংস্কৃতি অঙ্গনে’ চতুরঙ্গের জন্ম ইতিহাস তুলে ধরেছেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব হারুন আল রশীদ। তাঁর জবানিতে সে ইতিহাস নিম্নরূপ :-

যেভাবে চতুরঙ্গের পথচলা

বয়সটা ছিলো তরুণ। দেখতে খারাপ ছিলাম না। বন্ধুরাও ছিলো এই শহরে বেশ পরিচিত। বিভিন্ন কারণে সবাই আমাদেরকে চিনতো। অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ছিলাম আমি। শুরুতেই খেলাঘর, ’৭৯ সালে বর্ণচোরা নাট্যগোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিলাম। ভালোবাসার কারণে কত যে মাতৃপীঠ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম তাহমিনার জন্যে। কতবার যে আবু আপা ও আর নূর খান স্যারের ধমক শুনেছি। কত যে তারা বেত নিয়ে গেটের সামনে তেড়ে এসেছেন, সেটা অনেক বড় গল্প। আপাতত থাক।

১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর বিয়ের পর শ্বশুরের দেয়া অপহরণ মামলা হতে পরিত্রাণ পেয়ে নিজ বাসায় অবস্থান করে আসছিলাম। একদিন অজয় দার ডাকে তাহমিনাকে নিয়ে শিল্পকলায় সরকারি অনুষ্ঠানের গানের মহড়ায় যাই। গোলাম মোস্তফা রতন, গোলাম রসূল হীরন, তাহমিনা হারুন, হেনা এক্সপ্রেসের মালিক আমজাদ হোসেন সাহেবের মেয়ে শারমীন হোসেন সকলেই ওই সময়ে চাঁদপুরের উল্লেখ করার মতো শিল্পী। তারপরও ওরা ছিলো অবহেলিত। একক গানের সুযোগ না পাওয়া, কোরাসে সামনের সারিতে না রাখা, পেছনের সারিতেও তাদের মুখের সামনে মাইক না দেয়া। সাম্প্রদায়িক কারণে ওই সময় কতিপয় মানুষ (সবাই না)-এর ধর্মীয় বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দেখে আমি কিছুটা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হই। সেই থেকে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন খোলার ইচ্ছা আমাদের ক’জন বন্ধুর মাঝে ভীষণভাবে তাগিদ দেয়।

১৯৮৩ সালের ১৫ মে অজিত মজুমদার, উত্তম রায় বাবু, কে. এম. শওকত, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, বেলাল ভূঁইয়া, পুরাণবাজার দাসপাড়ার নির্মল দাস, রতন ধর, তাপস মুখার্জীসহ আরো কয়েকজন মিলিত হলাম। সেই সময় চতুরঙ্গের মৌলিক অর্থ না বুঝেই নাম দিয়েছিলাম। জাতীয় পত্রিকা ইত্তেফাকে চতুরঙ্গ নামে একটি পৃষ্ঠা কয়েকদিন পর পর বের হতো। ওই থেকেই মূলত চতুরঙ্গ নাম দেয়া। যা সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একটি অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে এবং চলমান থাকবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।

১ম অভিষেক অনুষ্ঠান

চাঁদপুর শহরের চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের সম্মুখস্থ কেজি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুরঙ্গের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। অভিষেক অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারিত হয় টাউন হলে। দাওয়াত কার্ডে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেখা থাকলেও সে সময় কোনো শিল্পী আমাদের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে গান না গাওয়ার বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। তাহমিনার অনুপ্রেরণায় আমরাই মুখার্জী কোয়ার্টারে পূর্ণিমা হোটেলে মহড়া শুরু করে দেই। আমাদের উৎসাহ দেন এবং আমাদের প্রথম অনুষ্ঠানে গান করেন ওই সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী ‘কম্পন’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আইয়ুব খান (বর্তমানে মরহুম) ও দেবাশীষ কর মধু। যুক্ত হন সাহা বাড়ির ডলি সাহা, অসীমা সাহা ও অঞ্জনা আইচ। চতুরঙ্গের শিল্পীরা পুরো শহরে বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে জেলার প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা অনুষ্ঠান করতাম। সেই সময়ে ‘কম্পনে’ কিছুটা ভাটা পড়ায় উক্ত প্রতিষ্ঠানের কিছু বাদ্যযন্ত্রাদি কম্পন-এর সভাপতি মরহুম অ্যাডঃ হযরত আলী (জোড়পুকুর পাড়ে বাসা) আমাদের উপদেষ্টা হওয়ার সুবাদে দিয়ে দেন। পুরানো ড্রামসেট, কঙ্গো, বঙ্গ, জিপসী আমাদের হাতে তুলে দেন। এতে চতুরঙ্গের সাংস্কৃতিক পথচলা আরো বেগবান হয়। ২ বছর পর কোড়ালিয়া রোডের একতা ক্লাবের কর্মকর্তা ইঞ্জিঃ শওকত আখন্দ আলমগীর, মঞ্জুর আলম মনা ও মাসুদুর রহমান শিপু তালুকদার (বর্তমানে মরহুম) যুক্ত হন চতুরঙ্গে। ‘মনা মামা’ এক সময় চতুরঙ্গের জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। শিপু তালুকদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোরাস গান গাইতো ও জিপসী বাজাতো। এভাবেই চলতে থাকে চতুরঙ্গ। ১৯৮৬ সালের পর কমরেড অজিত সাহা, তার সহধর্মিণী কৃষ্ণা সাহার সংগঠন বিবর্তন শিল্পী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। আমাদের অনুপ্রেরণায় অজিত দা, মেজদি (কৃষ্ণাদি), তার ছোট বোন কণ্ঠশিল্পী প্রয়াত রীনা চক্রবর্তী তাদের পরিবারের সাথী সাহা, লাকী সাহা, ঝিরি সাহা, মিছিল সাহাসহ সকলেই চতুরঙ্গের পরিবারভুক্ত হয়ে যান।

১ম সভাপতি আমার বন্ধু জাসদ ছাত্রলীগের নেতা কে. এম. শওকত। এর পরই আসে ওই সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, জনপ্রিয় উপস্থাপক, অভিনেতা মাহাবুব আনোয়ার বাবলু। তাঁর সক্রিয়তা সংগঠনকে আরো জনপ্রিয় ও গতিশীল করে তোলে। আমার এই লেখায় আজ একজন আলোকিত মানুষের কথা বলবো, তাঁর বড় ভাই কাজী নজরুল ইসলাম এক সময়ে আমার ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলো। সংস্কৃতিমনা সেই কাজী নজরুল গানও করতো আমাদের সাথে। তাঁরই ভাই কাজী শাহাদাত নির্ঝর সাহিত্য সংগঠন করে অল্প সময়ে চাঁদপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে বেশ পরিচিত হতে শুরু করলেন। ১৯৮৬-এর শিল্পকলা একাডেমীর পক্ষকালব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবের স্মরণিকার সকল বাণী লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতিভার প্রতি সম্মান জানিয়ে ওই সময়ের শিল্পকলা একাডেমীর সম্পাদক অজয়দার খুব স্নেহভাজন হয়ে গেলেন কাজী শাহাদাত। একটা কথা আমি বলবো, সাহিত্য একাডেমী প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রতিটি ইট-বালুর সাথে কাজী শাহাদাতের স্মৃতি জড়িত। অধ্যাপক কবি খুরশেদুল ইসলাম স্যার সেই সময়ে কাজী শাহাদাতের মত শিষ্য পাওয়ার সুবাদেই আজকের এই সাহিত্য একাডেমীর এই ভবন। সাহিত্য একাডেমীর সেই সময়ের ষড়যন্ত্রের কথা বাদই দিলাম। তারপরও কিছুটা বলতে হয়, তুষের আগুন হঠাৎ করে নিভে যায় না, তা আস্তে আস্তে জ্বলতেই থাকে। প্রতিভা চাপা পড়ে না, বিস্ফোরণ ঘটায়। কাজী শাহাদাতের আজকের অবস্থানে সেটাই প্রমাণ করে। পর্যায়ক্রমে আরেকজন মানুষ আমাদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি চতুরঙ্গের সভাপতির দায়িত্ব নেন। জনপ্রিয় রেডিও, টিভি উপস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম খান। চতুরঙ্গ তাঁর কাছে এবং তাঁর সহধর্মিণী শরিফা সুলতানা মিতু ভাবীর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। আরেকজন মানুষ প্রতিষ্ঠার পর হতে কখনো উপদেষ্টা, কখনো চেয়ারম্যান হিসেবে এখন পর্যন্ত আমাদের সাথে আছেন। তাঁর শ্রম, সেবা, বুদ্ধি, চিন্তা, সহযোগিতা চতুরঙ্গকে আগের চেয়ে আরো গতিশীল করেছে। তিনি আমাদের অ্যাডঃ বিনয় ভূষণ মজুমদার। অসুস্থতা নিয়ে এখনও আমাদের মাঝে আছেন, আমরা তাঁর সুস্থতা কামনা করছি।

১৯৮৬ সালে আমার আরেক বন্ধু, চতুরঙ্গ করতে এসে যার সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক হয়ে উঠে, নিজাম উদ্দিন আহমেদণ্ডএর সম্পাদনায় বিজয় দিবসে ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বেগম মসজিদের নিকটস্থ কামাল প্রিন্টার্স হতে বের করি। ওই প্রকাশনার কারণে আমরা কাজী শাহাদাতের খুব কাছে চলে আসি। কামাল প্রিন্টার্সের মালিক ছিলেন আলী আকবর ভাই। হাসিমাখা কালো সেই মানুষটাকে অনেকদিন দেখিনি। আছে কি নাই সেটাও জানি না। ওই মানুষটির প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতা রইলো।

চতুরঙ্গের প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নের অনেকেই আজ নেই। চতুরঙ্গের শুরু হতে যে মানুষটি নীরবে সবচেয়ে বেশি আমাকে উৎসাহ দেন, সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেন, উৎসব হলে অনেক লোকের রান্না করেন, সবকিছু সেরে আবার সংগীতের বিচার কাজ করেন, উৎসবে গান গান, কারণে-অকারণে বিভিন্ন সময়ে আমার প্রতি অভিমান থাকলেও এক সময় ভুলে যান। এক সময় হয়তো ভাবেন আমিই তার কাছে ভীষণ আপন। তাহমিনা হারুন আমার সহধর্মিণী সেই হিসেবে নয়, সে চতুরঙ্গের জন্যে কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন সেটা অন্যরাও বলবে। তার দুই সঙ্গী সীমান্ত রশীদ ও অনন্ত রশীদকে নিয়ে সময়টা তার ভালোই কাটছিল। আজ সেই তাহমিনা আমাকে ছেড়ে হারিয়ে গেছেন চিরতরে। আমার পরিবারে তাহমিনার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন কণ্ঠশিল্পী সাধনা সরকার অনু। যিনি বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে সংগীতে মাস্টার্স করছেন। তিনি চতুরঙ্গের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১৪তম ইলিশ উৎসবে সংগঠক হিসেবে তার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমার অনেকের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রতিটি ক্ষণে কারো আপন হয়েছি, আবার কেউ পর ভেবে দূরেও সরিয়েছে। একটা মানুষের সাথে আমি এখনো সংগঠন করছি। তার সাথে আমার একটি পারিবারিক সম্পর্ক। কারণ কথায় বলে, যে সবচেয়ে আপন সে থাকে বরযাত্রী+শবযাত্রী। আমি তাঁর প্রথমটার যাত্রী ছিলাম, ২য় টার যাত্রী হওয়ার বাসনা নেই। দীর্ঘ পথচলায় বহুবার ঝগড়া হয়েছে, মাঝেমধ্যে কিছুদিন কথাও বন্ধ থাকে, আবার কাজ করি এবং কথা বলা শুরু হয়। আমার খুব কাছের মানুষ শহীদ পাটোয়ারী। চতুরঙ্গের অনেক কর্মকাণ্ডে নীরবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকেও বিশেষ অভিনন্দন।

এই দিনে ভীষণভাবে স্মরণ করছি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার মরহুম বাবা আবদুল আউয়াল (সাবেক নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান, বালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ)-এর অবদানের কথা। সংগঠন করতে এসে তাঁর অনেক টাকাণ্ডপয়সা নষ্ট করেছি। যখন রাগ করে দেননি, গোপনে পকেট থেকে নিয়েছি। সেটাকে চুরি বলে কিনা আমি জানি না। বন্ধুদের নিয়ে আমাদের ভাড়াটিয়ার হোটেলে অনেক টাকা মাসে মাসে বাকি করতাম। পরবর্তীতে সেটি মরহুম কুদ্দুছের কাছে বিক্রি করে দেন আমার বাবা (বর্তমানে ক্যাফে জামান)। আমার বাবা ’৭১ সনে পাক আর্মির হাতে নির্যাতিত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কারণে দুইবার রাজাকার আয়াত উল্লার হাতে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নির্যাতিত হয়েছেন। অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা আসলে আমার বাবাকে ব্যথায় চিৎকার করতে দেখতাম। বাবা আজ নেই। আল্লাহ্ যেনো পরকালে তাঁকে শান্তিতে রাখেন। ইচ্ছা ছিলো তাঁর কবরের একটু দূরেই ছোট একটি বাড়ি করার, সেই ইচ্ছা আমার পূরণ হয়েছে।

১৯৮৩ হতে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, বিশেষ করে ২০০৬ হতে ২০০৮ চাঁদপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হ্যাটট্রিক সাংস্কৃতিক উৎসব করার গৌরব অর্জন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উৎসব ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান করেছে চতুরঙ্গ। ২০০৯ হতে ২০২২ পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ১৪টি ইলিশ উৎসবের মধ্য দিয়ে চাঁদপুরে জাতীয় পত্রিকা ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার জেলা প্রতিনিধি, জেলার সকল স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা চতুরঙ্গকে সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছে। সে সকল সাংবাদিক বন্ধুকে অনেক অভিনন্দন।

তাহমিনা হারুনের সুবাদে সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া জীবন এবং আমার আপন ছোট ভাইয়ের কারণে সাংবাদিক ইকরাম চৌধুরী (বর্তমানে মরহুম) আমার খুব কাছের আত্মীয় ছিলেন। তিনিসহ পার্থনাথ চক্রবর্তী, লক্ষ্মণ সূত্রধর, শাহ মোঃ মাকসুদুল আলম চতুরঙ্গকে তাদের কলমের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বর্তমানে মাকসুদুল আলম বেঁচে নেই। ইকরাম চৌধুরী ও মাকসুদুল আলমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

চতুরঙ্গের পথচলায় আজ বেশি করে মনে পড়ছে আমার সংস্কৃতির অভিভাবককে। আমাকে ছোট ভাইয়ের চেয়ে খুব বেশি স্নেহ করতেন। তিনি চাঁদপুরের অনেকের সাংস্কৃতিক অভিভাবক এবং সংগীতগুরু প্রয়াত শীতল ঘোষাল। মাঝে মধ্যে অভিমান করে কথা বলতেন না, আবার কথার মাধুরী দিয়ে কাছে টেনে নিতেন। হঠাৎ করেই আমার পরিবারের চোখের সামনে তিনি সেন্ট্রাল হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আমি, তাহমিনা, শান্তু, শাওন ছাড়া আর কেউ ছিলো না ওই সময়। তুলি এবং বিপ্লব ঔষধ আনতে গিয়েছিলো। ওই স্মৃতিটাই আমার কাছে এখনো দৃশ্যমান। দাদা আজ নেই, শিল্পকলার যে জায়গায় বসে চা-সিগারেট খেতেন। সেইখানটি আজ শুধুই স্মৃতি। ওই জায়গাটায় যখন আমি একা থাকি, মনে হয় দাদা আমার পাশে বসে আছেন। মনের অজান্তে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে, লেখতে পারছি না অনেক কিছু। নারায়ণগঞ্জের ২ ভাই আমজাদ হাসান ও মাসুদ হাসান। তারা দু’জনেই চতুরঙ্গের বহু অনুষ্ঠানে এসে অনুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছেন। মাসুদ ভাই আজ নেই, মাঝে মাঝে ভাবীর সাথে ফোনে কথা হয়। তার মেয়ের নাম গল্প। গল্পের মতই মাসুদ ভাই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। মাসুদ ভাইয়ের সহধর্মিণী ও তার তিন কন্যার প্রতি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা রইলো।

আমাদের এক সময়ের সহযাত্রী কণ্ঠশিল্পী অসীমা সাহা আজ নেই। বাংলাদেশের বহু জায়গায় চতুরঙ্গের হয়ে অনেক অনুষ্ঠানে গান করেছেন। অসীমা, অনিমা, বিরু ওরা সকলেই চতুরঙ্গের হয়ে অনেক কাজ করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে হিমুদা (বর্তমানে প্রয়াত) এবং তার বড় ভাই প্রয়াত বাদলদা চতুরঙ্গের অনেক কর্মকাণ্ডের সহযাত্রী ছিলেন। খুব বেশি মনে পড়ে চতুরঙ্গের উপদেষ্টা প্রয়াত অজিত কুমার মুকুল, প্রয়াত অ্যাডঃ হরিপদ চন্দ, প্রয়াত রীনা চক্রবর্তী, প্রয়াত উত্তম রায় বাবু ও মরহুম মাহাবুবুর রহমানকে। তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও দেশের মায়ায় কণ্ঠশিল্পী ইতু চক্রবর্তী (ইতুদি) চতুরঙ্গের সহযাত্রী হয়েছেন, তাঁর যোগদানে আমরা বেশ গর্বিত। সংকটময় মুহূর্তে রাজনীতিবিদ আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারী ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ ওয়াদুদ আমাদের পাশে ছিলেন সবসময়। কোনো তথ্য ও পরামর্শের জন্যে দিনে ও অধিক রাতে ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোনে বিরক্ত করি। এ মানুষটির প্রতিও চতুরঙ্গ বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।

স্থানীয় প্রশাসন চতুরঙ্গের ইলিশ উৎসবকে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্যে মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করে (২০১২-২০১৪)। আমরা মনে করি, এ গৌরব সমগ্র চাঁদপুরবাসীর। একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় সদর আসনের এমপি, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন-এর প্রতি অনুরোধ, আপনাদের এ সময়ে এটি জাতীয় উৎসব হলে সংস্কৃতির ইতিহাসে আপনাদের নাম কালজয়ী হয়ে থাকবে।

দীর্ঘ পথচলায় মাহাবুব আনোয়ার বাবলু, শাহেদ রায়হান কালু, জাহাঙ্গীর আলম খান, প্রভাষক শরীফা সুলতানা মিতু, লিটন ভূঁইয়া, শর্বরী সেহেলী, হুমায়ুন কবির রেবন (বর্তমানে প্রয়াত), গীতিকার কবির বকুল, কণ্ঠশিল্পী ও টিভি উপস্থাপিকা দিনাত জাহান মুন্নী, অ্যাডঃ আব্দুর রহমান, গোলাম মোস্তফা রতন, গোলাম রসুল হিরন, কার্তিক দাস, খোকন দাস, ঝিরি সাহা, মিছিল সাহা, শারমিন আক্তার জুঁই দূরে থাকলেও চতুরঙ্গের কার্যক্রমে মাঝে মধ্যে তাদের উপস্থিতি ঘটে।

চতুরঙ্গের চৌকষ সাংস্কৃতিক কর্মী ও কর্মকর্তা মানিক দাস, শুভ্র রক্ষিত, মোঃ রাজিব চৌধুরী, এম. এইচ. বাতেন, মুন্না ঘোষ, মোনায়েম হোসেন অন্তু, অনিক নন্দী, রিয়াদ, আফসার বাবু, মেহেদী হাসান জীবন, বাপ্পি চৌধুরী, রাশেদুল রাব্বী, রোমানা মাহমুদ, মোঃ সাজাহান, আহসান জুয়েল, মোঃ মোবারক, প্রীতি, নদী ও মুন্নী। যে কোনো ইভেন্টে তারাই চতুরঙ্গের প্রাণশক্তি এবং চতুরঙ্গের আগামী প্রজন্ম। তাদের প্রতিও স্নেহ ও ভালোবাসা। এছাড়া চাঁদপুরের বিশিষ্ট সংস্কৃতি সংগঠক চাঁদপুর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ফোরামের সভাপতি তপন সরকার ও তার বোন রুমা সরকারও চতুরঙ্গের সহযোগী। সেজন্যে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমাদের বিশেষ অর্জন হচ্ছে জাতীয় মাছ চাঁদপুরের রূপালী ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশে প্রথম চতুরঙ্গই ইলিশ উৎসব করে আসছে। চতুরঙ্গই প্রথম শিল্পকলায় অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার ও ফোনোলাইভ স্টুডিও কনসার্ট-এর আবিষ্কারক। বিভিন্ন উৎসবের পরিকল্পনা করতে গিয়ে দিনে এবং রাতে কত যে সাদা কাগজ নষ্ট করেছি তার হিসেব নেই। বর্তমানে কাগজের দাম বেড়েছে কিনা জানি না। যদি বেড়ে থাকে তার জন্যে কিঞ্চিত আমি দায়ী। সেজন্যে সকল অভিভাবক, ছাত্র-ছাত্রী এবং কর্ণফুলী পেপার মিলস্সহ অন্য পেপার মিলস্ কর্তৃপক্ষের কাছে আংশিক ক্ষমাপ্রার্থী। চাঁদপুরে সর্বপ্রথম কোনো উৎসব প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর প্রথা একমাত্র আমরাই প্রচলন করি। গ্রামীণ ফোন ৫ বার, চান্দ্রা যুব বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ ১ বার, আল হেলাল স্পেশালাইজড্ হাসপাতাল লিঃ ঢাকা ১ বার, জিপিএইচ ইস্পাত লিঃ ১বার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ৪ বার স্পন্সর করে উৎসবের আমেজ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

শেষ কথা

জীবন এবং যৌবনের শেষপ্রান্তে আমি। ৪০ বছর সংস্কৃতির সাথে ঘর করেছি, বিত্তবান হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। প্রতিনিয়ত চিত্তের সাথে বসবাস আমার। ‘শিল্পকলা একাডেমির সম্মাননা’ প্রাপ্তিতে কর্মের প্রাপ্তি ঘটেছে বা স্বীকৃতি মিলেছে। এখন আর পাওয়ার কিছুই নেই। একটু সময় ভালো থাকি, কোনো সময় খারাপ। শারীরিক কিছু সমস্যা আছে, যেটি কাছের প্রিয় মানুষরাই জানেন। বিগত পথচলায় কেউ হয়তো দূরে সরে গিয়েছে, নতুন কেউ হয়তো আবার জায়গা করে নিয়েছে। হয়তো জীবন সমাপ্তির পা-ুলিপিতে আমার নাম স্থান পাবে। মেঘনার স্রোত হয়তো আগের মতোই বইবে, চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনে জসীম মেহেদীর পত্রিকার স্টলের কোলাহল হয়তো আরো বেড়ে যাবে, শিল্পকলা একাডেমীর আঙ্গিনায় নতুন সংস্কৃতি কর্মীদের আগমন আরো বেশি ঘটবে, সাহিত্য একাডেমীতে মাসিক সাহিত্য আড্ডা আগের মতোই চলবে। তখন হয়তো আমি থাকবো না। মানুষ তার কর্মেই বেঁচে থাকে। এমন কর্ম কি আমি করেছি যে, আমাকে নিয়ে কোনো শোকসভা হবে? চতুরঙ্গ বা ইলিশ উৎসব কি আগের মতোই হবে? বিজয় মেলা হলে আয়োজকরা কি আমাকে স্মরণ করবে? এতো প্রশ্নের মধ্য দিয়েও সকলের দোয়া চাই। ভালো থাকবেন সবাই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়