প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
করোনার তাণ্ডবে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিলো স্কুল। মাস তিনেক হয়েছে করোনার তাণ্ডবকে জয় করে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলগুলো খুলেছে। প্রচ্ছদও অন্য সবার মতো খুশি, তাদের স্কুল খুলে যাওয়ায়। স্কুলই হলো তার প্রাণ। সে যে খুব পড়তে পছন্দ করে তা কিন্তু নয়। সে আসলে অনেকদিন বন্ধুদের দেখেনি। তাদের সাথে খেলাধুলা করেনি। স্কুলের ছোট্ট মাঠে খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতল দিয়ে বন্ধুরা মিলে ফুটবল খেলতে কী যে সুখ তা কাউকে বোঝানো যায় না। স্কুল খোলায় সেই সুখ প্রচ্ছদকে আবারও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। স্কুল ছুটি হওয়ারও একঘণ্টা পরে সে বাসায় আসে। এতোক্ষণ বন্ধুরা মিলে বোতল-ফুটবল খেলে। আসল ফুটবল নেয়া যায় না স্কুলে। যদি জানালার কাচ ভাঙে তবে দারোয়ান ধরে নিয়ে যাবে হেডমাস্টারের কাছে। তাই সে ফুটবল নিতে পারে না স্কুলে। বাসায় মা যখন টুকটাক সংসারের কাজকর্ম করতে বলে তখন সে খুব অলসতা দেখায়। কিন্তু স্কুলের খেলার মাঠে কোনো অলসতা নেই। স্কুলের ছোট মাঠটাই তার প্রাণভোমরা। সহপাঠী বন্ধুরা তার হৃদপি-ের এক একটা চেম্বার।
প্রচ্ছদের আজ মন খারাপ। খুব মন খারাপ। আজ তাদের স্কুলের লাস্ট ওয়ার্কিং ডে। দুদিন পরে ফাইনাল পরীক্ষা। তিন বিষয়ের প্রতিটিতে পঞ্চাশ নম্বর করে। ফাইভের পরে ক্লাস সিক্সে নতুন স্কুলে যাবে ওরা। ফাইভ পর্যন্ত ছেলেমেয়ে সবাই একসাথে ছিলো। সিক্সের ক্লাসে ছেলে আর মেয়ে আলাদা স্কুলে চলে যাবে। এই প্রিয় স্কুল-মাঠ যেমন থাকবে না তেমনি বন্ধুরাও আলাদা হয়ে যাবে। রূপন, মিথিলা, মুগ্ধ এরা সবাই আলাদা হয়ে যাবে সাত বছর একসাথে পড়ার পড়ে। প্রচ্ছদ অবশ্য জন্মের ছয়মাস পর থেকেই স্কুলে যায়। মায়ের সাথে ক্যাঙ্গারু-ব্যাগে ছোট্ট প্রচ্ছদ স্কুলে আসতো। তখন তার বড় ভাই সবেমাত্র প্লে ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। ভাইয়ের ক্লাসের গার্ডিয়ানরা তাকে কোলে নিয়ে ঘুরতো। স্কুলের ম্যামরাও তাকে কোলে নিয়েছে। সেই প্রচ্ছদ আজ স্কুলের সাথে, বন্ধুদের সাথে আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় মন খারাপ।
স্কুলে লাস্ট ওয়ার্কিং ডে উদ্যাপন নতুন নয়। প্রতি বছরই হয়। আজ প্রচ্ছদকে তার ম্যামরা ধরেছে ব্যান্ডের গান গাইতে। তাকে সবাই রকস্টার নাম দিয়েছে। এবির গান খুব জনপ্রিয় এখনও। প্রচ্ছদও এবির গান গেয়েছে আজ। সবার কমন গান। ফলে গান শুরুর সাথে সাথে প্রচ্ছদকে আর কিছুই করতে হয়নি। লিরিক্স জানা থাকায় সবাই নেচে নেচে গলা মিলিয়েছে। সে রীতিমত এখন সেলিব্রিটি। কিন্তু তবুও মনের কষ্ট যাচ্ছে না। কাছের কয়েকজন বন্ধুর জন্যে সে মাকে বলে গিফ্ট এনেছে। কলম, ভিউকার্ড ইত্যাদি। বন্ধুদের মধ্যে গিফ্ট বিতরণও শেষ। আজ ছয়টা কেক কেটেছে ম্যাম আর স্যারেরা। এক টুকরো কেক প্রচ্ছদও পেয়েছে। অন্যদিন হলে আরেক টুকরো কেক কীভাবে পাওয়া যায় তা নিয়ে ফন্দি আঁটতো। কিন্তু আজ কেনো জানি এসবে মন নেই। এবার নাকি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা হবে না। লটারি হবে। লটারিতে কে কোথায় টিকে তা বলা যায় না। প্রচ্ছদ কখনও লটারিতে জিতেনি।
বন্ধুরা সবাই মিলে খেতে বসেছে টেবিলে। মজার মজার সব খাবার। খেতে খেতে কত কথা তারা বলে! কার কী মুদ্রা দোষ, কোন্ টিচার কীভাবে কথা বলে তার ক্যারিকেচার করতে করতে খাবার টেবিল যেনো হয়ে ওঠে শিল্পকলার মঞ্চ। মধ্যাহ্ন গড়িয়ে যায়। সূর্যের তেজ কোমল হয়ে আসে। প্রচ্ছদের বন্ধুরা ধীরে ধীরে একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে শুরু করে। থেমে গেছে ডিজের আওয়াজ। মাঠের কোমল সবুজ ঘাসে পদদলনের চিহ্ন। এখানে সেখানে ছড়ানো-ছিটানো পরিত্যক্ত পানির বোতল আর খাবারের প্যাকেট। স্কুলপর আয়ারা সেই পরিত্যক্ত প্যাকেট এরই মধ্যে কুড়োতে শুরু করেছে।
পরশু থেকে পরীক্ষা। পরীক্ষা মানেই চাপ আর তাড়াহুড়া। প্রচ্ছদের বন্ধুরা স্কুল প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার জন্যে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। এমন সময় মাইকে স্কুলের হেড স্যারের গলা শোনা যায়। ডিয়ার স্টুডেন্টস এন্ড গার্ডিয়ানস্, অ্যাটেনশন প্লিজ। হেড স্যারের গলা শুনে সবাই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ায়। চোখে-মুখে বিস্ময় আর জিজ্ঞাসা। সবাইকে সাসপেন্সে রেখে স্কুলের হেড স্যার গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নেন কণ্ঠস্বর। যারা গেট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো, তারা আবার ফিরে এলো অনুষ্ঠান মঞ্চের আশপাশে। সবার প্রতীক্ষায় রসদ যুগিয়ে হেড স্যার বলতে শুরু করেন, প্রিয় ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকবৃন্দ, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে আমাদের এই স্কুল আর থাকবে না। কেনো স্যার? সমস্বরে সবাই জিজ্ঞেস করে ওঠে স্যারকে। সবার চোখেমুখে বিস্ময়। উদ্বিগ্ন মায়েদের কপালে ভাঁজ
দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও বিস্ময়ের ঘোরে। এমন সময় হেড স্যার বললেন, এটা কোনো দুঃসংবাদ নয়। এটা আমার জীবনে, আপনাদের জীবনে এক বড় সুসংবাদ। এবার আর শান্ত থাকা যায় না। প্রছদ ও তার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে চিৎকার করে, স্যার কী সুসংবাদ? স্যার বলে যান, আগামী বছর এই স্কুলের নামে পরিবর্তন আসছে। এই স্কুল আগামী বছর থেকে আর প্রাথমিক স্কুল হিসেবে থাকবে না। আমরা আগামী বছর থেকে স্কুলে মাধ্যমিক শাখা চালু করার অনুমতি পেয়ে গেছি। এই মাত্র ফ্যাক্সে সে অমুমতিপত্র আমার হাতে এসেছে। স্যারের কথা শুনেই চিৎকার দ্বিগুণ হয়ে গেলো। প্রচ্ছদ ও তার বন্ধুদের আজ আর ঠেকানো যাবে না উল্লাস হতে।