শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

কাইকোপাড়ার ভুতুড়ে ঝরনা

আহমেদ রিয়াজ

কাইকোপাড়ার ভুতুড়ে ঝরনা
অনলাইন ডেস্ক

লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রিমি। অদ্ভুত! বড্ড অদ্ভুত।

গতকাল বিকেল থেকে লোকটা ওদের গাইড। তবু বুঝতে পারেনি রিমি। লোকটার চোখে সব সময় কালো সানগ্লাস থাকে। এমনকি রাতের বেলাতেও।

ওরা এসেছে কাইকোপাড়া। এখানে একটা ভুতুড়ে ঝরনা আছে বলে খবর পেয়েছে। আর ঝরনার খবর পেয়েছে সেই অদ্ভুত লোকটার কাছ থেকে। অদ্ভুত লোকটার দেখা ও পেয়েছিল বোট থেকে নেমেই।

ঢাকা থেকে ওরা গত পরশু সকালে বান্দরবানে এসেছে। বান্দরবান থেকে থানচি আসতে আসতে প্রায় দুপুর। থানচি থেকে বোটে করে রেমাক্রি। বোটযাত্রা দারুণ লেগেছে রিমির। চিকন চিকন বোট। তীব্র ঢেউ আর মাথা তোলা পাথর কেটে কেটে এগিয়ে যায় ওগুলো। সার্ফিংয়ের স্বাদ পাওয়া যায়। এ রকম সার্ফিং ও দেখেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে। তবে বোটগুলো এতই চিকন যে পাশাপাশি দুজন বসা যায় না। আর একেকটা বোটে পাঁচজনের বেশি যাওয়া যায় না। নিয়ম নেই। রিমির বাবা গোয়েন্দা পুলিশ। তবে নৌকাঘাটে নিজের পরিচয় দেননি। সবাইকে নিষেধও করে দিয়েছেন, যাতে তাঁর পরিচয় না দেয়। সবাই বলতে রিমি তো আছেই। সঙ্গে আছে রিমির মামাতো ভাই মাশুক আর মামাতো বোন শাহীন।

রেমাক্রিতে একটা জলপ্রপাত আছে। বিশাল। সেই জলপ্রপাত পেরিয়ে আরও একটু এগিয়ে সাঙ্গু নদীর পারে একটা ঘাটে ওরা নেমেছিল। ঘাটে নেমে চারপাশটা ভালোমতো দেখতে লাগল রিমি। তখনই দেখা হলো সেই অদ্ভুত লোকটার সঙ্গে। একমাথা লাল চুল। কোঁকড়ানো। রিমির তাকানো দেখে লালচুলো বলল, ‘আমার চুল না দেখে ঝরনা দেখে এসো খুকি। ভুতুড়ে ঝরনা।’

চমকে উঠল রিমি। ভুতুড়ে ঝরনা! ভুতুড়ে ঝরনার খোঁজ ও কীভাবে পাবে?

তখনই হাঁক দিলেন বাবা, ‘ওখানে কী করছ রিমি। জলদি এসো।’

ঘাট থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে বেশ উঁচুতে উঠতে হবে। ওখানেই বাজার। দলের সবাই পাহাড়ের অর্ধেকটা উঠে গেছে।

চট করে রিমি জানতে চাইল, ‘ভুতুড়ে ঝরনায় কীভাবে যেতে হয়?’

লালচুলোর ছোট্ট জবাব, ‘শব্দ শুনে।’

শব্দ শুনে অচেনা ঝরনার কাছে কীভাবে যাবে ও বুঝতে পারল না। দলের অন্যদের দিকে তাকাল। পাহাড়ের প্রায় উঁচুতে উঠে গেছে সবাই। কিন্তু অজানা এক রহস্যের খোঁজ পেয়ে আটকে গেল রিমি। ঝরনাটা দেখতেই হবে। কিছু একটা জানতে চাইল ও। কিন্তু কোথায় লালচুলো?

ওই তো। চোখের পলকে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। তবে যে পথ দিয়ে সবাই ওঠে, সে পথে নয়। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। আর চোখের পলকেই হারিয়ে গেল।

দুপুরের খাবার খেতে খেতে বিকেল চারটা। এবার হাঁটা।

শাহীন আপা জানতে চাইলেন, ‘ফুফাজি, কতক্ষণ হাঁটতে হবে?’

শাহীন আপার ফুফাজি মানে রিমির বাবা। বললেন, ‘ঠিক জানি না। আমরা যাব কাইকোপাড়া। এখানে জিপিএস কাজ করে না। বলতে পারব না।’

তখনই পাশ থেকে কেউ একজন বলল, ‘আশা করি রাত ৯টার মধ্যে পৌঁছে যাব।’

সবাই লোকটির দিকে তাকাল। চোখে সানগ্লাস।

মাশুক ভাই জানতে চাইলেন, ‘আপনি কে?’

‘আপনাদের গাইড।’

রিমির বাবা বললেন, ‘আমরা সমতলের মানুষ ঠিকমতো পাহাড়ি পথ চিনব না। সে কারণে এখানে গাইড নিয়ে চলাচল করতে হয়।’

শুরু হলো হাঁটা। এই হাঁটাকে সমতলের মানুষ বলে ট্র্যাকিং। ট্র্যাকিং খুব রোমাঞ্চকর। যদিও শাহীন আপার খুব একটা ভালো লাগছে না। মুখ দেখেই বুঝতে পারছে রিমি। অথচ এখানে আসার জন্য শাহীন আপার উচ্ছ্বাসই ছিল বেশি।

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামল। পাহাড়ি সন্ধ্যাটা মজার। এপাশে অন্ধকার। ওপাশে আলো। একসময় দুই পাশেই সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে।

এই পাহাড়ের পাশ দিয়ে, ওই পাহাড়ের ওপর দিয়ে আর নদী মাড়িয়ে চলতেই থাকল ওরা। বারবার নদী পাড়ি দিতে হচ্ছে। সাঙ্গু নদী। নদীতে পানি কম। কোথাও গোড়ালি পর্যন্ত। কোথাও গোড়ালির ওপর। দুই-তিনবার কেবল হাঁটুসমান। কিন্তু নদীতে অসম্ভব স্রোত। পাহাড়ি পথে ছটফট করতে করতে ছুটে চলা নদী সাঙ্গু।

কাইকোপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১০টা। এখানে ওরা এক মুরং হেডম্যানের বাড়িতে থাকবে। কাঠের বাড়ি। বিজলি বাতিও আছে। তবে পাওয়ার আসে সোলার প্যানেল থেকে।

ওরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই রান্না বসানো হলো। রান্না হতে সময় লাগবে। ততক্ষণে ওরা সবাই গোসল সেরে নিল। হেডম্যানের বাড়ি বলে সুযোগ-সুবিধা ভালো। বিশাল এক জলাধার আছে। সিমেন্টের তৈরি। সাঙ্গু থেকে মোটর দিয়ে পানি টেনে এনে জলাধার ভরা হয়। জলাধারের পাশেই গোসলের জায়গা। ওয়াশরুম খানিকটা দূরে। ১০-১২ কদম হেঁটে যেতে হয়। চারপাশ টিন দিয়ে ঢাকা। ভেতরে বড়সড় একটা মটকা। মটকায় পানি ভরা। মটকার মুখে জগ।

রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। আলুভর্তা। ডাল। সেদ্ধ ডিমের ঝোল। জুম চালের ভাত। খাওয়ার পর ঘুমে সবার চোখ বুজে আসতে চাইছে। সারা দিনের ক্লান্তি। শাহীন আপা তো পারলে খেতে বসেই ঘুমিয়ে পড়েন। জীবনে নাকি এতটা পথ কখনো হাঁটেননি।

বাবা বললেন, ‘ঘুমানোর আগে সবাই হাতে-পায়ে ভালো করে ক্রিম মেখে নাও।’

মশা দূর করার ক্রিম নিয়ে এসেছে ওরা। পাহাড়ি এলাকায় ম্যালেরিয়ার উৎপাত। আগে বেশি ছিল। এখন অনেকটা কমে এসেছে। মশারির ব্যবস্থা নেই। গায়ে ক্রিম মেখেই শুয়ে পড়ল ওরা। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। তবে খুব আস্তে। ফ্যানে একটা শব্দ হচ্ছে। সাঙ্গুর স্রোতের শব্দের মতো। পানির স্রোতের সঙ্গে নদীর তলায় থাকা পাথরের ঘষায় অদ্ভুত এক সুর তৈরি হয়। এখন রিমির কানে সেই সুর ভাসছে। সেই সুরে ভাসতে ভাসতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে, টের পায়নি।

ঘুম ভাঙল বাবার ডাকে। বাবা বললেন, ‘উঠে পড়ো রিমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে যাব।’

চোখ মেলে বাইরে তাকাল। ‘এখনো তো অন্ধকার।’

‘সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়ব। সূর্য ওঠার পর হাঁটতে কষ্ট হবে। ঠান্ডা থাকতে থাকতে যতখানি এগোনো যায়।’

চোখ-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল সবাই। খিচুড়ি আর ডিমভাজি। অসাধারণ লাগল। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা।

পিঠে ছোট্ট একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে নিল রিমি। মাশুক ভাই, শাহীন আপা, রিমির বাবা, রিমি আর ওদের গাইড। গাইডের চোখে সানগ্লাসটা আছেই। একমুহূর্তের জন্যও গাইডের চোখ থেকে সানগ্লাস সরতে দেখেনি রিমি। রাতে ট্র্যাকিংয়ের সময়ও খেয়াল করেছে রিমি। অন্ধকার রাতে সানগ্লাস পরার কী আছে, কে জানে। অভ্যাস। অনেকের অনেক রকম অভ্যাস থাকে।

রিমি জানতে চাইল, ‘বাবা আমরা কোথায় যাব?’

বাবা বললেন, ‘বেশি দূরে যাব না। আশপাশের কোনো ঝরনা দেখে চলে আসব।’

হেডম্যানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই যে হাঁটতে শুরু করেছে ওরা, থামল দুটো পাহাড় ডিঙিয়ে। একটা পাহাড়ের একপাশে একটা ছাউনি। ওখানে থামল। সূর্য উঠেছে অনেকক্ষণ। শাহীন আপা বললেন, ‘আর কদ্দুর ফুফাজি?’

বাবা বললেন, ‘আমি তো চিনি না রে মা, গাইড জানে।’

এবার গাইডের কাছে জিজ্ঞেস করলেন শাহীন আপা, ‘আর কতক্ষণ?’

গাইড কী বলল কে জানে। গাইডের কথা নাকি কিছুই বোঝেন না শাহীন আপা। এবারও না বুঝে মাথা নাড়লেন। মাশুক ভাই শাহীন আপার কা- দেখে মুচকি হাসলেন।

তাড়া দিলেন বাবা, ‘চলো। অনেক বিশ্রাম হয়েছে।’

বলেই রওনা দিলেন। বাবাকে হাঁটতে দেখে গাইডও বাবার পেছন পেছন চলতে লাগল। তার পেছনে মাশুক ভাই। তার পেছনে শাহীন আপা। সবার পেছনে রিমি।

ঘেমে গেছে সবাই। সামনেই সাঙ্গু। এখানে সাঙ্গু আছেই। জালের মতো বিছানো।

টলটলে পানি। স্বচ্ছ। নিচে পাথর। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই তো একজন মাছ ধরছে। পানির কলকল শব্দ তো আছেই। টলটলে পানিতে চোখ-মুখ ধুয়ে নিল সবাই। একটা পাথরের ওপর ওঠার জন্য যে-ই একটা পা বাড়াল রিমি, অমনি চেঁচিয়ে উঠল গাইড ‘সাবধান! পানির নিচের পাথর খুব পিচ্ছিল। পা পিছলে পড়ে যাবেন।’

থেমে গেল রিমি। চট করে তাকাল গাইডের দিকে। আর তাকিয়েই চমকে উঠল। একবার গাইডের এ চোখে আরেকবার ও চোখে তাকাল। মানুষের চোখ এমনও হয়! কয়েকবার তাকানোর পর হঠাৎ টের পেল গাইড। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর মুখে কালো সানগ্লাস দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে ফেলল।

পাথরের দিকে তাকাল রিমি। পানির নিচে পাথরটা দেখতে এতই স্বচ্ছ যে পিচ্ছিল বলে মনেই হচ্ছে না। তবে পানিতে তীব্র স্রোত। সাবধান না হলে যেকোনো সময় বিপদ হয়ে যেতে পারে। যদিও রিমির ভাবনায় এখন গাইডের অদ্ভুত চোখ দুটো ঘুরেফিরে আসছে। মানুষের এমনও চোখ হয়!

নদী পেরিয়ে আবার চলতে শুরু করল ওরা। প্রথমে কিছুটা নদীর কিনার ধরে। তারপর আবার পাহাড়ি পথে। নদীর কিনারে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিল রিমি। হঠাৎ পথের ধারে অদ্ভুত এক ফুল দেখে দাঁড়িয়ে গেল।

কী ফুল এটা? গাইডকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে হয়তো। কিন্তু গাইড তো সামনে। এই পাহাড় ডিঙালেই নাকি একটা ঝরনা দেখা যাবে।

ওদিকে পানি থেকে উঠেই দলটা হারিয়ে গেল। কোথায় গেল দলটা?

এদিক-ওদিক তাকাল রিমি। আশপাশে কাউকে দেখতে পেল না। পুরো পাহাড়ি বনে নিজেকে খুব একা মনে হলো ওর। যদিও জায়গাটা অসাধারণ। বুনো পাহাড়ি পথ। পাশে কলকল করে বয়ে চলেছে নদী। নদীটাও মোটামুটি খরস্রোতা।

ট্র্যাকের দিকে তাকাল ও। চিকন দুটো পথ উঠে গেছে ওপরে। যেকোনো এক পথ দিয়ে গেছে ওরা। কিন্তু কোন পথ? দ্বিধায় পড়ল রিমি। দুটো ট্র্যাক ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করল। ডান দিকের ট্র্যাকের ওপর পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো ভেজা। আর বাঁ দিকের ট্র্যাকটি শুকনো। এবার ওর মুখে হাসি ফুটল। ডান পাশের ট্র্যাক ধরেই এগিয়েছে সবাই। পানি থেকে ওঠার কারণে সবার পা ভেজা ছিল। পায়ের পানিতে ট্র্যাকের শুকনো ডালপাতাও ভিজে আছে। তবে আরেকটু দেরি হলে এই ক্লুটা হারিয়ে যেত। কারণ ততক্ষণে ট্র্যাক শুকিয়ে যেত।

জোরে জোরে পা চালাল রিমি। একটু পরেই দেখা মিলল বাকিদের। ওই তো শাহীন আপা। তার সামনে মাশুক ভাই। তারও সামনে বাবার মাথা দেখতে পেল ও। গাইডকে দেখা যাচ্ছে না।

দলটা হঠাৎ থেমে গেল। ঝরনার পানিপতনের শব্দ। খুব জোরে জোরে শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে শব্দ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। একটা বাঁক ঘুরতেই কানফাটানো শব্দ। ঝরনা!

ওদের সামনেই ঝরনা। বিশাল। কিন্তু ঝরনাটা পানিবিহীন। একফোঁটাও পানি নেই। শুকনো খটখটে।

বাবা জানতে চাইলেন, ‘ঝরনার পানি কোথায়?’

গাইড বলল, ‘আগে ছিল। এখন নেই।’

মাশুক ভাই বললেন, ‘কিন্তু পানির শব্দ তো আছে। অবাক কা-! শব্দ আসছে কোত্থেকে?’

এবার ফিসফিস করে গাইড বলল, ‘এটা ভুতুড়ে ঝরনা। ওটা এখন ভূতের আস্তানা।’

ভুতুড়ে ঝরনা! লালচুলোটা তাহলে এই ঝরনার কথাই বলেছিল। ভীষণ কৌতূহল হলো রিমির। একটা ভূতের আস্তানার খোঁজ পেয়েছে ও। আরেকটু ভালোমতো দেখা যাক। কিন্তু সামনে এগোতেই চেঁচিয়ে উঠল গাইড, ‘আর সামনে যাবেন না। বিপদ হবে।’

বিপদ! কিসের বিপদ? শাহীন আপা বললেন, ‘চলেন ফুফাজি, তাড়াতাড়ি এ জায়গা থেকে চলে যাই।’

ফিরতি পথ ধরল ওরা। এবার অন্য পথ দিয়ে সত্যিকারের ঝরনার কাছে এল। ঝরনা দেখে মুগ্ধ সবাই। ঝরনার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিল। পানির বোতল ভরে নিল। ঢাকায় নিয়ে যাবে। রিমি বলল, ‘অরিজিনাল মিনারেল ওয়াটার।’

ঝরনার পানিতে নেমে গোসল করতে খুব ইচ্ছে করছে রিমির। কিন্তু শাহীন আপার তাড়ায় পারল না। এখনই ফিরতে চান। তাঁর আর ভালো লাগছে না। কী আর করা। মুরংপাড়ার পথ ধরল সবাই। এবারও সবার শেষে রিমি। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে চলতে লাগল। কিছুটা এগোতেই হঠাৎ লালচুলোকে দেখতে পেল ও। লালচুলোটা এখানে কী করছে?

কিছু না ভেবেই লালচুলোর পিছু নিল রিমি। কিন্তু দুটো বাঁকের পরই লালচুলোকে হারিয়ে ফেলল। লালচুলোর সঙ্গে পথটাও হারিয়ে ফেলল। কোন পথে যে এসেছিল, মনেই করতে পারছে না। পেছনের দিকে আসতে লাগল রিমি। সামনে যে ট্র্যাকই পড়ছে, সে ট্র্যাক ধরেই এগোচ্ছে।

কতক্ষণ হেঁটেছে জানে না রিমি। হঠাৎ আবছা একটা শব্দ এল ওর কানে। ঝরনার শব্দ! শব্দটার দিকে এগিয়ে গেল রিমি। শব্দটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।

একেক ঝরনার শব্দ একেক রকম। প্রতিটি ঝরনার যেন আলাদা আলাদা ভাষা। কিন্তু এই ঝরনার ভাষাটা পরিচিত মনে হচ্ছে কেন? বুঝতে পারল রিমি। এটা সেই ভুতুড়ে ঝরনা। পথ হারিয়ে ও আবার সেই ভুতুড়ে ঝরনার কাছেই চলে এসেছে। চারপাশটা ভালো করে দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল রিমি। কিছুটা অবাকও হলো। এ পথ দিয়ে তো ভুতুড়ে ঝরনার কাছে যায়নি। তাহলে এটা অন্য পথ। একই গন্তব্যের অনেক পথ থাকতেই পারে।

যতই এগোচ্ছে, ততই কানফাটানো শব্দ। দুটো বাঁক ঘুরতেই চোখের সামনে যা দেখল, তার জন্য মোটেও তৈরি ছিল না রিমি। ও ভেবেছিল পানিবিহীন সেই ভুতুড়ে ঝরনাটাই দেখবে। কিন্তু এখন ওর চোখের সামনে তুমুল বেগে নেমে আসা পানির বিশাল এক ঝরনা।

চোখ দুটো আটকে গেল রিমির। হঠাৎ ঝরনার ওপরে তাকিয়ে আবারও চমকে উঠল ও। সেই লালমাথা।

হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেল, ‘রিমি! এখানে এলে কী করে?’

পেছনে ঘুরল রিমি। ‘বাবা! তুমি এখানে?’

বাবার সঙ্গে মুরংপাড়ায় ফিরল রিমি। গাইডের সঙ্গে মাশুক ভাই আর শাহীন আপা আগেই এসেছেন। দুপুরের খাবার খেয়ে আর দেরি করল না ওরা। বেরিয়ে পড়ল রেমাক্রির উদ্দেশে। রাতে রেমাক্রিতে থাকবে। কাল সকালে ফিরে যাবে থানচি বাজার। এরপর দুপুরের মধ্যে থানচি থেকে বান্দরবান শহরে। দুপুর আর বিকেলটা শহরে কাটিয়ে রাতের বাসে ঢাকা।

চলতে চলতে রিমি জানতে চাইল, ‘বাবা, ভুতুড়ে ঝরনাটায় পানি এল কী করে?’

বাবা বললেন, ‘ওটা ভুতুড়ে ঝরনা নয়। সত্যিকারের ঝরনা।’

‘তাহলে ঝরনায় পানি পড়ার শব্দ আছে, পানি নেই কেন?’

বাবা বললেন, ‘এখানে কিছুদিন আগে একটা ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের কারণে ঝরনার ঠিক পেছনে একটা ফাটল তৈরি হয়। এলাকাটা পাথুরে হওয়ায় ফাটলটা সহজেই তৈরি হয়েছে। ঝরনার জন্য বয়ে আনা পানির স্রোত তখন নতুন ফাটল দিয়ে পড়তে শুরু করে। মানে নতুন আরেকটা ঝরনা তৈরি হয়। যে কারণে আমরা পুরোনো শুকনো ঝরনাটা চোখের সামনে দেখতে পাই। কিন্তু শব্দ পাই নতুন ঝরনার। এই হলো ভুতুড়ে ঝরনার রহস্য। কিন্তু তুমি ওখানে গেলে কী করে?’

রিমি বলল, ‘পথ হারিয়ে। তুমি কেন গিয়েছিল বাবা?’

রিমির কথার জবাব দিলেন না বাবা। রিমি জানে, জবাব দেওয়ার হলে বাবা দিতেন। এখন হাজারবার জানতে চাইলেও বাবা কিছু বলবেন না। তবে যখন সময় হবে, তখন ঠিকই বলবেন।

ফিসফিস করে আবার জানতে চাইল রিমি, ‘লালচুলোটা তোমার পরিচিত, তা-ই না বাবা?’

মনে হলো বাবা কেবল ‘হুঁ’ বলে একটা শব্দ করেছেন। শব্দটা সাঙ্গুর স্রোতেরও হতে পারে। রিমিরা তখন গোড়ালিসমান পানির সাঙ্গু পাড়ি দিচ্ছিল। কত রকমভাবে যে শব্দ করে সাঙ্গুর পাথুরে স্রোত! যে যে রকমভাবে প্রকাশ করে।

এখনো ওদের সঙ্গে সেই গাইড। রাতের বেলাতেও সানগ্লাস পরে আছে। রিমি জানে কেন সব সময় সানগ্লাস পরে থাকে লোকটা। অদ্ভুত চোখজোড়া সে কাউকে দেখতে দিতে চায় না। গাইডের দুই চোখ দুই রঙের। একটা চোখ কুচকুচে কালো। আরেকটা সাদা। রিমি জানে কেন এমন হয়। গাইডের শরীরে দুই সেট ডিএনএ। এ কারণেই তার দুই চোখের রং দুই রকম। কিন্তু গাইড কি সেটা জানে? কে জানে!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়