প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
তখন বৃষ্টিশেষে সন্ধ্যা নেমেছে শান্ত হয়ে। আশপাশের ধুলোবালি সব ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে গেছে কয়েক মিনিট আগে হওয়া হঠাৎ বৃষ্টির পানি।
বিকেলের ঝরঝরে বর্ষণের পর এখন আধাপাকা রাস্তার ধারটা বেশ শান্ত। পাশেই মাঝারি ধরণের একটা জঙ্গল। রাস্তার পাশে জঙ্গলের একটা অংশ পড়েছে। নির্জন কালো ঝোপ। ঘন অন্ধকারের জন্ম দিতে শুরু করেছে সদ্য জেগে ওঠা সন্ধ্যা। ঝোপের ভেতরে ঘামটি মেরে বসে আছে একটা ঝিঁঝিঁর পরিবার।
বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। ছোট্ট ঝিঁঝিঁটা, যে কয়েক মাস আগে জন্মালো মাত্র, ঠাণ্ডায় মায়ের ডানার নিচে জায়গা নিয়েছে। ওর নাম চিরি। ওর বড় ভাইটা, যার নাম ইরি, এইমাত্র বাইরে গেলো ঘরের খাবারের সন্ধানে। বাবা মায়ের শরীর এখন আর আগের মতো চলে না। তাই ইরিই সংসারের খাবারের জোগান দেয়। কয়েকটা ছোটখাটো পোকামাকড় খেলে নৈশভোজটা বেশ ভালোই হয়ে যায় ঝিঁঝিঁ পরিবারের।
রাস্তার ওই ধারে আরেকটা জঙ্গল। ওটা জোনাকিদের। খুদে ঝিঁঝিঁ চিরি ওর মায়ের কাছে গল্প শুনেছে জোনাকিরা নাকি বছর দুয়েক আগে ওদের এই ধারের জঙ্গলটা দখল করতে চেয়েছিলো। মায়ের মুখের বর্ণনা চিরির মনে পড়ে যায়।
-জানিস বাবা, তোর দাদু যখন বেঁচে ছিলেন, তখন যুদ্ধ করেছেন।
-যুদ্ধ কী মা?
-যুদ্ধ হলো স্বাধীনতা লাভের জন্যে লড়াই করা। ওপারের জোনাকিরা একসময় আমাদের জঙ্গলের এই ধারটা দখল করতে চেয়েছিলো।
-তাই নাকি মা?
-হ্যাঁ। তখন তোর বাবার সঙ্গে আমার নতুন বিয়ে হয়। পাঁচ ছয় সপ্তাহের মাথায় ওপারের জোনাকি সর্দার আমাদের জায়গাটা দখল করতে চায়। তখন তোর বড় ভাই ইরি আমার পেটে ছিলো।
-তারপর মা?
-আমরা দিতে চাইনি জঙ্গলটা। কতোদিন ধরে বাস করে আসছি! এতো সহজে দেওয়া যায়? আর আমাদের তো আশপাশে কোথাও যাওয়ারও জায়গা নেই। তাই আমরা ওদের প্রতিবাদ করি।
-প্রতিবাদ কী মা?
-সেটা তুই বড় হলে বুঝবি। তখন জোনাকিরা জোর করে আমাদের জায়গাটা দখল করতে চায়। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তোর দাদু আমাদের হয়ে সব ঝিঁঝিঁ গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেন।
-নেতৃত্ব মানে কী মা?
-আরে বাপ এসব পরে বুঝবি তুই। আগে বড় হ সোনা।
-যুদ্ধে কে জিতেছিলো মা?
-বলতো কে জিতেছিলো?
-জোনাকিরা?
-ধুরর বোকা। ওরা জিতলে কি আর আমরা এখানে থাকতে পারতাম?
-তার মানে আমরা জিতেছি?
-হ্যাঁ
চিরি বুকে কী যেন একটা অনুভব করেছিলো। কিছুটা উচ্ছ্বাস, আনন্দ, বিজয়ের অনুভূতি। এখন আবার সেই আনন্দটা বুকে পেলো সে। মায়ের মুখে শুনেছে এর নাম নাকি স্বাধীনতা। চিরি মনে মনে বলে উঠলো, ‘আহ স্বাধীনতা! তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।’
ইরি ততোক্ষণে খাবার নিয়ে এসেছে। চিরির ধ্যান ভাঙলো। মায়ের ডানার ওম থেকে বেরিয়ে এলো শীত শীত আমেজের পরিবেশে। কেবল পাঁচটা ছোট ছোট পোকা এনেছে ইরি। চিরিকে দেওয়া হলো দুটো।
চিরি ভাবলো, হয়তো বৃষ্টির পরে এখন সবাই নিজের ঘরে ফিরেছে। এতো ঠাণ্ডায় কে বাইরে থাকতে চায়! নইলে আরো হয়তো কয়েকটা পোকা জুটত চিরির কপালে! ভাবনা বাদ দিয়ে এবার খেতে লাগলো চিরি। খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।
জোনাকি না? হ্যাঁ জোনাকিই তো! ওর দিকেই তো আসছে। চিরির ভয় হতে লাগলো। মনে পড়ে গেলো দুবছর আগের কথা। যুদ্ধের কথা! বাবা মা আর ইরি ভাইয়া ওপাশে খাচ্ছে। ওদের কি ডাক দেবে চিরি? জোনাকিরা কি আবার যুদ্ধ করতে এসেছে ওদের সঙ্গে? ও কি যুদ্ধ করতে পারবে? আচ্ছা যুদ্ধ কীভাবে করে? ভাবতে ভাবতেই ছোট জোনাকিটা চিরির পাশে এসে বসলো।
চিরি দেখলো জোনাকিটা অনেক সুন্দর। এতো সুন্দর যে চিরি ভাবতে পারলোনা যে এই জোনাকিটা ওর শত্রু হতে পারে। চিরি কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। ছোট জোনাকিটা উজ্জ্বল আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বললো, তোমার কাছে কিছু খাবার হবে? আমার বাসার সবাই বাইরে বেড়াতে গেছে আমাকে না বলেই। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাসায় কেউ নেই। আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। বাইরে কোথাও কিছু পেলাম না। তোমাকে খেতে দেখে এদিকে আসলাম।
চিরির মনে কোনো হিংসা জায়গা পেলো না। বরং ওর মতো ছোট এই জোনাকিটার প্রতি বেশ মায়া হলো। ওকে একটা পোকা খেতে দিলো। দুজনে একসঙ্গে খেতে খেতে অনেক গল্প করলো। চিরি বললো-
-আচ্ছা তোমার নাম কী?
-আমার নাম দপঝপ।
-অ্যাঁ! দপঝপ! এটা আবার কেমন নাম?
-আমার বাবা দিয়েছে নামটা। আমাদের জোনাকিদের আলো জ্বলে আর নেভে। তুমি মোমবাতি দেখেছো? মোমবাতির আলো যখন নেভে তখন দপ করে শব্দ হয়। আর যখন জ্বালানো হয় তখন দিয়াশালাইয়ে ঝপ করে শব্দ হয়। সেটা ভেবেই বাবা আমার নাম দিয়েছে দপঝপ।
চিরি দপঝপের কথা মন দিয়ে শুনলো। শুনে অবাক হলো। আসলেই তো, নামটার সঙ্গে বেশ মিল আছে জোনাকিদের। তবে কি সব জোনাকির নামই দপঝপ? চিরি জিজ্ঞেস করলো-
-তোমাদের সবার নামই কি দপঝপ?