বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, স্ত্রীর আত্মহত্যা
  •   ভারতকে কড়া বার্তা শ্রম উপদেষ্টার
  •   আধুনিক নৌ টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে চাঁদপুরে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা
  •   ডাকাতিয়া নদী ও সিআইপি অভ্যন্তরস্থ খাল খননসহ ৫ দফা দাবিতে সংগ্রাম কমিটির সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

পাগল রাফি

জালাল উদ্দীন ইমন
পাগল রাফি

আজ রাফির টেস্ট পরীক্ষা শুরু। আব্বুর আগে থেকেই কড়া শাসন ঘরের বাইরে দেখা মানেই আব্বুর এক গাদা ঝাড়ি আর বকাঝকা খাওয়া। যদিওবা এসএসসি পরীক্ষার আরো দুইমাস বাকি। এখন থেকেই নিঃশ্বাস না নেয়ার মতো অবস্থা। দৈনিক রুটিন মাফিক কার্যক্রম চলছে। ভোর তিনটায় ঘুম থেকে ওঠা সময়মতো ফজরের নামাজে যাওয়া, আধা ঘণ্টা কোরআন তেলাওয়াত, পনেরো মিনিট সকালের নাস্তা। বাকি সময় পরীক্ষার হলে প্রবেশ না করা পর্যন্ত হাতে বই থাকবে। হল থেকে আসার বাকি সময়টাও পড়ার টেবিলে কাটাতে হবে। মাঝে মাঝে ফাঁকি দেয়াটা মোটেও তার জন্য সুফল বয়ে আনে না। বাড়ির ছোটোরাও তার শত্রু। আব্বু আসা মাত্রা গোয়েন্দাগিরি করে পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে দেয়াই তাদের একমাত্র মহৎকর্ম। তবে রাফির মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় গোয়েন্দা সদস্যদেও মতো কিছু করতে। কিন্তু রাফি এই মুহূর্তে অসহায়। আব্বুকে বাড়িয়ে বলার অভ্যাস বেশি গোয়েন্দাদের।

এইতো গতো ক’দিন আগে কী একটা আস্তে করে চড়ো দিয়েছে। আব্বু আসা মাত্রই কতো ঢঙ করে ইনিয়ে বিনিয়ে লাগিয়েছে যে শুনলে আশি বছরের বৃদ্ধলোকও অবাক হবার কথা। ওদের ভুল কখনো ধরা পড়ে না যতো ভুল সব রাফির ঘাড়ে চাপা রয়েই যায়। অবশেষে রাফির এমন অবস্থা চলতে চলতে পরীক্ষার হল নামক জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো প্রায় পঁচিশ দিন পর। এই দিনগুলো কিভাবে কাটিয়েছ তা ভাবতেও কষ্ট হয়, চোখের জলে সাগর টগবগ করে। যাই হোক, আপাতত কয়দিন রেস্ট নেয়া যাক। কিন্তু যেখানে আব্বু নামক কর্তাব্যক্তির বসবাস সেখানে ছাত্রছাত্রী নামক নিরীহ অসহায় প্রাণীদের নিস্তার নেই। এখন পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। নতুন ডায়লগ আব্বুর মুখে অনবরত জিকির শুরু হয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষার ডেট পড়ে গেছে। আর এক মাস এতোদিন বা অতোদিন আছে, প্রতিদিনই ডেট কয়দিন আছে এই নিয়ে তার মুখে জিকির থাকে। পরীক্ষাতে এ প্লাস তোকে আনতেই হবে। আসলে আব্বুর অনেক বড়ো স্বপ্ন যে তার ছেলে এ+ পাবে। তিনি যেহেতু লেখাপড়া করেন নাই, তাই না করার কষ্ট কী সেটা তিনি হারে হারে টের পেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। তাই চোখের সামনে তার ছেলে ভারি কাজ করবে, কষ্ট পাবে- এমন অবস্থা কোনো পিতা-মাতারই কাম্য নয়।

তাই ছেলেকে নিয়মিত লেখাপড়া করিয়ে মানুষ বানাতে চান। এক্ষেত্রে তার স্বার্থহীন প্রচেষ্টা, সে প্রায়ই বলে সন্তানদের আয় রোজগার করা টাকা দিয়ে চলার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই। তোমরা নিজেদের রোজগারের টাকা দিয়ে নিজেরাই প্রাসাদ তৈরি করো। তবুও আমাকে একটা টাকাকড়ি দিতে হবে না। যতোদিন আমার দুই হাত-পা চলে, ইনশাআল্লাহ।

প্রায়ই এই গান প্রতিদিনকার মতো শুনতে শুনতে তাদের শোনার আর আগ্রহ নেই। কান পাতে না এখন তার ঐ নীতিবাক্যে। অসহ্য হওয়ার মত অবস্থা। এটা এক প্রকার অত্যাচার মনে হয় পরিবারের সদস্যদের। অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর পরীক্ষা নাকের ডগায় চলেই এলো। এই মুহূর্তে ঘুম খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি, অর্থাৎ পড়া ছাড়া বাকি কাজগুলোর স্থান মোটেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দিনরাত পড়তে পড়তে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে সে এক অন্য জগতে বসবাস করছে। তবুও এমন হাজারো কষ্ট সহ্য করার পর আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ কৃপায় ইতোমধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। রাফির সাথে পরীক্ষা দেয়া বাকিদের মধ্যে চরম উত্তেজনা এমনকি তাদের দেখে মনে হচ্ছে, তারা একটি রাজ্য জয় করেছে। আজ সবার মুক্ত পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করছে। আকাশের মুক্ত বাতাস হৃদয়ছোঁয়া চারদিকে নির্মল হাসির ঘ্রাণ। হইহল্লা করে যেখানে খুশি ঘুরবে। নানারবাড়ি, খালার বাড়ি- কয়দিন ঘুরবে তা পরীক্ষার ফাঁকে রুটিন করা হয়ে গেছে। তখন শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিলো। আজ আমণ্ডছালা দু’টোই তাদের হাতের মুঠোয়। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাফির মুখে তেমন কোনো প্রকার উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ তার বাবা এমন সুযোগ সুবিধা থেকে একশো গজ দূরে। খুব কড়া শাসনে তার জীবন অতিবাহিত হয়েছে।

কে জানতো, তার বাবা আরেক নতুন ফন্দি আগে থেকে ফাইনাল করে রেখেছেন। সবাই তাকে দেখে ঠাট্টা তামাসা করতো। করবেই তো, এ যুগের ছেলে হয়ে এমন আচরণ চালচলন, ঠাট্টা-তামাসা করা আবশ্যক। নিজ ইচ্ছায় কোনো কাজ করতে পারেনি। তার আশা স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা মূল্যহীন পরিবারের কাছে। ইচ্ছেমতো কোনোদিন চুলও কাটতে পারেনি, গায়ের জামা একদম সহজ ঢিলেঢালা। সবার মতো স্টাইল করে চলতে তারও ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই ইচ্ছা বাবার সমাজে মূল্যহীন। অবশেষে তাকে নতুন আরেক জেলখানায় আব্বু সত্যি সত্যি ভরে দিলো তা হলো, শহরে গিয়ে বড়ো ভাইয়ের বাসায় থেকে কম্পিউটার শেখা আর স্পিকিং ইংলিশ, ইংরেজিতে কথা বলতে শেখায় এমন এক প্রতিষ্ঠানে আব্বু নিজে এসে আসামির মতো ভরে দিলো। সত্যি কথা বলতে আব্বু চায় না যে সে এক মিনিট সময়ও অহেতুক পার করুক। কিন্তু পোড়া কপালের বড়ো ভাইয়ের এখানে এসেও নিস্তার নেই। যতো খেলাধুলা ঘোরাঘুরিতে বড়োভাই নিজস্ব সময় পার করে। এ ক্ষেত্রে রাফির মনে হয় বড়োভাই তাকে বাসার পাহারাদার হিসেবে ব্যবহার করছে।

ভর্তি করানো প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া ছাড়া বাকি সময়ে বাসার বাইরে যাওয়া মহাভারত অশুদ্ধ। আব্বুর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলেও নতুন করে বড়ো ভাইয়ের অত্যাচার অসহ্যকর অবস্থা। বাসার হাঁড়িপাতিল থেকে রান্নাবান্না যাবতীয় কাজ রাফিকেই করতে হয় মাঝে মাঝে বড়োভাই থাকলে নেতাগিরি করে তার ওপর। এমন চলতে পরীক্ষার রেজাল্টের ডেট পড়ে গেলো আগামী মাসের সাত তারিখ। বলতে গেলে এটা আরেক জীবন-মরণের প্রশ্ন এ প্লাস পেতেই হবে। না হলে আব্বু বড়োভাই দুই শাসক কী অবস্থা করে আল্লাহই জানে। ডেট শোনার পর থেকে তার মনে এক ধরনের ভয়ভীতি বিরাজ করছে। নামাজ কালাম পড়ে মুনাজাতে একবার এ প্লাসের জন্য কতো কাকুতি-মিনতি। অবশেষে কিছুদিন পার হলো কিন্তু যতোদিন পার হয় ততো তার ভেতরে উত্তেজনা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে।

আজ রেজাল্ট প্রকাশিত হবে, বড়ো ভাই ঘুরাঘুরিতে ব্যস্ত। তার দোষ ধরবার মতো কেউই এখানে বাস করে না। আব্বুর কাছে সে একজন সুফি শান্ত নিরীহ প্রকৃতির বেশে চলাফেরা করে। এই মুহূর্তে বড়োভাই বাসায় নেই। বড়োভাই স্মার্ট মোবাইলটি নিয়ে বাহাদুরি করে। বাটন মোবাইলটা বাসায় প্রায় সময়ই পড়ে থাকে। স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে সহপাঠীদের কিছু নাম্বার নোট করে নেয়া হয়। কারণ পরীক্ষার পর কে কোন দেশে চলে যায় তার কোনো ঠিক নেই। খাতা থেকে চট করে নাম্বার তুলে এক সহপাঠীকে তাৎক্ষণিক কল দেয়া হলো। সেতো খুশিতো আত্মহারা তার খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে। এ প্লাস পায়নি, তবে সে এমন আশাও করে না। রাফির পরীক্ষা তার চাইতে অনেক বেশি ভালো হয়েছিলো সে হিসেবে। রাফির কিছুটা আশা করা যাচ্ছে যে এ প্লাস আসতে পারে। কিছুটা চিন্তামুক্ত হলো। হঠাৎ বড়ো ভাই তার রেখে যাওয়া বাটন মোবাইলে কল দিয়ে কড়া গলায় রাগের ভঙ্গিতে বললো, এই রাফি তুইতো এক বিষয়ে ফেল করেছিস। তোর জন্য আব্বু আমাকেও গালাগালি করছে তোকে ঘরে ফিরতে বারণ করেছে। আমার বাসায় আব্বু আসছে কি করে বসে আল্লাহই জানে। রাফি হতভম্ব হয়ে হতাশভাবে মাটিতে লুটে পড়লো আকাশ যেন তার মাথার ওপরে চড়ে আছে মনে হচ্ছে। বুকের ভিতরে এক ধরনের চরম কষ্টের ব্যথা অনুভব করছে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু এটাতো নেহাত পাপকর্ম!

একপর্যায়ে সে পাগলের মতো বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় গেলো কেউ জানে না। দুই মাস পর খুঁজতে খুঁজতে এক বস্তির গলিতে তাকে পাগল অবস্থায় পাওয়া গেলো। তার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলো। পাগল হয়েও সে সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। মা রাফির এই অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তার রেজাল্ট তেমন বেশি খারাপ হয়নি প্রায় ছয় সাবজেক্টে এ প্লাস, এক সাবজেক্টে অকৃতকার্য। সেটা বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়। তার কারণ রাফি বিষয় কোড ভুল করেছিলো। বাকি সাবজেক্টে এ গ্রেড আর এ মাইনাস গ্রেড পেয়েছিলো। তবুও দারুণ একটা রেজাল্ট হয়েছিলো।

এখন সে বাড়িতেই থাকে। সারাক্ষণ শুধু আউলাঝাউলা বকে। পাগলরা যা করে আরকি! অনেক পাগল আছে ইচ্ছেমতো রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সে সুযোগও রাফির নেই। পাগল হয়েও তার বন্দিদশার অবসান হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়