প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
হরিণ ও শিয়ালের বন্ধুত্ব
এক বনে একটি হরিণ এবং একটি শিয়াল বাস করতো। তারা দু’জনেই খুব ভালো বন্ধু ছিলো। দু’জনেই প্রায়ই একসাথে থাকতো এবং ঘুরে বেড়াতো। শিয়ালের একটি বাজে স্বভাব ছিলো, রাত হলে সে মানুষের হাঁস-মুরগি চুরি করে খেতো এবং হরিণকে এসে সেটা বলতো। হরিণ সবসময় নিজের বন্ধু শিয়ালের ভালো চাইতো, তাই সে শিয়ালকে এভাবে মানুষের হাঁস-মুরগি চুরি করতে নিষেধ করতো।
একদিন শিয়াল এসে হরিণকে বললো, ‘জানিস বন্ধু, গত রাতে পাশের গ্রামের একজনের বাড়ি থেকে সদ্য বাচ্চা ফুটানো একটি মুরগিকে তার বাচ্চাসহ খেয়েছি। কী স্বাদ! এতো হাঁস-মুরগি চুরি করে খেয়েছি, কিন্তু গত রাতের মতো তৃপ্তি কখনোই পাই নি। প্রতিদিন যদি এরকম বাচ্চাসহ মুরগি খেতে পারতাম!’
শিয়ালের কথা শুনে হরিণ মোটেও খুশি হয়নি; বরং সে শিয়ালকে বললো, ‘বন্ধু, এভাবে মানুষের হাঁস-মুরগি চুরি করা তোমার উচিত নয়। তোমার জন্য তো বনের মধ্যে ঘাস, ফলমূল আছে সেগুলো খাও, তাছাড়া তুমি পাখি শিকার করেও খেতে পারো। লোকালয়ে গিয়ে চুরি করার কী দরকার? মানুষের কষ্ট করে পালিত নিরীহ হাঁস-মুরগি চুরি করে খেয়ে তুমি আনন্দ পাও কিভাবে? তোমার এই কাজগুলো যে চরম অন্যায় তুমি কি তা বোঝ না? আর তাছাড়া লোকালয়ের মানুষ যদি তোমাকে একবার ধরতে পারে, তখন তারা তোমাকে ছেড়ে দিবে না। এখনও সময় আছে
সাবধান হও এবং এসব অন্যায় ছেড়ে দাও।’
হরিণের কথা শুনে শিয়াল হাসতে হাসতে বললো, ‘তুমি সারাক্ষণ আমাকে এতো জ্ঞান দাও কেন? আমি কি নিজের ভালো নিজে বুঝতে পারি না? আমার যা মন চায় খেতে আমি তাই খাব। বনের এসব অখাদ্য খেতে আমার ভালো লাগে না। আর লোকালয়ের বোকা মানুষগুলো আমাকে কোনো দিন ধরতে পারবে না। আর আমার এই কাজগুলো যদি তোমার ভালো না লাগে, তাহলে আমার থেকে দূরে থাকো। সারাক্ষণ তোমার এসব জ্ঞানের বাণী শুনতে আমার ভালো লাগে না।’
শিয়ালের এসব কথা শুনে হরিণের মুখ মলিন হয়ে গেলো, সে বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি যখন চুরি ছাড়বে না, তখন আমিই তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তবে মনে রেখো, তোমার চুরির কারণে শিগগিরই তুমি খুব পস্তাবে, সেদিন কাউকে পাশে পাবে না।’
সেদিন রাতে শিয়াল যখন গ্রামে চুরি করতে গেলো; তখন গ্রামের লোকজন তাকে ধরে ফেললো। আসলে গ্রামের লোকজন আগে থেকেই সতর্ক ছিলো এবং শিয়ালকে ধরার জন্য ওঁৎ পেতে ছিলো। ধরা খেয়ে শিয়ালের অবস্থা তো খারাপ, সে ভাবতে লাগলো যে আজকে তো আমার নিস্তার নেই। শিয়ালের মনে হলো তার বন্ধু হরিণই গ্রামের মানুষদেরকে তার চুরি করার খবর দিয়েছে। এদিকে লোকালয়ের মানুষ বলাবলি করছে যে আজকেই তারা এই শিয়ালকে হত্যা করবে, তা না হলে এই শিয়াল তাদের হাঁস-মুরগি চুরি করতেই থাকবে।
শিয়াল তখন গ্রামের লোকদের উদ্দেশ করে বললো, ‘দেখুন, আপনারা আমাকে হত্যা করতে চান, করুন। তবে আমাকে হত্যা করার পূর্বে আমার চুরি করার পিছনের কারণ আপনাদের জানা উচিত।’
গ্রামের লোকজনের মধ্যে হইচই পড়ে গেলো যে শিয়ালের চুরি করার পিছনে আবার কী কারণ থাকতে পারে। গ্রামের একজন বলে উঠলো, ‘এই শিয়ালকে তো আমরা কিছুক্ষণ পর হত্যাই করবো। মৃত্যুর পূর্বে ও কী বলতে চায়, শুনি।’ গ্রামের সবাই লোকটির কথায় সম্মতি জানালো এবং শিয়ালকে কথা বলার সুযোগ দিলো।
শিয়াল তখন কেঁদে কেঁদে বললো, ‘আসলে আমি কখনোই চুরি করতাম না। বনের ভিতর খাবারের কি অভাব আছে যে আমি লোকালয়ে এসে এতো কষ্ট করে চুরি করতে যাবো! আমার বন্ধু, হরিণ একদিন আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো যে ওর বাবাকে নাকি লোকালয়ের মানুষ শিকার করে মেরে ফেলেছে। ও তখন আমাকে বললো যে ওর তো ক্ষমতা নাই লোকালয়ের মানুষদের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার, আমি যেন আপনাদের হাঁস-মুরগি চুরি করে খেয়ে ফেলি, তাহলেই ওর প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। আমার বন্ধুকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। তাই ওর কথামতো এভাবে আপনাদের হাঁস-মুরগি চুরি করতে শুরু করলাম। এখন আপনারা আমাকে হত্যা করেন, সমস্যা নাই। কিন্তু দয়া করে আমার বন্ধু হরিণকে তার বাবার মতো হত্যা করবেন না।’
গ্রামের লোকজন শিয়ালের কথা বিশ্বাস করলো এবং তাদের মধ্যে একজন লোক শিয়ালকে বললো, ‘তুমি যদি তোমার বন্ধুকে ধরিয়ে দিতে পারো, তবেই আমরা তোমাকে ছেড়ে দিবো। আর যতদিন আমরা তোমার বন্ধুকে ধরতে না পারি, ততদিন তুমি আমাদের কাছে বন্দি থাকবে।’
শিয়াল তখন রাজি হলো এবং সে গ্রামের লোকজনকে হরিণ কোথায় থাকে এবং কখন কোথায় যায় সব বলে দিলো। কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রামের লোকজন হরিণকে ধরে ফেললো এবং শিয়ালের নিকট নিয়ে এলো। হরিণ যখন জানতে পারলো যে তার বন্ধু শিয়াল তাকে মিথ্যা কথা বলে ফাঁসিয়ে দিয়েছে তখন সে খুব ব্যথিত হলো। সে গ্রামের লোকজনকে বললো, ‘আপনারা শিয়ালকে হত্যা করার পূর্বে ওর সকল কথা শুনলেন। তাহলে আমাকে হত্যা করার পূর্বে আমার কথাগুলোও শুনেন।’
গ্রামের লোকজন শিয়ালের মতো হরিণকেও কথা বলার অনুমতি দিলো। হরিণ তখন বলতে শুরু করলো, ‘আমার বন্ধু শিয়াল যে বললো আপনারা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছেন এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আসলে আমার বাবা আমার জন্মের পর আমাকে আর আমার মাকে ছেড়ে পাশের বনে চলে যায়। পরে শুনেছি, আমার বাবাকে পাশের বন থেকে চিড়িয়াখানার লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। আপনাদের বিশ্বাস না হলে আপনারা চিড়িয়াখানায় গিয়ে খবর নিতে পারেন।’
গ্রামের এক বিজ্ঞ লোক বলে উঠলো, ‘হরিণ ঠিক কথা বলেছে। কয়েক বছর আগে শহর থেকে চিড়িয়াখানার লোকজন এসে পাশের বনের অনেক পশুপাখিকে ধরে নিয়ে গেছে। আর তাছাড়া আমরা মাঝে মাঝে যে হরিণ তো এই বনের দক্ষিণ পাশ থেকে শিকার করে খাই, দক্ষিণ পাশে হিংস্র বাঘ-সিংহ কম থাকে তাই। শিয়াল বলেছিলো এই হরিণ এবং তার পরিবার থাকে বনের উত্তর পাশে, ওখানে তো আমরা কখনোই যাওয়ার সাহসও করি নাই। আজকে ও যদি ওর বন্ধু শিয়ালকে খুঁজতে আমাদের গ্রামে না আসতো তাহলে তো আমরা ওকে কখনোই ধরতে পারতাম না।’
গ্রামের লোকজনের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে শিয়াল তাদের মিথ্যা কথা বলেছে। গ্রামের প্রধান তখন রাগান্বিত হয়ে ধূর্ত শিয়ালকে হত্যা করার নির্দেশ দিলো। তিনি হরিণকে বললেন, ‘দুঃখিত! আমরা আসলে না বুঝেই তোমাকে ধরে এনেছি। তোমার বন্ধু তোমাকে মিথ্যা কথা বলে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অথচ তুমি সেই বন্ধুকে খুঁজতে নিজের জীবনের পরোয়া না করে লোকালয়ে চলে এসেছো। তোমার এই উদারতা সত্যিই প্রশংসনীয়! যদিও আমরা মানুষেরা জীবিকার তাগিদে হরিণ শিকার করি। তবে আমরা তোমাকে হত্যা করবো না। তোমার বেঁচে থাকার দরকার আছে।’ অতঃপর তিনি হরিণকে মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।
এদিকে হরিণের চলে যাওয়া দেখে শিয়াল হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘বন্ধু, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো! তুমি না আমাকে খুঁজতে এই গ্রামে এসেছো? তুমি এদেরকে অনুরোধ করলে এরা আমাকে মুক্ত করে দিবে। আমি আর কখনোই চুরি করবো না, বন্ধু।’
হরিণ তখন গম্ভীর কণ্ঠে শিয়ালকে বললো, ‘আমি আমার চোর বন্ধুর জন্য লোকালয়ে এসেছি, বিশ্বাসঘাতক শত্রুর জন্য নয়। আমি চোরকে ভালো হওয়ার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ দিতে পারি; কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে নয়।