প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
হঠাৎ
ভদ্রলোকের সাথে অনেকদিন পর দেখা। দেখলাম খুব বিষণ্ণ হয়ে আছেন। বললাম ভাই, কী মন খারাপ নাকি? জবাব দিলেন, মনও খারাপ, শরীরটাও ভালো নেই। ভাবলাম, এই ৩৮ ডিগ্রি গরমে রোজা রেখে একটু তো কাহিল হবেনই। কিন্তু দেখলাম, উনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন। বললেন, ভাই ছেলেমেয়ে গুলো মানুষ হয়নি, খুবই মনোকষ্টে আছি। কেউ এ ধরনের কথা বললে আমি অসহায় বোধ করি। কারণ ভেতরে অনেক দুঃখ থেকেই মানুষ এ ধরনের কথা বলে।
কিন্তু কি বলে সান্তনা দিব তা বুঝতে পারি না। হয়তো উনি নিজের দায়িত্ব পালন করেননি ঠিকমত। হয়তো বাবা মা দুজনেরই দোষ আছে। হয়তো পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে সন্তানগুলো খারাপ হয়ে গেছে। আমি তো আসলে কিছুই জানি না। ভদ্রলোক নিজে থেকেই কথা বলে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ শুনার পর জিজ্ঞেস করলাম, বোঝাবার চেষ্টা করেননি? বললেন, না, বুঝাবার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। চেষ্টা করা ছেড়ে দিয়েছি। বললাম, চেষ্টা করে যে লাভ নেই এই সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে ফেললেন! দোয়া করেন সন্তানদের জন্য? বললেন, না দোয়া করেও কোন লাভ নেই, অনেক দোয়া করেছি। দেখলাম, লাভ লোকসানের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে ফেলেছেন।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে কিছু বলে তেমন লাভ হয় না। তবু ভাবলাম সমস্যার কথা যেহেতু আমাকেই বলেছেন, কিছু কথা বলি। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই বাচ্চাদের কি নামাজ পড়তে শিখিয়েছিলেন? কিন্তু আমি জানি যে ওদের বয়স ২০-২২ বছর। বললেন, না, আমি সেভাবে শিখাইনি, ভেবেছি বড় হলে নিজেরাই পড়বে।
বললাম ভাই, কিছু কথা বলি। এতে হয়তো আপনার মনটা আর একটু খারাপ হবে কিন্তু অন্যের উপর দোষ চাপাবার ইচ্ছাটা চলে যাবে। বাচ্চাদেরকে মানুষ করার ব্যাপারে আপনি কখনোই ধর্মকে গুরুত্ব দেননি। বাচ্চাদেরকে নামাজ শেখানোর ব্যাপারটাও আপনার কাছে কখনোই গুরুত্ব পায়নি। অথচ, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজে বলেছেন, নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে। সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫। সন্তানদের নামাজি বানানোর চেয়ে উত্তম কোন কাজ কি একজন পিতা করতে পারেন? আপনি নামাজি বানিয়ে ছেড়ে দিতেন। তারপর আল্লাহকে বলতেন, হে আল্লাহ, আপনি বলেছেন নামাজি বানানোর জন্য, আমি চেষ্টা করেছি, বাকি আপনি দেখবেন। কিন্তু আপনি তো সে চেষ্টাই করেননি। বিখ্যাত ইংরেজ কবি এবড়ৎমব ঐবৎনবৎঃ এর একটি অমর উক্তি আছে, ‘একজন পিতা ১০০ জন শিক্ষকের চেয়ে উত্তম’। আপনি কি পিতার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছেন? কী মনে হয় আপনার?
এবার আসুন আপনি প্রথমে যেটি বলেছেন যে, দোয়া করা ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ কাজ হয় না। অথচ ইবনে মাজার একটা হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, পিতার দোয়া (আল্লাহর নূরের) পর্দা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তার মানে বুঝতে পারছেন তো? এই মহাবিশ্বের কোনো কিছুই পিতার দোয়ার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সন্তানের জন্য পিতার দোয়া এতটাই শক্তিশালী। আর একটি হাদিসে তিনি বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং সন্তানের জন্য পিতার দোয়া। দেখলাম ভদ্রলোকের চোখ ছল ছল করছে। বললাম ভাই, আপনার মন খারাপ করার জন্য এগুলো বলিনি। বরং আপনার কথার ভেতরে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছি অন্যকে দোষারোপ করার। দোষারোপ করে তো কোনো লাভ নেই। যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারে শুধুমাত্র দোয়া। কারণ আপনি তো বলেছেনই আপনি সব ধরনের চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী চেষ্টাটা বাদ দিয়ে গেছেন! রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন যে দোয়া এত শক্তিশালী জিনিস যে এটি ভাগ্যে নির্ধারিত জিনিসকেও বদলে দিতে পারে। কেন এত শক্তিশালী একটি অস্ত্র প্রয়োগ করবেন না।
আর শেষ কথাটা হচ্ছে, আপনি যদি কষ্টে থেকে থাকেন তাহলে অতি অবধারিত একটা কথা মনে রাখবেন যে, আল্লাহ বলেছেন, কষ্টের সাথেই স্বস্তি থাকে, নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি থাকে। সূরা ইনশিরাহ, আয়াত ৫-৬।
ভদ্রলোক চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।
২. বেশ ক’জন ছেলে দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিল। হাতে সময় থাকলে পাঁচ দশ মিনিট ওদের সাথে কথা বলতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের ভেতর কে কে বলতে পারবে এমন একটি ইবাদতের কথা যাতে কোনো পরিশ্রম নেই। এক একজন এক একটা বললো। কেউ বললো, মনে মনে সুবহানাল্লাহ পড়া, কেউ বললো, কারো দিকে তাকিয়ে হাসা। বললাম, এগুলো সবই উত্তম কাজ। কারণ, সুবহানাল্লাহ পড়ার উপকারিতার কথা তো আমরা জানিই, আবার হাদিস অনুযায়ী, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসাও সাদাকার অন্তর্ভুক্ত। তবে সবগুলোতেই কিন্তু কষ্ট আছে, যত কমই হোক। আমি বলছি একেবারেই পরিশ্রমবিহীন একটি ইবাদতের কথা। তারা বললো, আপনি বলুন। বললাম, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন মান সমাতা, নাজা। অর্থাৎ যে চুপ করে থেকেছে সে নাজাত পেয়েছে। চুপ করে থাকাটাই হচ্ছে পরিশ্রমবিহীন একটি ইবাদত। প্রথমত: চুপ করে থাকলে আমি কোন গুনাহ করছি না এবং দ্বিতীয়ত: সেই চুপ করে থাকার কাজটি যদি হয় সুন্নাহ মনে করে তাহলে চুপ করে থাকার পুরোটা সময় সওয়াব লিখা হবে।
এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। যারা নিজের মতামত প্রকাশ করতে খুবই আগ্রহী এ ধরনের লোকদের কাছ থেকে আপনি প্রায়শই শুনতে পাবেন, ভাই, ঐ লোক তো ঘুষ খায়, অথবা, ওতো অনেক মিথ্যা কথা বলে, বা, ওতো গিবত করে; ভালো কাজ করে এদের কী লাভ? তার নামাজ কি হবে? তার দান করে কি আল্লাহ গ্রহণ করবেন? এসব কথার উত্তরে আপনি কী বলবেন? আল্লাহর কাছে এদের দান গ্রহণীয় না হওয়ার সম্ভাবনা তো যথেষ্টই আছে।
কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ পবিত্র এবং পবিত্র ছাড়া অন্যকিছু গ্রহণ করেন না। কিন্তু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি আমি ভিন্ন কারণে। ঠিক আছে, তার দান, নামাজ আল্লাহ গ্রহণ করলেন, বা করলেন না। তাতে আমার কী! আমি তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন সদস্য নয় যে এগুলো দেখার দায়িত্ব আমার উপরে। বরং, এদের চিন্তা বাদ দিয়ে আমার উচিত নিজের কথা ভাবা। মহান প্রভু কিন্তু এই কথাই বলেছেন। *হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে। সূরা তাহরিম আয়াত ৬। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? অন্য লোক কি করছে না করছে সেটি দেখার চাইতে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেকে আগুন থেকে রক্ষা করা এবং একই সাথে নিজের পরিবার পরিজনকে রক্ষা করা। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভুলে গিয়ে আমরা খুঁজতে শুরু করি অন্য লোকের দোষ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের বোঝার তৌফিক দিন।