প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র
অস্ত্র ছাড়াও যে যুদ্ধ হতে পারে বিষয়টা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি নাদিম আর রেহান। একটু নড়েচড়ে বসল ওরা দু’জন। ছোটমামা একনাগাড়ে বলে চলেছেন-
‘শোন, মানুষ অনেক সময় সম্মুখযুদ্ধ না করে কৌশল খাটিয়েও কার্য হাসিল করে থাকে। প্রয়োজনে দুষ্ট লোকেরা নিকৃষ্টতম পন্থা বেছে নিতেও দ্বিধাবোধ করে না। তোরা হয়তো স্নায়ু-যুদ্ধ, রাসায়নিক যুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধের কথা শুনে থাকবি, আজ আমি তোদের বলব ভাইরাস যুদ্ধের কথা।’
‘ভাইরাস যুদ্ধ!’ সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে নাদিম আর রেহান।
নাদিম আর রেহান একই ক্লাসে পড়ে। নাদিমের ছোটমামা খুবই মজার মানুষ। ছেলেবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস তার। একসময় নিজেও লেখালেখি করতেন। একটা উপন্যাসও বের করেছিলেন, কিন্তু সেভাবে নাম করতে পারেননি। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে এখন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি একটা জাতীয় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। সে হিসেবে এখনো লেখালেখির সংস্পর্শেই আছেন। ছোটমামা নাদিমের বাবার ব্যবসায়-বাণিজ্য খুব একটা পছন্দ করেন না।
একদিন কোন এক বিষয় নিয়ে দুলাভাইয়ের সাথে কথা কাটাকাটি করে নাদিমদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ছোটমামা শফিক। তারপর আর কখনো তিনি ওদের বাড়িমুখো হননি। নাদিমের বাবা বিভিন্ন পণ্য দেশের বাইরে থেকে আমদানি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে থাকেন। কাজের প্রয়োজনে তাকে মাঝে মধ্যে চীন, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যেতে হয়। অনেক সময় আবার বিদেশী পার্টনাররাও আসেন নাদিমের বাবার কাছে। নাদিমের বাবার হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া নিয়ে এলাকার অনেকেই কানাঘুষা করে থাকেন।
প্রতি শুক্রবার বিকেলে নাদিম আর রেহান সাইকেল নিয়ে হাজির হয় ছোটমামার ডেরায়। পুরো ঘর তার নানান বই-পুস্তকে ঠাসা। ওরা দু’জন দুইটা বই ফেরত দিয়ে সীমান্ত আকরামের ‘রাতুলের সাইকেল’ আর শামস সাইদের ‘রেজা স্যার ও চার গোয়েন্দা’ বই দুটো নিল। তারপর মামার সাথে দীর্ঘক্ষণ জম্পেশ আড্ডা মেরে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরলো।
গভীর রাতে ধাতব কোন শব্দে ঘুম ভেঙে গেল নাদিমের। মনের ভুল ভেবে চোখের পাতাজোড়া পুনরায় একত্র করতেই আবারও সেই একই শব্দ এবং ফিসফাস কথা বলার শব্দ। নাদিম অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে জানালার পর্দা সরাতেই দেখলো ওদের গেটের বাইরে একটা পিকআপ দাঁড়ানো। ওর বাবা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে নিচুস্বরে কথা কথা বলছেন। একটু অবাক হল নাদিম, এত রাতে সাধারণত ওর বাবার সাথে কেউ দেখা করতে আসেন না। একটু পর সে দেখলো দুজন কর্মচারী কয়েকটি কার্টুন পিকআপ থেকে নামিয়ে ওদের গুদামঘরে তুলছে। হয়তো কোন পণ্যের চালান এসেছে। পরদিন সিটি থাকায় বাইরে বের না হয়ে আবার শুয়ে পড়লো নাদিম।
এক সপ্তাহ পর। নাদিম ওর ছোটভাই রাসিমের সাথে খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ গুদামঘরের দিকে বল কুড়াতে গিয়ে নাদিম এক নতুন ধরনের পোকা দেখতে পেল। সাধারণ গুবরে পোকার চেয়ে একটু বড়, গায়ের বর্ণ একেটার একেকরকম। কোনটার ধূসর, কোনটার বাদামি, কোনটা আবার গাঢ় লাল। চৌকাঠের কাছে আরও কয়েকটা পোকা দেখে সিওর হলো গুদামঘর থেকেই বের হচ্ছে ওগুলো, হয়তো কোন শস্যের ভিতর জন্ম নিয়েছে। নাদিম তখনি বিষয়টা বাবাকে জানানো জরুরি মনে করলো। বাবাকে কথাটা বলতেই নাদিমের মনে হলো যেন কথাটা শুনে ওর বাবা একটু চমকে উঠলেন।
তারপর তিনি গুদামের আশপাশে সবাইকে যেতে নিষেধ করলেন। নাদিমের মা এসে জিজ্ঞেস করলে শুধু বললেন, পোকাগুলো হয়তো কামড়-টামড় দিতে পারে। পরদিন তিনি কর্মচারী চারজনের দুজনকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
এর মাসখানেক পরেই প্রথম ধাক্কাটা আসলো। প্রথমে শুধু নাদিমদের এলাকায়, এরপর বিষাদে ছেয়ে গেল পুরো দেশ। দেশের সর্বত্র কৃষিজমিতে নতুন এক পতঙ্গ হানা দিয়েছে। যার ফলে মাটির উর্বরা শক্তি গেছে হারিয়ে। ফসলের গায়ের বর্ণ বিবর্ণসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষেতে গিয়ে উক্ত পোকার কামড়ে কয়েকজন কৃষকের অসুস্থতার কথাও খবরের কাগজে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামও গেছে বেড়ে। অন্যদিকে গুটিকতক অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে লাভবান হলেও মাথায় হাত পড়েছে সাধারণ মানুষের। নাদিমদের এলাকা পেঁয়াজ চাষের জন্য বিখ্যাত হলেও এবার কপাল পুড়েছে পেঁয়াজ চাষিদের। সরকারি কর্তৃপক্ষ রহস্য উদঘাটনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের সর্বত্র আলোচনার বিষয় অচেনা এই নতুন পোকা।
ছোটমামার আখড়ায় এসে নাদিম আর রেহান সেদিন এসব নিয়েই আলোচনা করছিল। ছোটমামাকে এ বিষয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে বলা হয়েছে। ছোটমামা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, দেখ এই সেই পোকা। মাজরা, পামরি, গান্ধী, গলমাছি আর লেদা পোকার ঝাঁক ফসলের গোড়া খেয়ে নিস্তেজ করে দেয়। কখনো আধাপাকা ধানের ছড়া কেটে কৃষকদের মাঝে বপে দেয় নিদারুণ হতাশার বীজ! এর শরীরে বিশেষ ধরনের ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছে কীটতত্ত্ব বিভাগ। যার ফলে এর কামড়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশিতে আক্রান্ত হতে পারেন। অবস্থা গুরুতর না হলেও জ্বরের ধকল রোগীকে দুর্বল করে ফেলে। দুষ্কৃতিকারীরা মাটিতে এত পোকা পুঁতেছে আর এরা এত দ্রুত বংশবিস্তার করে যে খুঁড়ে তুলে শেষ করা অসম্ভব।
পোকার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো নাদিম। এ যে ওদের গুদামের সেই অচেনা পোকা। নাদিমের মানসপটে ভেসে উঠলো সেদিন রাতের আগন্তুকের আগমন এবং গুদামে সংরক্ষিত কার্টনগুলোর ছবি।
তার বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর হিসাব সহজ করে দিলো। তবে প্রকাশ্যে নাদিম কিছুই বলল না। মাগরিবের একটু পূর্বে নাদিমের নানী চা দিতে এসে নাদিমদের থেকে যেতে বললেন। রেহানের কাজ থাকায় ও চলে গেলে নাদিম সাগ্রহেই থেকে গেল। অথচ অন্যদিন হাজার বললেও সে থাকতে রাজি হয়না। বাসায় ফোন দিয়ে নানী মাকে জানিয়ে দিলেন নাদিম আজ থেকে যাবে।
রাতে খাওয়ার পর নাদিম ছোটমামাকে তার সন্দেহের কথা প্রকাশ করল। ছোটমামা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকার পর বললেন, ‘তুই কি নিশ্চিত যে এই পোকাই তোদের গুদাম ঘরে দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ ছোটমামা, আমি নিশ্চিত বাবা সেদিন রাতে কার্টন ভরে এই পোকাই এনেছে দেশের সর্বনাশ করার জন্য। বিষয়টা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে ছোটমামা! আমার বাবা এমন কেন!’
ছোটমামাকে নীরব থাকতে দেখে নাদিম অবাক হয়ে গেল। ছোটমামা তো বাবাকে পছন্দ করে না, তার তো খুশিই হওয়ার কথা!
ছোটমামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারি গলায় বললেন, ‘আমি তোর বাবাকে বহু বুঝিয়েছি, কিন্তু উনি বরাবরই দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থটাই বড় করে দেখেছেন। শেষে ফেরাতে না পেরে তো আমিই রাগ করে চলে আসি। তবে এসব গর্হিত কাজে শুধু দুলাভাই একাই নয় তার সহযোগী আরও অনেকেই আছে। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।’
নাদিম জিজ্ঞাসু নেত্রে মামার দিকে তাকায়। মুখটা তার ভীষণ ভার। আস্তে বলল, ‘কী করতে চাও ছোটমামা?’
তুইতো জানিস আমি ‘আল ফারুক’ ছদ্মনামে বিভিন্ন অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদন তৈরি করে থাকি। এই সর্বনাশা পোকার ষড়যন্ত্রমূলক বিষয় নিয়ে আমি শীঘ্রই একটা প্রতিবেদন দাঁড় করাতে চাই। পত্রিকায় বিস্তারিত রিপোর্ট এলে বাকি কাজটা প্রশাসনই করবে।
নাদিম মুখে বাবাকে পুলিশে দেওয়ার কথা বললেও এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। মামা আলতো করে ওর কাঁধে হাত রাখলেন।
অপরাধী শাস্তি পাবে এটাই স্বাভাবিক, ‘নাদিম। দোয়া করি যেন তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ভুলের প্রায়শ্চিত্ত শেষে নতুন জীবন শুরু করতে পারেন।’
নাদিম চোখের পানি মুছল। বলল, ‘দুঃখিত মামা, কিছু মনে করো না। আমার বাবা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের মত গুটিকতক লোকের দুষ্কর্মের ফলে দেশ আজ ভীষণ বিপদের সম্মুখীন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনে নেমে এসেছে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। এমন চক্রান্ত করে যে বিদেশ থেকে পণ্য এনে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেয় সে দেশের শত্রু। আমিও চাই তার বিচার হোক।’
পরদিন।
আল ফারুক নামক লেখকের বিশেষ কলাম সারাদেশে হইচই ফেলে দিল। সর্বত্র ছি ছি রব ধ্বনিত হলো। মানুষ কিভাবে এত নিকৃষ্ট হতে পারে! নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিদেশ থেকে ক্ষতিকর পোকা এনে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভঙ্গুর করে দেওয়া কি মানুষের কাজ হতে পারে!
নাদিমকে নিয়ে ছোটমামা বহু বছর পর ওদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বিপরীত দিক থেকে পুলিশের দুটি ভ্যান আসতে দেখা গেল। নাদিম উদাস নয়নে পাশ কেটে যাওয়া গাড়ি দুটোর দিকে চেয়ে রইলো।