প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আদিয়া
সেই ছোট্টটি থেকে আদিয়া রোগাটে। না খাওয়া স্বভাব। না খেয়ে একটা বাচ্চা কিভাবে বড় হবে মায়ের দুশ্চিন্তা। আদিয়ার খাওয়ার ব্যাপারটা আম্মু, নানু, আতিয়া আপু ছেড়ে দিয়েছে ওর মর্জির ওপর। শুধু নিয়ম মেনে খাবার সামনে নিয়ে দু’ একবার সাধা-আদিয়া তোমার খাবার- খেয়ে নাও। ব্যস! তাতে কখনও খায়, কখনও ছুঁয়েও দেখে না। খাওয়ার স্বাধীনতা আদিয়ার জন্য সংরক্ষিত।
আদিয়ার বয়স এখন আট। দেখলে মনে হবে, পাঁচণ্ডটাচ। না খাওয়া শরীর লিকলিকে। চেহারা দেখলে মনে হয় একটা বড়ো কেঁচো অতি কষ্টে যেন মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ওর ওজন বোধ হয় একটা প্রজাপতির চেয়ে বেশি হবে না। গায়ের চামড়া ফ্যাকাসে, মাথায় চুল অল্প, একটা ঠ্যাং আবার খাটো, একটু খুঁড়িয়ে চলে। পৃথিবীতে যে জল সমুদ্র দুলে উঠেছে ও যেন তারই একটা ক্ষণস্থায়ী ফেনা। ও একেবারে পলকা, এক্ষুনি যেন মচকে যাবে। ও একটা পাঁপড়-ভাজার চেয়েও পাতলা, বাতাসের ফুঁয়ের কাছে ঝরা পাতার মতোই দুর্বল। থাকার মধ্যে আছে ওর দু’টি চোখ। মায়ামাখা। মায়াহরিণীর মতো। বেশ বড়সড়।
স্কুলের খাতায় ক্লাস থ্রির ছাত্রী। কিন্তু বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের অর্ধেকই কাটে তার বিছানায়। আজ সর্দি, কাল জ্বর, পরশু ব্রঙ্কাইটিস, হাম, ডায়ারিয়া অসুখ ওর লেগেই আছে। তাই স্কুল ওর নাগালের বাইরে। সপ্তাহের সাত দিনই ওর জন্য ছুটির দিন, মানে শুক্রবার। ওর মাথার ওপর রবি ওঠে না। সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে, পচা ভাদ্রের মতো এঁদো, মেঘলা। ওর আট বছরের বালিকা জীবন ঘিরে শীতের কুয়াশা। ওর নিঃশ্বাসের জন্য অক্সিজেন ভরা বাতাস অল্প। একটা কানঢাকা টুপির মতো আকাশ যেন ওকে চেপে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। কী শীত, কী গ্রীষ্মকাল ওর শরীরে একটা গরম সোয়েটার চেপে ধরে আছে। ঘরের দরোজা-জানালা কদাচ খোলা থাকে, ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে পড়ে, ভয়ে। সবুজ ঘাস অনেক দিন ঢেকে রাখলে যেভাবে বিবর্ণ হলদেটে রূপ নেয়, ওর গায়ের রঙও শ্যামলা থেকে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
শহরের সেরা ডাক্তার থেকে হোমিও কবিরাজ, তাবিজ-তুমার, ঝাড়ফুঁক কোনো কিছুই বাদ যায়নি আদিয়ার সুস্থতার জন্য না করা হয়েছে। ওষুধ খেয়ে খেয়ে আদিয়ার জিভ একেবারে কালো হয়ে গেছে। ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন কতো ট্যাবলেট ওর পেটে গিয়ে চর পড়েছে তা আল্লমালুম! দুই বাহু, দুই রানে ইনজেকশনের খোঁচায় জর্জরিত। আগে সিরিঞ্জ দেখলে ভয় পেতো, না না বলতো। এখন ওসব ওর গা সওয়া হয়ে গেছে। রুটিনওয়ার্ক মনে করে নেয়। রোগের দাসত্ব করে করে ওর মেরুদণ্ড গেছে বেঁকে। ওর সমবয়সীরা যখন উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলা করে, শোরগোল করে, মারামারি করে ও তখন একা জানালার পাশে বসে চোখের পানি ছাড়ে। কখনও হাসে। হাততালি দেয়।
মাঝেসাঝে ওর সমবয়সী কেউ এসে খেলতে ডাকলেও দু’হাত দিয়ে তীব্রভাবে না না বলে। ওর গলায় একটা ‘না’-র বখ্লস ঝুলানো। যাও কিছু করতে চায় সবটাতেই আম্মু-আপুমনি হুমকি দিয়ে ওঠে ‘না’। জানালাটা খুলি? না; ঠাণ্ডা লাগবে। একটু পড়ি? না; মাথা ধরবে। একটু রাস্তায় যাই ?
না; গাড়ি চাপা পড়বে। স্কুলে যাই?
না; আজ গা গরম।
এই আট বছর বয়সে আদিয়া কোনদিন টক জাতীয় ফল খায়নি। বাড়িতে বরইগাছ একটা। ফুল থেকে ফল বের হওয়া থেকে পাকা পর্যন্ত পাড়ার কতো ছেলে-মেয়ে এসে গাছে ঢিল মেরে বরই খায়, আদিয়া পারে না।
বরই খেলে অসুখ বাড়বে, তাই। তেঁতুলের আচার বাড়িতে বয়াম ভর্তি, নিষেধ ছোঁয়া। জলপাই, চালতার আচারও বাড়িতে থরে থরে সাজান, আদিয়া চেয়ে চেয়ে দেখে। আম্মু একটু খাই? ওমনি জবাব-সব্বনাশ! অসুখ বেড়ে যাবে। ওষুধ কাজ করবে না। টক খেলে নাকি ওষুধক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তাই আদিয়ার আজতক টক খাওয়া হয়নি।
এমনিতে ওর স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ইচ্ছে না করলেও ভাজাপোড়া, চানাচুর, আচার, আমসত্ত্ব এসব খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওসব তার জন্য নিষিদ্ধ। ভাগ্যে জুটে না। লুকিয়ে খাওয়ার জো নেই, আতিয়া আপুর শ্যেন দৃষ্টি ফাঁকি দেওয়া চাট্টিখানি কথা না।
এই যখন অবস্থা, অভিভাবকদের তো দুশ্চিন্তার অন্ত নেই আদিয়াকে নিয়ে। প্রতিদিন শলাপরামর্শ চলে আদিয়াকে নিয়ে আব্বু-আম্মুর। খাওয়ার টেবিলে, রাতে বিছানায়, বাজার হাট করতে গিয়ে, বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে সবসময়ই আদিয়ার প্রসঙ্গ।
আদিয়ার জন্য মা রীতা ও বাবা মিলনের নিয়মের বাইরে কোথাও যাওয়ার জো নেই। কার কাছে রেখে যাবে? বাড়িতে নানু আছে। কিন্তু অতিবৃদ্ধা তিনি। তাঁর পক্ষে কোনো কিছ্ ুকরা সম্ভব নয়। আতিয়ার পড়া আছে। টিচার আসে দু’জন। ফাইভের পড়া অনেক। আতিয়ার কাছে রাখা সমীচীন নয়। এমন ভেবে দু’জন খুব একটা বের হন না বাইরে।
আদিয়াকে একটা বাঁধাধরা রুটিনের মধ্যে রাখতে হয়। সন্ধ্যা হতে না-হতেই আদিয়ার গায়ে জামা পরার কুস্তি শুরু হলো। হৈমন্তিক শীত। তাতে কী, আদিয়ার সর্দি লেগেই আছে। শুরু হলো কুস্তি মা রীতা ভার্সাস আদিয়া। আদিয়ার না না- পরব না পরব না-শুনবে কে! পায়ে মোজা, গায়ে ফ্লানেলের জামা, গরম ভেলভেটের কোট, গরম কম্ফার্টার। মাথায় কানঢাকা টুপি এবং শেষে লাল টুকটুকে আলোয়ান। কাশ্মির থেকে আনা। আদিয়ার খুব পছন্দের।
এ রকম ফিটফাট হয়ে বসে আদিয়া, আর রীতা যথারীতি গরুর দুধ আর সাগুদানার পায়েস নিয়ে সাধাসাধি করছে-এক চামচ এক চামচণ্ড খাও মা, আরেক চামচণ্ড।
আদিয়ার মুখ শক্ত করে বন্ধ। দু’পাটি মাড়ি দিয়ে খিল দিয়ে রেখেছে। খাবে না। জোর করে লাভ নেই। এসব ব্যাপারে এ বাড়িতে গা সওয়া সবার। তেমন হইচই হয় না। নানু দূর থেকে বলেন- নানুমনি খাও। খাও-খাও-। ব্যস!
এ রকম একটা পরিবেশে হঠাৎ মিলনের প্রবেশ।
দেখো দেখো কে এসেছে রীতাণ্ড
শোরগোল করতে করতে মিলন এবং পেছন পেছন মামুনের প্রবেশ। ডাক্তার মামুন, মানে রীতার খালাত ভাই। সুদূর অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল পড়তে। ফিরে আসার খবর পেয়েছিল বেশ আগেই। ঢাকার এক শিশু হাসপাতালের কর্ণধার। এ রকম শুনেছে ঢাকায় মামুন শিশু চিকিৎসক হিসাবে সেরা।
মিলনের কাণ্ড দেখো, বিনা নোটিশে গরিবের বাড়িতে হাতি ঢুকিয়ে দেয়া! থতমত ভাব কাটিয়ে রীতা উঠে বড়ভাই মামুনকে সালাম জানায়- আসসালাম আলাইকুম মামুন ভাইয়া! বাড়ি এলে কবে ?
এইতো এলাম। মিলনের সাথে বাজারে দেখা। বলল- বাড়ি চলেন ভাইয়া, ব্যস!
এরপর রীতা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আপ্যায়নের জোগাড়ে ভেতর ঘরে যাবে মামুন ভাইয়ার কড়া হুকুমণ্ড কোনো কিছু খাবো না- কিচ্ছু দিতে হবে না। আমি এসেছি শুধু মাত্র আমার অসুস্থ মামনিকে দেখতে।
রীতা যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায়। মিলনের দিকে তাকায়। ইশারায় থামতে বলে।
ডাক্তার মামুন চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় আদিয়ার কাছাকাছি বসে। এসো দেখি মামনি, কাছে এসো দেখি। আমি বিদেশ যাবার কালে ছোট্টটি ছিলে, এখন বড়ো হয়েছো- কোন্ ক্লাসে পড়ছো?
আদিয়া কাছে এলো। মুখে বলল- থ্রিতে।
মামুন চিৎকার করার মতো বলল- একি, ওর গায়ে এতাসব জামা চাপিয়েছ কেন রীতা? শীতকাল তো আসেনি এখনও! কেবল হেমন্ত ঘরে ঢুকেছে। ওরে বাব্বাহ, এতোসব চাপিয়েছ এখনই! খোলো, খোলো, জলদি খোলো সব!
রীতা মিনমিন স্বরে বলতে থাকে- খালি ঠাণ্ডা লাগে মামুন ভাইয়া- সে জন্য এতোসব-
ঠিক আছে, আমি বলছি খোলো! আমি শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মামুন ইসলাম বলছি।
রীতা এক এক করে খোলে আদিয়ার গা থেকে কোট, সোয়েটার, মাথার ক্যাপ, হাতমোজা, পামোজা ইত্যাদি। শুধু ফ্লানেলের জামাটা থাকে। ওর নিচে আরেকটা আছে।
মামুন ভাইয়া, মেয়েকে নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই- ভালো করে দেখো তো কী করা যায়-
ইতোমধ্যে আদিয়ার ট্রিটমেন্ট ফাইলের বান্ডিল মামুনের সামনে রাখা। ওষুধের বক্স, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র স্তূপাকারে পাশাপাশি।
মামুন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত দিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে। মুখে বলল- স্বর্গমর্ত্য আলোড়ন করে ফেলেছো দেখছি। মেয়েটাকে ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সর্বনাশ করে দিয়েছো। তোমার মেয়ে এরপরও বেঁচে আছে, এটা একান্ত আল্লাহর অনুগ্রহ!
কী করব ভাইয়া- ডাক্তাররা এসব দিয়েছে।
বিদেশে হলে এর একটা ওষুধও গিলতে হতো না। এখন থেকে সব বন্ধ। কোনো ওষুধ খাবে না। একদম না। একটা ট্যাবলেট না।
তাহলে! ভীতকণ্ঠে রীতা বলল। মামুন ভাইয়ার দিকে গোল গোল চোখে তাকায়।
ডাক্তার মামুন হাসে।
তোমরা কি বিয়ের পর হানিমুন গিয়েছো? মামুন হাসতে হাসতে বলে।
রীতা লজ্জায় মাথা নিচু করে।
না, ভাইয়া। মিলন জবাব দেয়।
এবার দুই মেয়েকে নিয়ে হানিমুনে যাও, কোথাও। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই। আমি খরচ বহন করব। আমিও পরে তোমাদের সাথে মিট করবো। মামনিকে দেখতে।
কোথায় যাবে ভাইয়া? মিলন হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে।
কক্সবাজার না। বেশি ভিড় মানুষের। তোমরা যাবে সিলেট। আমি সব ব্যবস্থা করব। আমার পরিচিত ট্র্যাভেল এজেন্ট আছে- ওরা সব অ্যারেঞ্জ করে জানাবে তোমাদের।
ভাইয়া, একটা প্রেসক্রিপশন আদিয়ার জন্য-
তোমাদের বাসি হানিমুনটাই প্রেসক্রিপশন, বুঝলে!
তারপর! আদিয়ারা সিলেট বেড়াতে গিয়েছিলো। সাত দিন ঘুরেছে। জাফলং, সাদাপাথর, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গল চা-বাগান এবং সুন্দর সুন্দর রিসোর্টে রাত্রিযাপন করেছে। ফিরে এসেছে নতুন জীবন নিয়ে। নতুন মন নিয়ে। জীবনীশক্তি নিয়ে। স্বাস্থ্য ও শরীর সুস্থ করে।
এরপর থেকে আদিয়ার আর জ্বর আসে না। সর্দিও নাই। নাই খাওয়ার ব্যাপারে অরুচি। স্কুলে যায় আসে নিয়মিত। পরীক্ষায় আদিয়া সব সাবজেক্টে এ প্লাস অর্জন করেছে।