শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

আম্মু

অনিক মাহতাব মুশফি
আম্মু

ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া নিতু এবং ক্লাস ফোরে পড়া অয়ন তাদের স্কুলের সামনের বিশাল গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ খানিকক্ষণ আগেই স্কুল ছুটি হয়েছে। স্কুলের ভেতর ছেলে-মেয়ে বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। নিতু দূরে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মু এখনো আসছে না কেন?’

অয়ন বলল, ‘এই তো আসবে একটু পর।’

নিতু একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আচ্ছা আম্মু যদি না আসে তাহলে আমরা কী করব?’

অয়ন অলস ভঙ্গিতে বলল, ‘কী আর করব, এখানেই থেকে যাব।’

নিতু এই কথা শুনে দমে গেল। এখানে থেকে যাবে মানে? সে এখানে আম্মুকে ছাড়া কি করে থাকবে? আম্মু আসবে না? ভাইয়ার নির্বিকার ভঙ্গিও নিতুর মনে ভয় ধরিয়ে দিলো।

অয়ন তার ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে দেখল তার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। অয়ন ব্যস্ত হয়ে উঠল, ‘ভয় পাস না বুঝলি! আমি বাসা চিনি। আম্মু না আসলে আমরাই চলে যাব একা একা। আমরা বড় হয়েছি না?’

নিতু কী বুঝল কে জানে, তবে তার মুখের রঙ খানিকটা বোধ হয় ফিরে এল। আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে অয়ন সাহস করে তার বোনের হাত ধরে হাঁটা ধরল। সে মনে মনে ভাবছে, সামনে গেলে দুটো রাস্তা আছে। প্রথমে যেতে হবে ডানদিকের রাস্তাটায়, এরপরে সে রাস্তাটা ধরে হেঁটে গেলে আবার ডানদিকে একটি গলি পাওয়া যাবে। সে গলি ধরে হেঁটে গেলে আবার একটি বড় রাস্তা পাওয়া যাবে। সে বড় রাস্তার বিপরীত পাশে যে হলুদ বিল্ডিংটা আছে, সেটাই তাদের বাসা। খানিকটা ভয় খানিকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাসার ঠিকানা এবং অবস্থান মুখে বিড়বিড় করতে করতে অয়ন তার বোনকে নিয়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে তার মনে খানিকটা সন্দেহ হল, সে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেনি তো? কারণ পরিচিত রাস্তা কিংবা দোকানপাটের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সন্দেহের কালো ছায়া ক্রমেই অয়নকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। তারপরও অয়ন আগের জায়গায় ফিরে না গিয়ে অনেকটা একগুঁয়েমির জোরে হেঁটেই যাচ্ছিল। ভাবখানা এমন, দেখাই যাক না এই রাস্তা ধরে হেঁটে!

খানিকক্ষণ হাঁটতেই অয়নের মনে হলো হতাশায়, আতঙ্কে তার হাঁটু যেন ভেঙে পড়বে। কারণ সে সত্যি সত্যিই রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। তার ইচ্ছে হল রাস্তায় বসে বসে কাঁদতে। কিন্তু সবসময় যা ইচ্ছে হয়, তা আমরা করতে পারি না। অয়নও পারল না। সাথে নিতু আছে। সে কান্না শুরু করলে নিতু সত্যি সত্যি ঘাবড়ে যাবে। তাই সে শক্ত হয়ে থাকার চেষ্টা করল। তারপরও তার মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাবটা উধাও হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘নিতুরে, আমরা তো মনে হয় হারাই গেলাম।’

নিতু কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, ‘তুমি বাসা চেন না সেটা আগে বলো নাই কেন?’

অয়ন চমকে উঠল। আমতা আমতা করে বলল, ‘তুই আগে থেকে জানতি আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি?’

নিতু কেঁদে ফেলল, ‘এতকিছু বলতে পারি না। বাসায় যেতে এতক্ষণ লাগার কথা না। তুমি বাসা চেন না। কেন শুধু শুধু স্কুল থেকে বেরোলে? তোমার জন্য আমরা আজকে হারিয়ে গিয়েছি।’

নিতুর চোখের পানিতে মুখ ভেসে যাচ্ছে। রাস্তার কয়েকজন মানুষ তাদের দিকে মাঝে মধ্যে তাকাচ্ছে এবং হেঁটে যাচ্ছে। হাজার হোক, অয়ন তার নিজের এলাকার কাছাকাছি এলে খানিকটা হলেও জায়গাটা চিনতে পারার কথা। কিন্তু তারা এখন যেখানে আছে সেই জায়গাটা চিনতে পারা দূরে থাক, কখনো এখানে এসেছে কিনা তাই মনে করতে পারল না। অয়ন মিনমিন করে বলল, ‘কাঁদিস না প্লিজ। চল স্কুলের দিকে ফিরে যাই। আম্মু এতক্ষণে চলে এসেছে।’

নিতুর চোখ দিয়ে তখনও টপ টপ করে পানি পড়ছে, ‘আমার পা ব্যথা করছে। আমি কক্ষনো এতটা হাঁটিনি।’

অয়ন নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘লক্ষ্মী বোন আমার, একটু কষ্ট করে হাঁট।’

তারা আবার হাঁটা ধরল। এবার গন্তব্য স্কুল। পথে একটা রিকশার আশপাশে একদল ছোকরা সিগারেট খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ স্কুলের ড্রেস পরা দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়েকে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে দেখে তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা একা একা কোথায় যাচ্ছ?’

অয়ন এবং নিতুর মনে পড়ে গেল, তাদের আম্মু-আব্বু প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘অপরিচিত মানুষ কাছে ডাকলে যাবে না। কিছু খেতে দিলে খাবে না। কথা বলবে না।’ অয়ন এবং নিতু দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে চলে এলো।

ভাগ্য এবার প্রসন্ন ছিল। স্কুল খুঁজে পেতে তেমন সমস্যা হলো না। দূর থেকে অয়ন এবং নিতু দেখল স্কুলের কাছে সিঁড়িতে একটা মহিলা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। হাতে মোবাইল। আরেকটু কাছে যেতেই অয়ন এবং নিতু সেই নারীমূর্তিকে চিনতে পারল। নারীমূর্তিটি তাদের মা। দু’জনেই তারস্বরে চিৎকার দিল, ‘আমমমমমুৃ’।

আম্মু মাথা তুলে তাকালেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে দেখা যাচ্ছে। তিনি তাঁদের দিকে ছুটে গেলেন। তার গাল চোখের পানিতে ভেজা। অয়ন এবং নিতুও ছুটে আসছে। তারা শক্ত করে তাদের আম্মুকে জড়িয়ে ধরল।

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মা এবং সন্তান একে অপরকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করল। রাস্তার মানুষজন দাঁড়িয়ে পড়েছে। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে স্নেহের মিলন প্রতিদিন দেখা যায় না। তারা আনন্দ নিয়েই দেখছে।

আম্মুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। দুই সন্তানকে বুকের মাঝে চেপে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘তোরা আমাকে এত যন্ত্রণায় কেন রাখিস বল তো? এত টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম, না জানি কি হয়ে গেল তোদের। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলি না কেন? আর কক্ষণও যদি আমি আসার আগে নড়েছিস, তোদের হাত-পা আমি ভেঙে গুঁড়ো করে দেবৃ’।

অয়ন এবং নিতু চুপ করে রইল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়