প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
বাবার সাথে ঈদের দিন
আজ ঈদ, আমার খুব মন খারাপ। প্রতি বছর আমরা গ্রামের বাড়িতে কুরবানির ঈদ করতে যাই। দাদা-দাদী, চাচা-চাচি, ভাই-বোন সবাই মিলে কত কত আনন্দ করি। পুকুরে গোসল করা, বড়শিতে মাছ ধরা, মাঠে দৌড়ানো, চাঁদনী রাতে উঠানে বসে গল্প করা, আরো কত হৈচৈ করি। এ বছর বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই।
সেদিন বাবাকে বললামণ্ড আমরা গ্রামের বাড়ি যাবো না বাবা?
বাবা বললেন- না বাবা, এবছর করোনা, গাড়ি বন্ধ তাই যাওয়া হবে না। বাবা মাকে বলতে শুনেছি দু’ মাস বেতন হয়নি বাবার অফিসে, তাই এবছর কুরবানিও দেওয়া সম্ভব হবে না। আমি ছোট হলেও বাবা মা আমার সামনেই সংসারের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। বাবা বলেন সন্তানদের সবটা জানতে দিতে হয় তবেই না বাবা মার প্রতি সমবেদনা গড়ে উঠবে। ওদের অন্ধকারে রাখলে ওরা বুঝবে কি করে আমাদের সুখ- দুঃখের জীবনগাথা।
বারান্দায় বসে থেকে পাশের বাসার গরু জবাই দেখছি, বাবা এসে মাথায় হাত রাখলেন,
কিরে, মন খারাপ?
মাঝে মাঝে কুরবানি না করলে মন খারাপ করতে নেই। সব ধরনের অবস্থার ভিতর দিয়ে জীবনকে চিনতে হয়।
বাবাও কিছুক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে গরু জবাই দেখলেন, এরপর হঠাৎ বলে উঠলেন, চল আমরা আজকে একটা খেলা খেলি। আমি বাবার মুখের দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকালাম,
বাবা রুমে ঢুকে ওয়ারড্রোব ঘেটে পুরাতন একটা গেঞ্জি আর ছেঁড়া একটা লুঙ্গি পরে নিলেন আমাকেও ছেঁড়া ও মলিন জামা কাপড় পরালেন। বাবার সাথে খেলতে আমার খুব ভালো লাগে। আর এই যে বাড়ি যেতে পারিনি, গরু জবাই কুরবানি এসব এড়িয়ে যাওয়া যাবে, এসব ভেবে আমার খুব মজা লাগছিলো। বাবা বললেন চল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি। তোর আম্মুর রান্না শেষ হোক। বাসায় ফিরে গোশত পোলাও খাবো।
আমরা রিক্সা করে যাচ্ছি। বাবা বললেন- আমরা আজকে কি খেলা খেলবো বলতো?
আমি কি করে বলবো বাবা, তুমি তো এখনো কিছু বলোনি।
বাবা বললেন-আমরা মাংস কুড়াতে যাচ্ছি।
শোনে আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা কি ফকির! বললাম আমি যাবো না বাবা। তুমি তো মাংস কিনে এনেছো। ঐ টুকুতেই আমাদের হবে।
বাবা বললেন-আরে বোকা ছেলে এটা তো একটা খেলা। আমরা মোট দু-তিনটে বাড়িতে মাংস কুড়াতে যাবো। শোন খেলার বাকি অংশ পরে বলবো। আমরা রিক্সা করে আমাদের বাসা থেকে অনেকটা দূরে অন্য এলাকায় চলে এলাম। এখানে আমাদের কেউ চিনে না। সকলে ভাবছে আমরাও ফকির।
প্রথমে লম্বা লাইন দেখে একটা বাড়ির গেইটে দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেলো। একসময় আমাদের পালা এলো। আমি আর বাবা তিন টুকরো করে মাংস পেলাম, এক টুকরা হাড়, এক টুকরা চর্বি আর এক টুকরা মাংস।
বাবা এবার দ্বিতীয় কোন বাড়িতে যাওয়া যায় তা খুঁজতে লাগলো। এবার এমন একটা বাড়িতে গেলাম যে বাড়িতে কোনো লাইন নেই, লোকজন যাচ্ছে আর মাংস নিয়ে চলে আসছে। আমরা দাঁড়ানোর সাথে সাথে চার-পাঁচ টুকরো করে মাংস দিলো। প্রথম বাড়ির চেয়ে অনেকটা বেশি। মাংস নেওয়ার সময় শুনলাম ভিতর থেকে আমার বয়সী কেউ বলছে আম্মু এতগুলো করে মাংস দিচ্ছো আমাদেরই তো কিছু থাকবে না। মহিলা বলছেন, সবাই মিলে মিশে খেতে হয় বাবা।
বাবা বললেন চল এবার আরো একটা বাড়িতে যাই। আমার খুব ক্লান্তি লাগছিলো। বললাম আর কোথাও যাবো না বাবা চলো বাসায় যাই। বাবা রিক্সায় উঠে বসলেন,
বললেন-কেমন লাগলো খেলাটা?
বললাম, খুব ক্লান্ত লাগছে বাবা।
বাবা- কী বুঝলি?
আমি বললামণ্ড ফকির হলে অনেক কষ্ট।
বাবা বললেন- হুম, ঠিক বলেছিস।
তবে শোন রাহাত আমরা কিন্তু এখানে তিন প্রকারের মানুষের সাথে পরিচিত হলাম।
প্রথম জনদের তুই কৃপণ ভাবতে পারিস। এটাও মাথায় রাখতে হবে এত লম্বা লাইন এত এত লোকজন। সবাইকে দিতে হলে তো কম করেই দিতে হয়। তবে ওরা চাইলে আরো একটু বেশি করে দিতে পারতো। এরা উচ্চ বিত্ত।
দ্বিতীয় জনেরা ছোট গরু কুরবানি করেছে, অথচ মানুষজনকে বেশি করে দিচ্ছে। ওদের ভিতর সবসয়ই একটা দোটানা ভাব কাজ করে। লোকজন যদি এদের গরিব ভাবে। এরা হলো মধ্যবিত্ত। অনেক সময় অন্যকে একটু বেশি দিতে যেয়ে নিজেদেরই কম পড়ে যায়। এরা কখনোই এই দোটানা ভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
আর ফকিরগুলোকে দেখ কিছু কিছু ফকির একবার নেয়ার পর আবার ঘুরে ঘুরে আসছে, পায়নি বলে বলে। এরা খুব লোভী।
এখন আবার ভেবে বসিস না বড় লোক হলেই খারাপ আর গরিব হলেই ভালো। বা গরিবরাই খারাপ বড় লোকরা ভালো। এক দেখাতেই কারো বিচার করা ঠিক না।
এই যে বিভিন্ন ধরনের লোক দেখলি এইসব ধরনের লোকদের সাথেই তোকে রাতদিন কাটাতে হবে। আমার নেই তাই আমি কাউকে দিবো না, বা আমার অনেক আছে সবটা আমি একাই ভোগ করবো এমনটা কখনো ভাববি না। কুরবানির ঈদ শুধু গরু জবাই আর মাংস খাওয়ার ঈদ না। কুরবানি আমাদের আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়।
আত্মত্যাগ মানে কি জানিস? নিজের মনের কলুষতা দূর করে অন্যকে ভালোবাসতে শেখা।
গল্প করতে করতে আমরা বাসায় চলে এলাম। মা আমাদের দেখে চোখ বড় বড় করে বললেন এই সাজে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে? বাবা বললেন জীবনের পাঠ নিতে।
বরাবরই বাবার সাথে কাটানো সময়টুকু আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সময় মনে হয়।