প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০
গাজার শিশুরা
খান ইউনুসের বাসিন্দা আয়মান বহুদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। আজকাল নিজেকে চিনতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। সাত মাস আগের তার ওজন যা ছিলো এখন তা প্রায় অর্ধেকে এসে ঠেকছে। তবুও সে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান তার বাবা-মা এখনো বেঁচে আছে সাথে তারা আশ্রয় পেয়েছে জাতিসংঘের আশ্রয় কেন্দ্রে। তার বাবা খুব ভোরবেলা ঘর থেকে বের হয় খাবারের খোঁজে কোনদিন পায় আবার কোনদিন না খেয়ে কাটাতে হয় নির্ঘুম রাত। আপাতত আয়মান আর তার পরিবার নিজেদের কে নিয়ে খুশি কেননা তারা একটি আশ্রয় ও সামান্য নিরাপত্তা পেয়েছে।
এদিকে দক্ষিণ গাজার রাবাবের পরিবারের ভাগ্য তেমন ভালো ছিলো না। ইসরায়েলের সৈন্যরা তাদের বাসায় মিসাইল দিয়ে হামলা করে। তাদের দালানে হামলা করা হয় সম্ভাব্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা সন্দেহে। মুহূর্র্তের মধ্যে চুরমার হয়ে যায় তাদের স্বপ্নের আবাসস্থল। তার বাবা-মা দুই ভাই সহ সকলে কংক্রিটের নিচে চাপা পরে নিহত হয়। রাবাবকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ গাজার আল নাসের হাসপাতালে। দীর্ঘদিন আইসিইউতে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয় যখন সে ঘরে ফেরার মতো অবস্থায় পৌঁছায়। তখন সে জানতে পারলো তার পরিবার এবং তার ঘর কোনোটি আজ আর অবশিষ্ট নেই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই দশ বছর বয়সে রাবাবের জায়গা হল বিদেশী এক দাতব্য সংস্থার ক্যাম্পে। ভবিষ্যতে তার কি হবে সবকিছুই অজানা আপাতত বেঁচে থাকাটাই যেন এক করুন বিলাসিতা।
আট বছরের ছোট শিশু জামিল। যুদ্ধে তার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। বাড়িতে আছে তার দুই বোন আর মা। মা বাড়ি থেকে কিছু রুটি জামিলের হাতে তুলে দিয়ে বিক্রি করার জন্য পাঠিয়েছে। জামিল রুটি হাতে নিয়ে গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া আবাসিক এলাকার রাস্তাগুলোতে হাঁটতে থাকে। যে কাউকে খুঁজে পায় না রুটি কেনার মতো। হঠাৎ করে সে তার সামনে ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করতে থাকা সুদর্শন এক লোককে দেখতে পায়। ক্যামেরা হাতে থাকা লোকটি একজন সাংবাদিক তার নাম মোতাজ। মোতাজ নিজেও গাজার একজন নাগরিক। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে তার কাছে থাকা মোবাইল এবং ক্যামেরা দিয়ে বিশ্বের কাছে গাজার পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। মোতাজ জামিলকে দেখে জিজ্ঞেস করে কি করছো তুমি? জামিল বলে রুটি বিক্রি করছি।
মা বাসা থেকে রুটি বানিয়ে দিয়েছে বিক্রি করার জন্য। আমাদের কাছে কোন টাকা নেই তুমি আমার কাছ থেকে কিছু রুটি কিনলে আমার অনেক উপকার হয়। মোতাজ জামিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দু ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে মোতাজের গালে। সে জামিলকে কিছু টাকা দেয় আর বলে বাসায় ফিরে যেতে। কিন্তু জামিল কিছুতেই শুধু শুধু টাকা নিতে রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে মোতাজ একটি রুটি নিতে রাজি হয়। জামিল খুশি মনে ফিরে চলে তার ক্যাম্পের দিকে।
ছয় মাস বয়সের ছোট্ট শিশু হাদী। সে ছিলো গাজার সেই দুর্ভাগা শিশুদের মধ্যে একজন। যে কিনা অক্সিজেনের অভাবে আস শিফা হসপিটালের এনআইসিইউ তে নিহত হয়। ইসরাইলের সেনারা গাজার অন্যতম বড় হাসপাতাল আস শিফা হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করে। তারা সন্দেহ করেছিলো এই হাসপাতালে লুকিয়ে আছে হামাসের প্রতিরোধ যোদ্ধারা। হাসপাতালে অভিযান চালানোর আগে বন্ধ করে দেয়া হয় বৈদ্যুতিক সংযোগ। বৈদ্যুতিক সংযোগের অভাবে আইসিইউ এবং এনআইসিইউতে থাকা রোগীরা যারা অক্সিজেনের উপর নির্ভর করে বেঁচে ছিলো তাদের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকশো মুমূর্ষ রোগী এবং শিশু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
দশ বছর বয়সী তাজওয়ার কোরআনে হাফেজ। ইজরায়েলের মিসাইল হামলায় যাদের ঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারাত্মকভাবে আহত হয় তাজওয়ার। তাকে হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন করার জন্য। তার ক্ষত এতটাই মারাত্মক ছিল যে বেশিক্ষণ রক্তক্ষরণ হলে হয়তো সে মারা যাবে। কিন্তু তার অপারেশন করার আগে এ্যানাস্থেসিয়া দেয়ার মত কোন মেডিসিন হাসপাতলে অবশিষ্ট নেই। বাধ্য হয়েই ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেয় অবশ করা ছাড়াই অপারেশন করতে হবে। তাজওয়ার তার শরীরে প্রবেশ করা প্রতিটি সুইয়ের ব্যথা অনুভব করতে পারছিলো। অপারেশনের পুরোটা মুহূর্ত তাজওয়ার মধুর সুরে কুরআন তেলাওয়াত করছিল আর তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুজল।
হামিদা তার পরিবার পরিজন সহ আশ্রয় নিয়েছিল জাতিসংঘের ক্যাম্পে। কথা ছিলো এই ক্যাম্পে বা তার আশেপাশে অভিযান পরিচালনা করবে না ইসরাইলি সৈন্যরা কিন্তু ঘটনা ঘটছে তার উল্টো। প্রতিদিনই তারা ছোটখাটো বোমা-বন্দুকের হামলার শিকার হচ্ছে।হামিদার বংশের প্রায় সকল মানুষ নিহত হয়েছে। হামিদার পরিবার নিহত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তাদের বংশ।হামিদা বাঁচতে চায় তার পরিবারসহ। তার জীবন সবেমাত্র শুরু হয়েছে এখনই সে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। তাইতো সে আর তার পরিবার একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে। তারা ভেবেছিল হয়তো এখানে তারা নিরাপদ।
ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়মান, হাদী আর রাবাব রা তুলনামূলকভাবে ভাগ্যবান বলা চলে। কেননা ইসরাইলি বর্বর সেনাবাহিনী কর্তৃক নিহত বিশ হাজার শিশুদের মধ্যে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি কিন্তু আসলেই কি তারা ভাগ্যবান? নাকি তারা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার?পৃথিবীর প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ। প্রতিমুহূর্তে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুই সমানভাবে মানবাধিকার পাওয়ার পূর্ণ হকদার। আজকের এই গ্লোবাল ভিলেজ নামক বিশ্বের রয়েছে এক অদৃশ্য দেয়াল এই দেয়ালের দুপাশে দুটি ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। দেয়ালের একপাশে শিশুরা নির্যাতিত নিগৃহীত ও নিহত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। দেয়ালের অপর পাশের শিশুরা সুন্দর স্বচ্ছল নিরাপত্তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে। এটাই কি হওয়ার কথা ছিল? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু আজকে তাই হচ্ছে আর আমরা সবাই নিশ্চুপ! আমরা আজকাল এসব অত্যাচার নির্যাতন দেখেও নির্বাক। আমাদের বিবেক আজ আর আমাদেরকে দংশন করে না। আমাদের জেনে রাখা উচিত পৃথিবীর কোন প্রান্তে যদি একজন মানুষ নির্যাতিত হয় কোন অত্যাচারীর দ্বারা আর আমি যদি সেই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে আওয়াজ না তুলি সেই অত্যাচার একদিন আমার ঘর পর্যন্ত চলে আসবে। আজকে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলার সময় হয়েছে। সময় হয়েছে নিজের সাধ্য অনুযায়ী সবটুকু শক্তি দিয়ে পৃথিবীর নানান প্রান্তে ঘটে চলা অন্যায় অবিচারের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করার।