শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০

পুনরুদ্ধার

সা’দ সাইফ
পুনরুদ্ধার

তখন আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। সালটা ঠিক মনে নেই। আমাদের বাড়ির পাশেই পুরো গ্রামের একমাত্র বড়ো পুকুর ছিল। গ্রীষ্মের সময় আশপাশের পুকুরে যখন পানি থাকে না বললেই চলে, সেখানে এই পুকুরে নাক অব্দি পানি থাকতো। এজন্য আশপাশের পাড়া বা মহল্লা থেকে লোকজনেরা গোসল সারতে এখানে আসতো। এ সময় পুকুরপাড় গমগম করতো মানুষের পদচারণায়। লোকজন বলাবলি করতো, এই পুকুরের আলাদা কোনো বিশেষত্ব আছে, না হলে আশপাশের সব খানাখন্দ, ছোটো পুকুর যেখানে শুকিয়ে কাঠ, সেখানে এ পুকুরে এত বিশাল পানির রহস্যই বা কী।

আমার দূরসম্পর্কের দাদার নাম ছিল শমসের মোল্লা। তাঁর জমিতেই খনন করা হয়েছিল পুকুরটা। সেই থেকে পুকুরটির নাম হয়ে যায় ‘মোল্লা পুকুর’।

সেবার গ্রীষ্মের প্রভাব ছিল বেশ কিছুদিন। যথারীতি পুকুরে গোসল করার জন্য লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। বয়সে বড়ো মানুষদের গোসলের ভিড়ে ছোটোদের গোসল করা ছিল রীতিমতো যুদ্ধের মতো। কারণ ছোটোরা গোসলের থেকে পুকুরে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি বেশি করে। ফলে স্বচ্ছ পানি ঘোলা হতে বেশি সময় লাগে না। তাই রাজ্যের ‘নিষিদ্ধ আইন’ তাদের ওপরেই আরোপ করা হতো বেশি। বড়োদের গোসলের মাঝে ছোটোদের গোসল মানেই শাসনের বেড়াজাল। সেজন্য গোসলের জন্য ছোটোদের বেগ পেতে হতো বেশ।

সেদিন দুপুর তিনটার আশপাশে হবে। রাজিব, সজিব আর আমি পুকুরপাড়ে বসে আছি গোসলের জন্য। বয়সেও আমরা প্রায় কাছাকাছি। পুকুরঘাট তখন প্রায় ফাঁকা। বলা যায় আমরাই শেষ তিন গোসলপ্রার্থী।

গ্রামের ছেলে হওয়ার সুবাদে ওই বয়সে সাঁতার পারা আহামরি কোনো ব্যাপার ছিল না আমাদের জন্য। সে সুবাদে পুকুরে গোসল করার ক্ষেত্রে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম থাকতো না অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত হতো না তাঁরা।

রাজিব শারীরিক গঠনে আমাদের মধ্যে অগ্রজ ছিল। দেখলাম ইতোমধ্যে সে পানির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সজিবও তার দেখাদেখি।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা পুকুরের ঠিক মাঝখানে পৌঁছে গেল, যেখানটায় কলাগাছের ঢাউস একটি ভেলা বাঁশের খুঁটির সাথে ঠেস দিয়ে কাদায় পোঁতা।

ওরা ভেলার ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে হাতের ইশারায় ডাকে, ‘কিরে, বসে আছিস কেন, চলে আয়। ভেলা চালাবো।’

আমি পূর্বাপর না ভেবে সাঁতরে ওদের ভেলার কাছে চলে আসি। মাথার ওপর তখন গনগনে সূর্য। পানির নিচে মাথা ডুবিয়েও যেন গরমের উত্তাপ কমে না কিছুতেই।

আমাদের মধ্যে সজিব একটু বেশি ডানপিটে। দুষ্টুও সেরকম।

আমি ভেলা ছুঁতেই সজিব বড়োসড়ো একটা ঝাঁপটা মেরে ভেলাটা সরিয়ে নেয়। তেলতেলে কলাগাছ থেকে আমার হাতটা সরে যায়। যার ফলে পানির নিচে একটা অবচেতন ডুব দিই। কিন্তু এরপরই ঘটে বিপত্তিটা। ডুব থেকে মাথা উঁচু করতেই ভেলার সাথে মাথা বেধে যায়। দু দু’বার চেষ্টা করার পরও ভেলার নিচ থেকে মাথা বের করতে পারি না। মাথা উঁচু করলেই ভেলার সাথে ধাক্কা খাই।

এদিকে আমার দম প্রায় শেষ। শরীরের শক্তিও যেন ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেনের অভাবে। আর এক দণ্ড নিঃশ্বাস নিতে না পারলে দম আটকে মারা যাবো হয়তো। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললাম।

পরে যখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম আশপাশে মানুষজনের শোরগোল। আমার পাশে মানুষের জটলা। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম। উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। কানে আবছা আবছা কয়েকটা শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দগুচ্ছ জড়ো করলে এমন অর্থ পেলাম, ‘বজ্জাত দুটো গায়েব হয়ে গেছে। সামনে আসলে ওদের খবর আছে।’

আমাকে এরপর স্থানীয় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় প্রাথমিক পরবর্তী চিকিৎসার জন্য।

সুস্থ হওয়ার পর শুনেছিলাম, পানির নিচ থেকে আমার ওঠার কোনো লক্ষণ না দেখে রাজিব ভেলা সরিয়ে আমাকে নিচ থেকে অচেতন অবস্থায় তোলে। যখন আমাকে ডাঙায় তোলে আমার পেটভর্তি তখন পানি। তারপর পাশের মহসিন চাচাকে ডেকে ওরা দু’জন পালিয়ে যায়।

আমার কী হয় না-হয় এই ভয়ে ওরা কয়েকদিন আর বাড়িতে আসেনি।

এই ঘটনা মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠি। পিলে চমকে উঠে। তখন মনের দুয়ার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রশংসা চলে আসে সেই মহান মনিবের দরবারে, যার রহমত না থাকলে সেদিন হয়ত বেঁচে ফিরতে পারতাম না মায়ের কোলে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়