প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০
শৈশব আয়না
বুঝলি টুটুল শৈশব হলো একটা আয়না।
টুটুল বল হাতে একবার ওপরের দিকে ছুঁড়ে। আবার হাত বাড়িয়ে সেটাকে লুফে নিচ্ছিল। দাদার কথায় থমকে দাঁড়ায়। ইজি চেয়ারে বসে ইমতিয়াজ আহমেদ বিকেলের চা শেষ করে। খালি চায়ের কাপ টেবিলে রাখছিলেন। দাদার কাছে এসে জানতে চায়।
দাদা শৈশব আয়না কেন?
হা-হা করে হেসে উঠেন ইমতিয়াজ আহমেদ। এই যে দেখ। আমার এই অবসর সময়ে আমার কিছুই করার নেই। বয়স আমাকে আটকে দেয়। মনের জোরে কতক্ষণ আর চলা যায়। কথা বলার মানুষ কই? সময়ের হাতে বন্দি সবাই। আমি মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে আমার শৈশব স্মৃতি খুঁজি। ভীষণ ভালো লাগে। সেই দুষ্টুমিভরা দিনগুলোর কথা মনে হলো। তাই পড়ালেখার ফাঁকে যতটুকু পারিস শৈশবকে ধরে রাখিস।
শৈশব আবার কিভাবে ধরে রাখে দাদা?
সামনেই তো বার্ষিক পরীক্ষা শেষ তাই না। বেশ কিছুদিন স্কুল বন্ধ। মনের অক্সিজেনের জন্য কিছুটা বিনোদন দরকার। প্রিয় বন্ধুদের সাথে মজা করে সময় কাটা। দেখবি এই মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দি হয়ে থাকবে জীবনে। কখনোই মুছে যাবে না। এখন তোরা ডানা মেলা প্রজাপতি। ভাবনা চিন্তার বাইরে জীবন।
দাদার কথাগুলো ভাবায় টুটুলকে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। রাতুল, যাবেদ, অহীন, মুন্নাকে নিয়ে একটা কিছু প্ল্যান করলে কেমন হয়।
বল হাতে মাঠে আসতেই দেখে ফরিদ, আব্দুল্লাহ, জাহেদ ওরা সবাই অপেক্ষা করছে টুটুলের জন্য। টুটুল ওদের উদ্দেশ্য করে বললো, প্রতিদিনই তো খেলা হয়। চল, আজ আমরা অন্য কিছু করি।
বা-রে খেলা ফেলে অন্য কিছুতে জমবে নাকি মজা। আব্দুল্লাহ বলে ওঠে।
কেন জমবে না? টুটুল বলে। আচ্ছা বলতো আমরা কে কে সাঁতার জানি?
ফরিদ বলে, আমি তো ডুব সাঁতারে পুকুর পার হই আর গোসলের আগে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা। গ্রামের ছেলে সাঁতার জানবো না, এটা হয় নাকি? জাহেদ বলে।
মন খারাপ হয় টুটুলের। আমি তো সাঁতারই জানি না।
এটা একটা ব্যাপার নাকি। কালই তোকে সাঁতার শেখার প্রশিক্ষণ দেবো।
আমি পারবোই না জাহেদ। আমার ভীষণ ভয় করে। টুটুল আমতা আমতা করে বলে।
দেখ টুটুল। সাঁতার শেখাও কিন্তু একটা শিক্ষা। ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে আসে।
ঠিক এই সময়ই ফাহিম আসে পেয়ারা হাতে।
এতো পেয়ারা তুই কোথায় পেলি ফাহিম? চুরি করিসনি তো? আব্দুল্লাহর চোখ কপালে।
আরে না। খা-তো তোরা।
উল্লাসে মেতে ওরা সবাই পেয়ারা খেতে ব্যস্ত হয়।
বার্ষিক পরীক্ষার শেষদিন। পরীক্ষা শেষে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে টুটুলের চোখ বন্ধুদের খোঁজে। একে একে জড়ো হয় সবাই স্কুল গেইটের কাছে।
টুটুল বলে আজ বিকেলেই আম গাছের নিচে আমরা সব একসাথে জমা হবো। মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে না আবার। ফাহিম এমনিতেই ভালো ছাত্র। পরীক্ষাও হয়েছে বেশ। খুশি মনে বলে, আজ আমার নিজেকে একটু বড় বড় মনে হচ্ছে।
বড় বড় মনে হচ্ছে মানে? ফরিদ জানতে চায়।
বা-রে আমরা এখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। দু’বছরের মাথায় কলেজে। আনন্দ হবে না মনে।
একদম ঠিক বলেছিস। আনন্দের সাথে কিন্তু দায়িত্ব ও থাকে। সময় মতো চলে আসিস আমাদের নির্দিষ্ট জায়গায়। মিটিং আছে আমাদের।
টুটুল বলতো কিসের মিটিং? ফরিদ তাকায় টুটুলের দিকে।
এলেই জানতে পারবি। এবার চল ফেরা যাক।
বিকেল চারটার কাছাকাছি সময়ে ওরা তিনজন টুটুল আসার অপেক্ষায়। এর ভেতরেই কথা হয় তিনজনের মধ্যে।
জানিস আমিনা খালার ছেলের জন্য খুব কষ্ট হয়। আমাদের সমানই তো হবে। কী কারণে যে পা দুটো অবশ হয়ে যায়। আরও ছোট থাকতে। আমি প্রায় সময় যাই ওর কাছে। কথা বলি। জানতে চাই ওর ইচ্ছের কথা। ওর ভালোলাগা। খুব মন খারাপ করে ফরিদ বলে।
কী নাম ওর? তোর সাথে বুঝি খুব কথা হয়। ফাহিম জানতে চায়।
কথা হয় মানে? ওর কথাগুলো আমাকে খুব কষ্ট দেয়। রুবেল যখন বলে।
জানো ফরিদ ভাইয়া। তুমি যখন বল হাতে বের হও। বলটাকে শূন্যে ছুঁড়ে আবার লুফে নাও। আমি তখন আমার পা জোড়ার দিকে তাকাই। অচল এই পা জোড়া কোনোদিনও বল খেলতে পারবে না। পারবে না ক্রিকেট, হাডুডু অথবা পুকুরে সাঁতার কাটতে।
এসব ভাবনাগুলো আমাকে খুব কষ্ট দেয় জানো। অসহায় আমার মা। দু’বেলা ভাত জোগাড় করতেই মাথার ঘাম পায়ে ঝরায়। আমি কোনোদিনও মাকে এতটুকু সাহায্য করতে পারবো না। আমার সামান্য লেখাপড়া। এর ওর কাছ থেকে পুরোনো বই চেয়ে যতটুকু পারি শিখেছি। যদি আমি ছোট ক্লাসের বাচ্চাদের পড়াতে পারতাম। তাহলে হয়তো মাকে একটু হলেও সাহায্য করা যেত।
ওদের কথার মাঝে টুটুল এসে হাজির। আলোচনার বিষয়বস্তু কী জানতে চায়।
সব শুনে টুটুল বলে, কেন আমরাও তো পারি ওকে সাহায্য করতে।
কিভাবে? সবার চোখ টুটুলের দিকে।
কাল থেকেই আমরা সবার ঘরে ঘরে গিয়ে মা-চাচিদের বুঝিয়ে রুবেলের জন্য ছাত্র জোগাড় করবো। এটা আমাদের দায়িত্ব।
কথাটা মনোপূত হয় সকলের।
টুটুল বলে, জানিস, দাদা বলে শৈশব হলো একটা আয়না। এটাকে ধরে রাখতে হয়। আর এভাবেই অসহায়দের কিছুটা হলেও উপকার করে আমাদের শৈশব তুলে রাখবো স্মৃতির আয়নায়।