রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

নীল বিষের ছোঁয়া

মেহরাব হোসেন
নীল বিষের ছোঁয়া

নিরব এক মহামারি ঘটে চলছে আমাদের সমাজে এই মহামারীতে আক্রান্ত অধিকাংশই শিশু। এই মহামারীতে চলছে অবাধ বিষপান। অবাক করার বিষয় হচ্ছে সেই বিষ স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিচ্ছে মানবজাতি। বাবা-মা তার সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছে এই বিষ। অতি আগ্রহে সানন্দে এই বিষ পান করছে আমাদের শিশু কিশোর, তরুণ প্রজন্ম। যেন বিষপানের প্রতিযোগিতা চলছে সমাজের প্রতিটি পরিবারে। কি সেই বিষ? তাহলে পর্নোগ্রাফির নীল বিষ। এই নীল বিষ ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হচ্ছে আমাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোন।

সমাজের বাস্তবতায় আমরা দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, আমাদের অধিকাংশ শিশু কিশোর ও প্রায় প্রতিটি তরুণ যুবকের হাতে রয়েছে এক বা একাধিক অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। এই মোবাইল ফোন ছাড়া যেন প্রতিটি মানুষের জীবন অপূর্ণ। নামিদামি ব্রান্ডের মোবাইল ফোন কেনার প্রতিযোগিতা মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে গোটা জাতিকে। আর সেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে আমাদের অভিভাবক সমাজ। সামর্থ্যবান বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের হাতে নামি ব্র্যান্ডের একটি দামি মোবাইল ফোন কিনে দিতে পেরে যেন চরম স্বস্তি অনুভব করছে।এই মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবিক প্রয়োগ কি? তা ভেবে দেখার মত সময় আমাদের হয়ে উঠছে না।

আমাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোনের যেমন চমৎকার প্রয়োগ রয়েছে তেমনি রয়েছে এর ভয়ংকর অপপ্রয়োগ। আমাদের জেনে রাখা দরকার এই মোবাইল ফোন যেমন একটি জীবনকে সহজে সুন্দর করতে পারে তেমনি একটি জীবনকে করে তুলতে পারে দুর্বিষহ যন্ত্রণার। মোবাইল ফোন যেমনি ভাবে আমাদের বিশ্বের ভালো জিনিস গুলোর সাথে সংযুক্ত করে তেমনি আবার দুনিয়ার তাবৎ নোংরা অশ্লীল দৃশ্য এনে হাজির করতে পারে আমাদের চোখের সামনে। তাই মোবাইল ফোন হাতে তুলে নেয়ার আগে অথবা নিঃসন্তানের হাতে তুলে দেয়ার আগে আমাদের হিসাব কষে নিতে হবে এই মোবাইল ফোন আমাদের বা আমাদের সন্তানের কতটুকু উপকার করবে আর কতটুকু ক্ষতিবয়ে আনতে পারে।

বর্তমানে মোবাইল ফোনের অধিকাংশ জনপ্রিয় অ্যাপস ফেসবুক, ইমো, ইউটিউব সহ বিভিন্ন কোম্পানির অ্যাপস তাদের আয় করে থাকে বিজ্ঞাপন প্রচার করার মাধ্যমে। এ সকল বিজ্ঞাপনের অধিকাংশ জুড়ে থাকে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির ভিডিও বা ছবির প্রদর্শনী। কেউ ভালো কোনো কাজ করার জন্য এসবে প্রবেশ করলেও তারা বাধ্য হয় এসব নোংরা কুরুচিপূর্ণ ছবি বা ভিডিও দেখতে। যদিও এসব বিজ্ঞাপন টাকার বিনিময়ে বন্ধ করা যায়। কিন্তু বিজ্ঞাপন মুক্ত অ্যাপস চালানোর জন্য যেই টাকার প্রয়োজন সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে, আর পরিশোধ করার পদ্ধতিও অত্যন্ত জটিল। তাই এ সকল অ্যাপসের ব্যবহারকারী মানুষজন এসব নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য দেখতে একরকম বাধ্য।

বাংলাদেশের মতো সেই দেশগুলোতে যে দুটি অ্যাপস সর্বাধিক জনপ্রিয় তাহলে ফেসবুক ও টিকটক। আবার এ দুটি অ্যাপসের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ হচ্ছে সংক্ষিপ্ত ভিডিওগুলো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসকল সংক্ষিপ্ত ভিডিওর উপাদান হচ্ছে দেহ প্রদর্শনী। ভিডিওতে যে যত বেশি দেহের গোপনীয় অঙ্গ প্রদর্শন করে তার ভিডিওতে লাইক কমেন্ট ও শেয়ার অনেক বেশি। তাই অধিকাংশ মেধাশূন্য ভিডিও নির্মাতা তাদের দেহ প্রদর্শন করাটাকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই হাতিয়ারের সফল শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ। এ সব ভিডিও ছবি গুলোকে আমরা সরাসরি পর্নোগ্রাফি না বলতে পারলেও এসব হচ্ছে মূলত পর্নোগ্রাফির একপ্রকার রূপ। শিশু-কিশোরেরা এসব থেকে উৎসাহিত হয়ে হার্ডকোর পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে উঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তারা না বুঝে এসব ভিডিওর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং নিজের অজান্তেই পান করছে নীল বিষ।

ডিজিটাল প্লাটফর্মের আসক্তির এই বিষয়বস্তুকে আধুনিক সময়ে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডিজিটাল কোকেইন। গবেষণায় প্রমাণ করা গেছে যে, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের তুলনায় একজন নীল ছবি আসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একজন মানুষ যখন যৌন উদ্দীপক ভিডিও/ছবি দেখতে থাকে তখন তার মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক হারে ডোপামিন নামক হরমোন নিঃসরণ হতে থাকে। এর ফলে কৃত্রিমভাবে তৈরি হয় অসম্ভব সুখানুভূতি। এই মাত্রাতিরিক্ত ডোপামিন নিঃসরণের ফলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য আমাদের অনুভূতি শক্তি ভোতা হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে আমরা আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে সুখ খুঁজে পাই না। এর আরো বড় ক্ষতি হচ্ছে নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখলে আমাদের মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং মস্তিষ্ক বিকৃত আকার লাভ করে। আর যখন কেউ এসকল ভিডিও বা ছবি দেখা বন্ধ করে তখন সে প্রচন্ড হতাশায় আক্রান্ত হয় আর এ বদ অভ্যাস ছাড়তে চাইলে তখন তার মাঝে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদক ছাড়তে চাইলে যে সকল লক্ষণ ফুটে ওঠে তা দৃশ্যমান হয়। আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো আজ আমাদের সমাজে কত বেশি পরিমাণে শিশু-কিশোর এই ডিজিটাল কোকেইনে আসক্ত হয়ে আছে। যখন ডিভাইসগুলো শিশু-কিশোরদের হাত থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয় তখন ঘটে যায় অনেক দুর্ঘটনা এমন কি তা আত্মহত্যার পর্যায়ে চলে যেতেও দেখা যায়।

আজকে আমাদের শিশু-কিশোরদের সামনে ফেসবুক ও টিকটকে দেহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তিরা সমাজের সেলিব্রেটি ও আইকন হয়ে উঠেছে। তাদের লাইফ স্টাইল দেখে বিস্মিত হয়ে তাদের মত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। এসকল নোংরামি আর অশ্লীলতা দেখতে দেখতে এক সময় তারাও হয়ে উঠছে নোংরা কনটেন্ট ক্রিয়েটর। একটি শিশু-কিশোরের জন্য আইফোন হাতে পাওয়া যেন বয়ে নিয়ে আসে স্বর্গ সুখ। পড়াশোনা বা সামাজিক কার্যক্রমের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এ সকল শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ। সারাদিন ফেসবুক ও টিকটকে খারাপ কনটেন্ট গলধঃকরণ লাইক কমেন্ট শেয়ার করায় ব্যস্ত সময় পার করছে ঘরে শুয়ে বসে। আক্রান্ত হচ্ছে নানারকম জটিল ও কঠিন অসুস্থতায়। অভিভাবকদের কোন প্রকার বাধা মানতে তারা নারাজ। তাদের জীবনে চাওয়া পাওয়া যেন তাদের মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট কানেকশনের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে।

আমাদের অভিভাবক সমাজ এসকল বিষয়ে আরো অনেক আগেই সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। তাদের জন্য অনুচিত ছিল আঠারো বছরের নিচের শিশু সন্তানের হাতে একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন তুলে দেয়া। অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন হওয়া উচিত ছিল তাদের সন্তানের এই মোবাইল ফোনে কি কি করছে তা জানার ক্ষেত্রে। অধিকাংশ বাবা মায়েরা আজো এসকল ডিভাইসের ব্যবহার সম্বন্ধে খুব বেশি ধারণা রাখেন না। অথচ তাদের সন্তান এই মোবাইল ফোনের খারাপ ব্যবহার করে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।অভিভাবকদের এই বোধদয় হয়নি যে সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে তারাই তার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিয়েছে।আগামীর প্রজন্মকে সুস্থ শক্তিশালী ও সৃজনশীল করে ঘরে তুলতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বের করে আনা আজ আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হওয়া উচিত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়