প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
নিঝুম রাত্রি। অর্ধেক চাঁদ আকাশে পাহারা দিচ্ছে। চারিদিকে কেউ নেই। নেই কোনো মানুষ। শুধু চারপাশে শোনা যাচ্ছে রাতের কত কীটপতঙ্গের শব্দ। ভীষণ উত্তেজনায় হেঁটে যাচ্ছে মাহমুদ। একা জনশূন্য রাস্তায় মাহমুদেরও ভয় লাগছে বেশ। তবুও হেঁটে যাচ্ছে সে অনেক ধর্মভীরু ও সাহসী ছেলে তারপরও কেনো জানি আজ তার ভীষণ ভয় লাগছে। কোথায় যাচ্ছে তা সে জানে না। শুধু হেঁটেই যাচ্ছে, এতোটুকু জীবনে অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে তার। এই তো দুই বছর হলো তার বাবার এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া। এরপর ভীষণ একা হয়ে পড়ে সে। মৃত্যুর আগে তার বাবা অনেক আগ্রহ করে তার বড় ভাই সাদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়েছিলেন। রেজাল্ট আর দেখা হলো না উনার। এর কিছুদিন পর রেজাল্ট দেখা গেলো সাদ সুযোগ পেয়েছে। বাবার মৃত্যু, অনেক জটিলতা ইত্যাদির মধ্যেও সে যে সুযোগ পেয়ে গেছে তাই সবাই এর জন্যে অনেক খুশি। কিন্তু এর সাথে সাথে পড়ার খরচ ও ভাইয়ের ঢাকা যাওয়ার চিন্তায় আবার আশাহত হয়ে পড়েন সবাই। তারপরও মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে ভাইয়ের এক বন্ধু ফোনে খবর শুনে তাকে তার ঢাকার বাসায় থাকার প্রস্তাব দিলো এবং সাথে কোনো ধরনের চিন্তা না করারও আশ্বাস দেন। ঢাকায় একটা পার্টটাইম কাজের ব্যবস্থাও করে দেন। ভাইয়ার বন্ধু হলেন ঢাকায় স্থায়ী নিবাসী। একবার ওদের জেলায় বেড়াতে এসে সাদ ভাইয়ার সাথে দেখা। সেই থেকে গভীর বন্ধুত্ব। মাহমুদ অনেক মিশুক স্বভাবের হলেও ওর আবার বন্ধুত্ব বিষয়টা অতোটা ভালো লাগতো না। কিন্তু সেদিন সে বুঝতে পারলো জীবনে বন্ধু থাকা কতটা প্রয়োজন। ওদের আম্মু আবার সেলাইয়ের কাজ জানেন এবং সেলাই মেশিনও আছে। এর ওপর সে ক’দিন অর্ডার আসছিলো বেশ। তাই ঢাকা যাওয়ার খরচও অনায়াসে হয়ে গেলো। মা ও মাহমুদ মিলে চোখের জলে ভিজিয়ে বিদায় জানালেন সাদকে। এরপর মাহমুদ আরো একা হয়ে পড়লো।
বাবার কথা এমনিতে মনে পড়তো তবে সে কয়দিন আরো বেশি মনে পড়তে লাগলো। তার উৎসাহ, তার গল্পের সাথি, তার প্রেরণাদাতা। একা একা কিছু করতে ভালো লাগে না। কারো সাথে মিশতে, খেলতে, পড়তে ভালো লাগে না। শুধু মনের সাগরে একটি মাত্র ইচ্ছা ভেসে আসে তা হলো বাবাকে আর একটি বার দেখার ইচ্ছা। পথ চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। কে যেনো সামনে দাঁড়িয়ে হালকা অন্ধকারের জন্যে চেহারাটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ লোকটি বলে উঠলো-কী খবর, মাহমুদ!
মাহমুদের বাবার ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো। তাই তাকে আদর করেও ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের নামে ডাকতেন।
এতোদিন পর হঠাৎ এই নাম শুনে মাহমুদ আঁতকে উঠলো। এই লোক এ নাম জানলেন কি করে। এ নামে তাকে একমাত্র তার বাবাই ডাকতেন, তবে কণ্ঠটাও বেশ চেনা চেনা লাগছে ওর।
তবে কি তিনি বাবা.
মাহমুদ কিছু বলতে যাবে, তখন লোকটি বলে উঠলেন কিরে বাবা চিনিসনি বুঝি?
তোর প্রিয় নামেই তো ডাকলাম।
মাহমুদ : আপনি কি আমার বাবা! না... না... এটা কি করে হতে পারে। এটা অসম্ভব!
লোক : মাঝে মাঝে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায় বাবা। আমিই তোর বাবা। এ কথা বলার সাথে সাথে চাঁদের হালকা আলো উনার চেহারার ওপর পড়লো।
মাহমুদ ভয়ে এক, দু পা পিছিয়ে গেলো।
ভয় পাস নে বাবা, উনি বলে উঠলেন। ‘আমি তোর সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।’ কণ্ঠে চলে এলো গাম্ভীর্য। আমি তোর ওপর অনেক অসন্তুষ্ট। এ কয়দিন তুই যা করছিস্ তা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া সব বাদ দিয়ে তুই মনমরা হয়ে বসে থাকিস? তুই কি মনে করছিস্ তুই এসব করলে তোর বাবা অনেক খুশি হবে? না, কখনোও না। আমি তোকে নিয়ে জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু বাবা, তুই আজকাল যা করছিস্ তাতো আমার সব স্বপ্নের ওপর ভাটা পড়ে যাচ্ছে। মাহমুদ কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না। লোকটির কণ্ঠ, চেহারা কথার ধরন সবকিছুই বাবার মত। লোকটি তখনও বলে যাচ্ছেন-
‘আমি নেই তো কী হয়েছে, তোমরা দুই ভাই তো আছ। তোমরা দুই ভাইতো আমার সব। আমার স্বপ্নের ডানা। তোমরাই উড়ে গিয়ে আমার স্বপ্নগুলোকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পার’।
তিনি ফিরে মাহমুদের কাঁধে হাত দিলেন। তখনও বলে যাচ্ছেন, তোমাকে সচেষ্ট হতে হবে মাহমুদ। তোমাকে অতীত ভুলে আগামীর দিকে হাত বাড়াতে হবেই। পড়ালেখা করে অনেক বড় হতে হবে। পাড়ি জমাতে হবে দিগ থেকে দিগন্তে। সে খুশিতে, আগ্রহে তার বাবার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে এবং তাকে আদরে জড়িয়ে ধরার জন্যে এগুতেই আজানের সুমধুর ধ্বনি তার কানে যায়।
ফজরের আজান। আজানের সুর শুনতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। পরক্ষণেই বুঝতে পারে সে, সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। মুহূর্তেই তার স্বপ্নে বাবার কথাগুলো মনে পড়ে যায়। মনের মধ্যে বাবার স্বপ্ন পূরণের সেই ওয়াদা পালনের জন্য নতুন উদ্যম আসে। মুচকি হেসে ভাবতে থাকে, ইস; স্বপ্নটা যদি সত্য হতো!! বালিশের পাশে রাখা টুপিটা হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে মাথায় দিতে দিতে নতুন উৎসাহ, নতুন উদ্যমে প্রাণবন্ত হয়ে ছুটতে থাকে মসজিদের দিকে। মুখে তখনও লেগে আছে সেই হাসি।