প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
রিকশার প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা কলেজপড়ুয়া ছেলেটি আরো জোরে হাঁক দিলো
-চাচা একটু জোরে চালান কলেজে দেরি হয়ে যাচ্ছে!
ষাটোর্ধ্ব বয়সী রিকশাচালক মুজিব মিয়া শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রিকশার প্যাডেলে জোরে চাপ বসাতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। এভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেলো। জ্ঞান ফিরতেই মুজিব মিয়া নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলেন। অনেকটা হকচকিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই চিকিৎসক তাকে ইশারায় শুয়ে থাকতে বললেন। বিছানায় শুতে শুতে মুজিব মিয়া খেয়াল করলেন তার রিকশায় প্যাসেঞ্জারের সিটে বসা কলেজপড়ুয়া ছেলেটি তার পাশেই বসে আছে। ছেলেটি অবশ্য একা নয়, এখন তার সাথে তার দুজন বন্ধুও আছে।
অনেকটা লজ্জিত হয়ে মুজিব মিয়া বলে উঠলেন,
-ইয়ে মানে বাবাজি আমার চোখে-মুখে কেমন আন্ধার নাইমা আইছিলো আর কিছুই মনে নাই বাবাজি।
কলেজপড়ুয়া ছেলেটি অনেকটা শ্রদ্ধার সাথেই রিকশাচালক মুজিব মিয়ার হাত দুখানি শক্ত করে ধরে বললো,
-ও কিছু নয় চাচা। আপনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনি এই বয়সে রিকশা চালান দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু এখানে আনার পর জানতে পারলাম আপনার শরীরে প্রচুর রক্ত ঘাটতি।
রিকশাচালক মুজিব মিয়া অনেকটা করুণ স্বরেই বললেন,
-তা তো হবেই বাবা। সপ্তাহ দুয়েক আগে এক ব্যাগ রক্ত বিক্রি করেছিলাম।
বেশ অবাক হয়েই ছেলেগুলো বললো,
-কিন্তু কেনো চাচা?
এবার রিকশাচালক মুজিব মিয়া হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে বলতে আরম্ভ করলেন, বাবারে আমি আগে রিকশা চালাইতাম না। আমরা আগে গ্রামে থাকতাম। আমরা বলতে আমি, আমার স্ত্রী আর এক ছেলে। আমার ছেলেটা অনেক মেধাবী ছিলো। পড়ালেখাও করাইছিলাম। ছেলেটা একটু বড় হয়ে যখন কলেজে উঠলো তখন বললো গ্রামের জায়গা-জমি বেচে আমরা যেনো শহরে বাসা করি। ভাবলাম ছেলে আমার পড়ালেখা জানে। ছেলের বুদ্ধি আছে। তাই গ্রামের সব জায়গা জমি বিক্রি করে ছোট্ট একটা বাসা কিনলাম। গ্রামে তো কৃষি কাজ করতাম কিন্তু শহরে আইসা বেকার হইয়া পড়লাম। তা-ও কোনো রকমে চারটা বছর কেটে গেলো। ছেলেটারে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করাইছিলাম। মুজিব মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলেন, পোলাটা আমাগো ছাইড়া চলে গেছে। পোলাটার আর কোনো খবর পাই নাই। বাঁইচা আছে নাকি মইরা গেছে? ছেলেটার শোকে কাঁদতে কাঁদতে আমার স্ত্রী অসুস্থ হইয়া গেছে। রিকশা চালাইয়া আর কতই-বা পাই! দিন এনে দিনে খাই। আবার বয়স দেখে অনেকে রিকশায়ও উঠতে চায় না। তাই উপায় না দেখে দু-সপ্তাহ আগে এক ব্যাগ রক্ত বিক্রি করে স্ত্রীকে ভালো ডাক্তার দেখাইছি। ডাক্তার সাবরা অবশ্য আমার রক্ত দিতে না করছিলো। কিন্তু রক্ত না বেচলে টাকা জোগাড়ের অন্য উপায় ছিলো না!
ষাটোর্ধ্ব বয়সী রিকশাচালক মুজিব মিয়ার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। নিয়তির কাছে হেরে যাওয়া এক অসহায় পিতা এক অসহায় স্বামীর এই চোখের পানি কোনো বাধা মানে না। চোখের পানি পড়তে পড়তে চোখের দু পাশে কালো দাগ পড়ে যায় তবুও কান্না থামে না।
কলেজপড়ুয়া ছেলেগুলো তখনো অপলক দৃষ্টিতে মুজিব মিয়ার দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎ তারা নিজেদের চোখ দুটোও কেমন ভেজা ভেজা অনুভব করলো! তারা ভাবলো, তার জন্যে আমাদের একটা কিছু করা উচিত।