প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাবিতের গল্প
ছেলেটার নাম সাবিত। বয়স তের বা চৌদ্দ হবে। নামটা সুন্দর হলেও গায়ের রংটা সুন্দর নয়। ফ্যাকাসে কালো, তবে চেহারায় একটা মায়াবী আর্ট রয়েছে। মাথার চুলগুলো সবসময় উড়ুউড়ু থাকে।
দেখলে মনে হয় কখনো তেল দিয়ে মাথা আঁচড়ায়নি। চোখগুলো ডাগর ডাগর। সাত বছর বয়সে বাবাকে হারায়। মা’ই তার সম্বল। সারা পাড়া গাঁ একহাতে রাখে। কখনো দস্যিপনা কখনো বিপদে নিজেকে উৎসর্গ করা।
আবার কখনো দুষ্টামি করে চুরি করা। কার বাগানে আম পাকলো কার পুকুরে মাছ বড় হল কার নারকেল গাছে ডাব হল, সব জায়গায় সাবিতের আনাগোনা। পাড়ার সবাই মায়ের কাছে নালিশ করে যায় প্রতিদিন।
সাবিতের এরকম দস্যিপনা ছিল না। বাবা বেঁচে থাকতে বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করেছে, চাষ করেছে। ক্ষেতের তরকারি বাজারে বিক্রি করেছে। আবার স্কুলেও পড়েছে।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সাবিত এমন দস্যি, দুরন্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠলো। কেন এমন হল মা কিছুই বুঝতে পারে না। তবে সাবিত যেমন দুষ্টু তেমনি ভালো। পরের ক্ষতি করতে যেমন ভাবে না তেমনি পরের উপকার করতেও ভাবে না। দুষ্টামিতে যেমন সবার আগে আগে থাকে তেমনি কারো উপকারেও সাবিত সবার আগে এগিয়ে আসে। এইতো সেদিন চেয়ারম্যান সাহেবের বড়ছেলের পাঁচ বছরের ছেলেটা খুঁজে পাওয়া গেলো না।
সারা পাড়া হা-হুতাশ করতে লাগলো, কান্নাকাটি করতে লাগলো। সবাই খুঁজতে বের হল। সাবিতও খুঁজতে লাগলো। বাড়ির ছাদে পুকুরপাড়ে, স্কুলমাঠে সব জায়গায় খুঁজতে লাগলো। চেয়ারম্যান সাহেব ভেঙে পড়লেন। তার একমাত্র নাতি এভাবেই হারিয়ে যাবে।
ঘণ্টা খানিক পর সাবিত চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে আসে তার নাতিকে নিয়ে। জানায় লেবুতলায় খেলতে গিয়ে পা পিছলে পুকুরে পড়ে যায়। ওর বল দেখে বুঝতে পারে ও এখানেই পুকুরে পড়ে গেছে। তাই ওকে খুঁজে ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে আসছে।
এখন ও সুস্থ আছে। চেয়ারম্যান সাহেব খুব খুশী হয় সাবিতের উপর। সাবিতকে অনেক ভালবাসে। আবার একদিন হুরমুজ কবিরাজের বাড়িতে চুলা থেকে রান্নাঘরে আগুন ধরেছিল। সাবিত আর ওর বন্ধুরা মিলে সেই আগুন নিভিয়ে দিল। সাবিতের মায়ের কাছে সবাই যেমন সাবিতের নামে নালিশ করে তেমনি ভালো কথাও বলে। সাবিতের প্রশংসা শুনে মায়ের বুকটা ভরে যায়।
আবার যখন ওর নামে নালিশ শোনেন তখন বুকটা দুঃখে ফেটে যায়। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে। ভাবে তার স্বামীটা বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। ছেলেটা স্কুলে পড়ে সত্যিকারের মানুষ হতো। একটাই ছেলে তার। তেমন শাসন করতেও পারে না আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলেও মাথায় উঠে যাবে। মা সন্ধ্যায় খাবার নিয়ে বসে থাকে সাবিতের আশায়। ছেলেটা সারাদিন কি খাইছে কি করছে। মাও তেমন খোঁজ রাখতে পারে না। পরের বাড়ি কাজ করে। সকালে সাবিতের জন্য কিছু খাবার রেখে কাজ করতে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে সাবিতের জন্য খাবার নিয়ে। কিন্তু সাবিত এখনো কেন আসছে না। মা চিন্তায় কখনো দাওয়ায় বসে আবার বাইরে গিয়ে দেখে আসে সাবিত আসছে কিনা। কিছুক্ষণ পর সাবিত ঘরে ঢোকে সাথে একটা দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে। মা সাবিতকে দেখে জরিয়ে ধরে কাঁদতে থাকে আর বলে, ‘কেন এমন করিস বাবা। সারাদিন কই থাকিস কি খাস সন্ধ্যায় একটুতাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারিস না? তুই তো জানিস এই সময় আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকি।’ সাবিত মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা মা, আর দেরি করবো না।’
মা সাবিতের কপালে চুমু খায়। পাশে দেখতে পায় অচেনা ছেলেটিকে। মা জিজ্ঞেস করে, ‘ঐ ছেলেটি কে?’
সাবিত মনিরকে দেখিয়ে বলে, ‘মা ও মনির। ওর বাবা-মা কেউ নাই। ও ওর মামার কাছে থাকে। জানো মা, ওর মামিটা খুব খারাপ। ওকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করায় কিন্তু ওকে ঠিকমতো খেতেও দেয় না। আবার মারধোরও করে। তবে ওর মামা ভালবাসে। ওর মামা বাড়িতে নাই। তিনদিন হল শহরের বাইরে গেছে কাজে। আর এই সুযোগে ওর মামী ওর সাথে খুব খারাপ আচরণ করে। এই কয়দিন ঠিকমতো খেতেও দেয়নি।
আজ ও ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাজারে পকেটমারতে গেছিলো। কিন্তু ধরা পড়ে মনির। সবাই ওকে খুব মারধোর করে পরে তাই দেখে আমিই নিয়ে আসি ওকে। তারপর আমার কিছু টাকা ছিল তাই দিয়ে ওকে দুপুরে সুবহান চাচার হোটেল থেকে খাওয়াইছি।’
সাবিত মাকে জরিয়ে ধরে বলে, ‘মা তুমি রাগ করো না মনির আজ থেকে আমার সাথে থাকবে। ও বলছে ও আর মামার কাছে ফিরে যাবে না। বলো মা, তুমি ওকে তাড়িয়ে দিবে না।’
মা মনে মনে ভাবলো, ‘তার ছেলে কত্ত বড় বুঝদার হইছে। মানুষের উপকার করতে একটুও ভাবে না। আর তারও কোন ভাই নাই। সারাদিন একা একা থাকে, একা একা কই কই যায়। মনির থাকলে একটু চিন্তামুক্ত থাকবে। তাছাড়া ওকে পেয়ে সাবিত কেমন খুশি হইছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে মনির আজ থেকে তোর সাথে থাকবে।’
‘সত্যি মা! তুমি খুব ভালো মা।’
সাবিত খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। বলে, ‘মা আমাদের খুব ক্ষুধা লাগছে তাড়াতাড়ি ভাত দাও।’
‘যা তোরা হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি ভাত বাড়ছি।’
সাবিত আর মনির কলপাড়ে যায় হাত মুখ ধুতে।