প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ভিখিরিটা প্রতিদিন একই জায়গায় বসে থাকে। একই সময়ে এবং একই সময়ের জন্যে। দুপুর ঠিক একটায় সে স্কুলের উল্টোদিকের ফুটপাথে উদয় হয়। দুপুর একটা থেকে দুটো পর্যন্ত থাকে। তারপর চলে যায়। তার বাম পা একটু খোঁড়া। মনে হয় কখনো আহত হয়েছিলো। তারই রেশ রয়ে গেছে। একমুখ না কামানো দাড়ি-গোঁফ। একমাথা চিরুণীহীন চুল। মনে হলো জন্মের পর থেকে কখনো আঁচড়ায়নি। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। চিকন স্বাস্থ্য। ভিখিরি হলেও তার কোন ভিক্ষের থালা নেই। কখনো কারো কাছ থেকে কোন ভিক্ষে নিতেও দেখা যায়নি। তবে কেউ খাবার দিলে খায়। তার খাওয়ার ধরন দেখলে মনে হয়, কখনো সে বনেদী ঘরের লোক ছিলো। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে। বিড় বিড় করে কী বলে তা বুঝা যায় না। গত দুমাস ধরে ভিখিরিটা এই কাজ করছে। বয়স দেখে আন্দাজ করা যায় না মোটেই। তবে ষাট-বাষট্টি তো হবেই। ভিখিরিকে সে গত দিন পনেরো ধরে লক্ষ্য করছে। তারপরে বাসায় এসে তার মাকে সে এই কথাগুলো বলছিলো।
এতোক্ষণ মায়ের কাছে প্রখরের দেওয়া ভিখিরির বর্ণনা শুনছিলাম। তার কথা শুনতে শুনতে মনে হলো ভিখিরিটাকে একটানে এঁকে ফেলা যায়।
প্রখর একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। ক্লাস সেভেনে। বেশ চটপটে। চারপাশে যা কিছু দেখে সবকিছুই তার আগ্রহ কেড়ে নেয়। এখন যেমন এই খুঁড়িয়ে হাঁটা ভিখিরিটা প্রখরের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে, তেমনই। প্রখরের স্কুলে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এটাকে স্কুলের স্যার থেকে শুরু করে মা-বাবা সবাই বলছে শিক্ষার রূপান্তর হিসেবে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে সে জেনেছে, রূপান্তর মানে কী। বাবা খুব সহজে বুঝিয়ে দিয়েছে। আসলে একরূপ থেকে অন্যরূপে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হওয়াটাই শিক্ষার রূপান্তর। যেমন গাছেরা শীতকালে পাতা ঝরিয়ে নিজেদের কেমন যেন গুটিয়ে রাখে। আবার বসন্ত এলে গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়। অর্থাৎ নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করাই হলো রূপান্তর। প্রখরের কাছে বাবার দেওয়া রূপান্তরের সংজ্ঞা খুব পছন্দ হয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে, আসলে ভবিষ্যতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে আমাদের জন্যে শিক্ষার এই রূপান্তর অপরিহার্য। প্রখর ও তার বন্ধুরা শিক্ষার এই নতুন পাঠ্যক্রম খুব পছন্দ করেছে। আগে কেবল তাদের ক্লাসের বদ্ধ পরিবেশে পাঠ নিতে হতো।এখন নতুন কার্যক্রমে তারা কৃষকের কাছে গিয়ে ফসল সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছে। আসলে এতদিন তারা জানতো মাটিতে বীজ ফেললেই চারা হয়। কিন্তু এখন তারা বুঝেছে, কৃষি একটা সাধনার বিষয়। কেউ একজন চাইলেই যে কোন সময়ে যে কোন ফসল ফলাতে পারে না। এরজন্যে জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। আবার একদিন তাদেরকে একটা জেলের কাছে নেওয়া হলো। তিনি খুব সুন্দর করে বললেন, প্রখরের এলাকায় কী কী মাছ পাওয়া যায়। সব মাছ যে মিঠা পানিতে হয় না কিংবা লবণাক্ত পানির মাছকেও কখনও কখনও মিঠা পানির নদীতে আসতে হয় তা তারা জেলে ভাইয়ের কাছে জানতে পারলো। আগে তো সব মুখস্থ করতে হতো। এখন আর কিছুই মুখস্থ করা লাগে না। সব নিজের চোখে দেখে এবং নিজের কানে শুনে মনে গেঁথে গেছে। প্রখর স্কুল থেকে এসে মায়ের কাছে এসব গল্প করে। মা-ও বসে থাকেন আগ্রহে। ছেলের মুখে নতুন কারিকুলামের কথা শুনতে মায়েরও ভালো লাগে। গত দুদিন ধরে প্রখর মায়ের সাথে সাথে রান্নাঘরে ঘুর ঘুর করছে। কেন! কারণ তাদের একটা ক্লাস আছে। কীভাবে রান্নাবান্না করতে হয় সে বিষয়ে। প্রখর মায়ের কাছে শিখছে কীভাবে ভুনা খিচুড়ি রাঁধতে হয়। মায়ের প্রথমে খটকা লাগে। ছেলেরা কি তবে বাবুর্চি হবে? কিন্তু তার ছেলেই তাকে বুঝিয়ে দেয়, এটা আসলে রান্না শিখানোর জন্যে নয়,বরং কীভাবে রান্না করতে হয় তা জেনে রাখা এবং যে সকল মায়েরা-বোনেরা রাঁধে তাদের প্রতি যাতে সম্মান বজায় থাকে সেজন্যে এই শিক্ষা। ছেলের নতুন শিক্ষাক্রম ধারণ করার গভীরতা দেখে মায়ের খুশি লাগে। আসলেই তো। কোন কাজই জগতে ছোট নয়। রান্না কীভাবে করতে হয় তা জানার মাধ্যমে এই কাজের প্রতি তাদের সম্মানবোধ বেড়ে গেলো।
প্রখরের মা-ও একজন শিক্ষায় আলোকিত মানুষ। তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্রী। কিন্তু নতুন যুগের নতুন মানুষদের চোখে শিক্ষাকে এভাবে রূপান্তরিত হতে দেখে তিনি উদ্বেলিত হন। সত্যিই তো। শিক্সা মানে তো কেবল মুখস্থ করা আর নম্বর পাওয়া নয়। শিক্ষা তো ব্যক্তির মুক্ত চিন্তার দ্বার উন্মোচন করে দিবে। কয়েকদিন আগে প্রখর ও তার বন্ধুরা ব্যস্ত ছিলো একটা সায়েন্স ফিকশন বই বানানোর কাজে। বিজ্ঞান নিয়ে প্রখর তার বাবার সাথে বসেছিলো ধারণা নিতে। বাপে-পুতে বসে কীসব প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে কথা বলছিলো। প্রখরের মা কান পেতে কিছু কিছু শুনেছে। তারপর তার ধারণা পরিষ্কার হলো। আসলে নতুন কারিকুলামে বিজ্ঞান শিক্ষাকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে। কেবল জিপিএ পাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে রাখা হয়নি।
প্রখরের পর্যবেক্ষণে থাকা সেই ভিখিরিটি আজ তার স্কুলে ঢুকে গিয়েছিলো। তবে কোন ক্ষতি করেনি। শুধু জাতীয় পতাকাণ্ডদন্ডের দিকে একমনে চেয়েছিলো। তাকে দেখে প্রখরের মনে হয়েছিলো, তিনি বোধ হয় বিড়বিড় করে আমার সোনার বাংলা গাইছেন। প্রখরের একটু অবাক লাগলো। এ আচরণ আগে দেখেনি। সম্ভবত ভিখিরিটি জাতীয় পতাকার গুরুত্ব বোঝে। সেদিন আর বেশিক্ষণ থাকলো না স্কুলে। বাসায় এসে প্রখর মায়ের সাথে বকবক করতে লেগে গেলো। আগামীকাল তাদের স্কুলে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আসবেন। তাঁর সাথে প্রখরদের ক্লাস। নতুন কারিকুলামে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সেই সব দিনের গল্প শুনতে হবে। প্রত্যেক স্টুডেন্টকে একটা করে প্রশ্ন বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রখর চেয়ারে বসে চিন্তা করতে লাগলো,কী প্রশ্ন করা যায়। চিন্তা করতে করতে একসময় একটা প্রশ্ন বানায়। এই প্রশ্ন আগামীদিন মুক্তিযোদ্ধাকে জিজ্ঞাস করবে। উত্তেজনায় সে রাতে ঘুমুতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক বিশাল বিষয়। একজন জাদুকর ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর আগুনঝরা ভাষণে সারাবিশ্ব জেগে উঠেছিলো। তাঁকে রাজনীতির মহাকবি বলে ঘোষণা দিয়েছিল আমেরিকার নিউজউইক ম্যাগাজিন। আর কিউবা নামের একটি দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। তিনি বলেছিলেন, তিনি হিমালয় দেখেননি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। ভাবা যায়! এমন মানুষ এই বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে তো হাজার বছরের সেরা বাঙালি বলতেই হয়। তিনি না হলে আমাদের বাংলাদেশ তো কোনদিন স্বাধীনই হতো না। প্রখর এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো এক সময়।
পরদিন প্রখর একটু তাড়াতাড়িই স্কুলে গেলো। স্কুলে গিয়ে দেখে, লাল গালিচা বিছানো হয়েছে। স্কুলে একজন মুক্তিযোদ্ধা আসবেন, এ এক বিশাল ব্যাপার। আজ থেকে কয়েকবছর পরে কেউ আর মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পাবে না। সবাই মৃত্যুকে বয়সের কারণে বরণ করে নিতে হবে। তখন আর জীবিত মুক্তিযোদ্ধা কাউকে চাইলেও দেখা যাবে না। প্রখরের ক্লাসে যিনি ইতিহাস পড়ান তিনিও জন্মেছেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে। তিনিও প্রখরের মতো উচ্ছ্বসিত। সকাল দশটায় তিনি স্কুলে আসলেন। স্কুলে এসে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে বসে চা-বিস্কুট খেলেন। তারপর মাঠে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ হলো। তিনি সেখানে দাঁড়ালেন। স্কুলের ক্লাস টেনের একজন বড় ভাইয়া মাইকে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধার জীবনী পাঠ করলো। এই মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছেন। তিনি বেশ কয়েকবার শত্রু সেনার গুলির হাত থেকে বেঁচে গেছেন। বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে আগরতলার মেলাঘরে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনও ছিলেন ঊনিশশো একাত্তর সালে মুক্তিবাহিনীর সদস্য। তিনি বলতে থাকলেন, আমরা সে সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণে আমাদের সকল দিক নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানতেন, রক্ত না দিলে এদেশ স্বাধীন হবে না। তাইতো আমাদের তিরিশ লক্ষ বাঙালি শহিদ হয়েছেন। এই মুক্তিযোদ্ধার নাম মমিন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্যে বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা মমিন সাহেব আরও বললেন, সেদিন যদি ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে না দাঁড়াত তবে আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন হয়ে যেতো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আসলে বাংলাদেশের ধাত্রী মা। ধাত্রী মা হলো যিনি জন্মের সময় শিশুকে মায়ের পেট হতে ভূমিষ্ঠ হতে সাহায্য করেন। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জন্যে ঠিক তাই-ই করেছিলেন। তিনি এককোটি বাঙালিকে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্য শেষ হলে প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো। ক্লাস ওয়ানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে শুরু। দশটা ক্লাস থেকে নির্বাচিত দশজন দশটা প্রশ্ন করবে। প্রতিজন একটা করে। ক্লাস সেভেন থেকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছে প্রখর। সবার প্রশ্নের খুব সুন্দর করে আন্তরিকতার সঙ্গে উত্তর দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা মমিন সাহেব। ক্লাস থ্রি এর ছাত্রের প্রশ্নটা ছিলো খুব চমৎকার। সে জিজ্ঞেস করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধে আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিলেন? মমিন সাহেব বললেন, অবশ্যই বঙ্গবন্ধু। তাঁর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কিছু ছিল না। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে, এই কথাটা বুকে গেঁথেছিলো সব সময়। এই সত্য আমাকে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ঘুমুতে দেয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অনুপ্রাণিত না করলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে এতদিন টিকে থাকতে পারতাম না। অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষার পর প্রখরের সুযোগ এলো। প্রখর তার প্রশ্নটা করলো। প্রখরের প্রশ্ন ছিলো, মুক্তিযুদ্ধে শিশুদের অবদান কী? মমিন সাহেব প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ সময় নিলেন। অতঃপর বলতে শুরু করলেন, মুক্তিযুদ্ধে শিশুদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত তাদের নির্বিচারে মেরেছে বলেই বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের জন্মের পক্ষে ছিলো। দ্বিতীয়ত ছোট ছোট শিশুদের কোলে নিয়ে অনেক মা-বোন তাদের ইজ্জত বাঁচিয়েছেন। তৃতীয়ত কিছু কিছু শিশু পাকিস্তানী ক্যাম্পের খবরাখবর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এনে দিতো। আর কিছু কিছু শিশু নাছোড়বান্দা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ক্যাম্পে যোগ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলো। আমরা শিশু মুক্তিযোদ্ধা পলাশের কথা জানি যে সরাসরি যুদ্ধ করেছে। কোন কোন শিশু মুক্তিযোদ্ধা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। মমিন সাহেবের উত্তরে সবাই খুশি হলো। এভাবে একে একে ক্লাস টেনের শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তরও দেওয়া হয়ে গেলো। এবার মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষার্থীদের শপথ পাঠ করাবেন। শপথের কাগজটা তিনি বাঁ হাতে মেলে ধরলেন আর ডান হাত সামনে এগিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে প্রসারিত করে রাখলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, আমি আন্তরিকতার সাথে শপথ করছি যে, বাংলাদেশের মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপ্রাণ সচেষ্ট থাকবো এবং আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে নিজেকে প্রস্তুত করবো। আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা বিনির্মাণে অবদান রাখবো। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
শপথ শেষ না হওয়ার আগেই দেখা গেল, সবার পেছনে সেই অদ্ভুত ভিখিরিটাও শপথ নিচ্ছে। এরপর একটা অন্যরকম কাণ্ড ঘটে গেলো। ঐ অদ্ভুত ভিখিরিটাকে দেখা মাত্রই বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিন সাহেব প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘পলাশ’! তারপর দৌড়ে গিয়ে ঐ ভিখিরিটাকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাই তাদের দিকে চেয়ে রইলো। ঘটনা কী কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। প্রিন্সিপ্যাল স্যার হতে শুরু করে সব স্যার-ম্যামেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। যারা গেইটে সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলো তারা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিন সাহেব হাত তুলে সবাইকে আশ্বস্ত করে ভিখিরিটাকে পরম মমতায় ধরে পতাকা দন্ডের সামনে নিয়ে আসলেন। তারপর তিনি মাইকে বললেন, এই যে আপনারা যাকে দেখছেন ভিখিরির বেশে, এ আর কেউ নয়, এই-ই সেই শিশু মুক্তিযোদ্ধা পলাশ। একটু আগে ক্লাস সেভেনের ছাত্র প্রখরের প্রশ্নের জবাবে আমি এর কথাই বলছিলাম। আমি ওর কমান্ডার ছিলাম। পলাশ আমার অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সে-ও তখন ক্লাস সেভেন পড়তো। তার বয়স ছিলো তখন তেরো। আমি তাকে কত বুঝিয়েছি, কতো ভয় দেখিয়েছি, যাতে সে বাড়ি বলে যায়। কিন্তু সে যায়নি। সে দেশের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ করবেই। এতো ছোট ছেলেকে কী ভাবে আমি মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে রাখি! তবুও তার অনড় মনোভাবের কারণে তাকে ক্যাম্পে রেখে দেই। বেশ কয়েকটা ব্রিজ পলাশ অসম সাহসিকতার সাথে উড়িয়ে দিয়েছিলো। ও সেদিন তা না করলে আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রু সেনার হাতে নিহত হতো। মুক্তিযোদ্ধা মমিন সাহেব মুক্তিযোদ্ধা পলাশকে আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর তিনি আবারও বলতে শুরু করলেন : পলাশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে জেনে রাজাকাররা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। তার মা-বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে। আজ স্বাধীন দেশে পলাশের আপন কেউ নেই। গত বছর দুয়েক আগে আমি তাকে খুঁজে পাই। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্যে। কিন্তু সে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায়। আজ আবার দুবছর পর আমি তাকে পেলাম। তাকে আর হারিয়ে যেতে দিবো না। মুক্তিযোদ্ধা মমিনের কথা শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধা পলাশ ফৌজি কায়দায় স্যালুট দেয় পত পত করে উড়তে থাকা বাংলাদেশের পতাকাকে। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। রোদের আদরে সে অশ্রু চিকচিক করে ওঠে। তাকে দেখে উপস্থিত সবার চোখে অশ্রুর বাষ্প জমা হয়। প্রখরের মনে হলো, যেন মুক্তিযোদ্ধা পলাশের এক স্যালুটে কেঁদে উঠলো সমগ্র বাংলাদেশ।