প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মিম আইসিইউতে ভর্তি, ডাক্তার বলেছে ১২ ঘন্টার ভেতর কিছু বলা যাবে না। মারিয়া কাঁদতে কাঁদতে মিজান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললো। তুমি না সবাইকে কতভাবে সাহায্য কর। তো আজ কেন তোমার বিপদে তোমার পাশে কেউ দাঁড়ালো না। মিজান কিছুই বললো না। শুধু পাথরে মুর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো।
মিজান সাহেবের কোন কিছুই ভালো লাগছে না। কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। সেই যে ডাক্তারের কথা শুনে আপসেট হয়েছে আর কোন কথাই বলেনি এই পর্যন্ত মাহিয়া এতো কাঁদে তাকে ধরে, সে কোন কথাই বলে না। প্রায় ৩ ঘন্টা কেটে গেলো তবুও মিজানকে একটা কথা বলাতে পারে নি। আর জায়গা থেকে একটুও নড়াতে পারেনি। মিজান সাহেব কিছুই না বলে হাটতে লাগলো। হাটতে হাটতে ছাদে চলে এলো। ছাদে এসে এক কোনো দাঁড়িয়ে পড়লো। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। আকাশটা আজ চাঁদ থাকা ও কেমন যেন স্তব্দ মানে হচ্ছে। আকাশ দেখে আজ কেন যেন শান্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আজ চাঁদও আমাকে ঘৃণা করছে। আকাশ আমাকে বিদায় জানাতে চাচ্ছে। প্রকৃতি আামাকে চলে যেতে বলছে। কেউ যে আমাকে সাহায্যই করতে পারছে না। সব কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। মনকে কোন কিছুই বোঝাতে পারছে না। কোনো কিছু মানতে পারছেনা। নিজের ওপর আজ খুব রাগ হচ্ছে। আজ নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে। নিজেকে আজ শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজের উপর খুব ঘৃণা হচ্ছে।
মিজান সাহেব ভাবতে লাগলেন তার জীবনি।
বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে মিজান পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য বহু কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেয়, কিন্তু তার পরীক্ষা ভালো হলেও তার চাকরি হয়নি একটাই কারণে। তার কাছে ঘুষ দেয়ার মতো টাকা ছিলো না। ব্যবসা যে করবে, তার জন্য অর্থ বা ব্যবসায় মূলধান দেয়ার মতো সামর্থ্য মিজানের নেই। ঢাকা শহরে মিজান খুব কষ্টে বড় হয়েছে। বাবা-মা গ্রাম থেকে ছেলেকে পড়াশোনা করতে ঢাকা পাঠিয়েছে। বাবা কৃষক তাই ছেলের পিছনে খরচ করার মতো অর্থ নেই। মিজান টিউশনি করেই নিজের জীবন চালাচ্ছে। প্রতিনিয়ত চাকরি বাজারে দৌড়াচ্ছে মাথা ভরা টেনশন নিয়ে দিন পার করছে মিজান সাহেব। বাবা-মা গ্রামে আছে। রোজ কথা হলেই বাবার কিছু ব্যবস্থা হয়েছে কি? তোর মা খুব অসুস্থ হাটাচলা করতে পারে না, শ্বাসকষ্ট, বাবার কথাগুলো শুনে আর কোন কথা মুখ দিয়ে আসে না মিজানের। ফোন রেখে প্রতিদিনের মতো আজও বেরিয়ে পড়লো চাকরির জন্য। আজও তিনটা কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিতে গেছে, তবে কোনটাতে যে হবে তার আশা নেই। স্টুডেন্টকে পড়াতে যাওয়ার পরেই স্টুডেন্ট বলে স্যার আজ থেকে আর আপনাকে পড়াতে হবে না। আমার জন্য নতুন শিক্ষক আসছে। আপনার কাছে পড়ে আমি ভালোই রেজাল্ট করেছি। তবে মা মনে করে আমি বড় হয়েছি যদি প্রেমে পড়ে যাই তাই মা আমার জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষক ঠিক করছে। মা বলে প্রেমে পড়লে যেন ভালো কারোর উপরেই পড়ি। বেকার ছেলেদের উপরে না। এই নিন স্যার মা আপনার জন্য এই খামটা রেখে গেছেন।
মিজান একটা মুচকি হাসি দিয়ে খামটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সেখান থেকে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলো। আজ সারাদিন কিছুই খাওয়া হয় নি। একটা বাটারবান আর এক কাপ চা নিয়ে বসলো। খেতে খেতে কানে এলো পাশের সিটের একটা লোকের ভয়েস। কার সাথে জানি কথা বলছে। আর কথা শুনে বুঝা যাচ্ছে সে হসপিটালে হসপিটালে ভিজিট করে থাকে।
মিজান তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলো। তার কথা শেষ হওয়ার পরেই কথা হয়।
মিজান : হ্যাঁ, আমি মিজান।
সাকিল : হ্যালো, আমি সাকিল।
মিজান : আপনি কি কাজ করেন?
সাকিল : আমি বিভিন্ন হাসপাতালে ভিজিট করি, আর আপনি?
মিজান : আমি কাজ খুঁজছি তবে পাচ্ছি না।
সাকিল : কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?
মিজান : জি¦ অবশ্যই বলুন।
সাকিল : আমার সাথে কাজ করবেন কি? নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারবেন।
মিজান : সত্যি আপনি আমাকে একটা জব দিবেন।
সাকিল : আমি আর কি দিবো? আপনার কাজ বুঝিয়ে দিলে আপনার কাজ আপনাকেই করতে হবে। ডাক দেওয়ার কেউ থাকবে না।
মিজান : আচ্ছা আমাকে ঠিক কি কি করতে হবে?
সাকিল : আপনি এক সপ্তাহ আমার সাথে সাথে থাকলেই বুঝতে পারবেন।
মিজান : ঠিক আছে, ধন্যবাদ।
সেই দিন থেকে মিজান সাকিলের সাথে কাজ শুরু করে। হাসপাতালে ভিজিট করা। যার কলা-কৌশল কিছুদিনের মধ্যেই আয়ত্ব করে ফেললো মিজান। প্রথম প্রথম ভালো না লাগলে ও পেটের দায়ে অমত করলো না। জীবন চলা শুরু করলো। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। বিয়ে করলো জীবন আরো সুন্দর করার জন্য। কিছুদিনর মাথায় ফুটফুটে একটা ছেলে হলো। তাকে নিয়েই ছোট্ট সংসারটা রঙিন হয়ে উঠতে লাগলো। দিন দিন ইনকামও বাড়তে লাগলো।
মিজানের ছেলের বয়স পাঁচ। এখন তার স্কুলে ভর্তি হবার সময় হয়ে গেছে। বাবা-মা দুজনই বেশ খুশি। খুশি মনে তারা ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যায়। তবে বাবার ব্যস্ত শহরে ছেলের জন্যও সময় হয়নি বউ আর ছেলেকে স্কুলের সামনে রেখেই চলে গেলেন কাজে। তবে আজ আর সম্পূর্ণ রাস্তা যেতে পারে নি। যাওয়ার পথেই মারিহার কল। কল ধরে শুনতে পার আমাদের ছেলে আর নেই, ওকে হাসপাতালে নিতে হবে তুমি আসো তাড়াতাড়ি। মিজান কিছু বলার আগেই মারিহা কান্না করতে করতে ছেলেকে বলতে লাগলো বাবা তোমার কিচ্ছু হবে না মা আছে তো। ইমার্জেন্সি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। আইসিইউতে রাখতে বলা হয় তবে হাসপাতালের আইসিইউ খালি না থাকাতে হাসপাতালেও রাখলো না ডাক্তার। অ্যাম্বুলেন্সে করে পুরো শহর ঘুরতে লাগলো কোন হাসপাতালে একটা আইসিইউও আজ খালি পাচ্ছে না। মিজান যাদের সাথে কাজ করে তারা ও আজ মুখ ঘুরিয়ে নিছে। তাদের কারো কাছে আজ সময় নেই। কেউ সাহায্য করার মতো নাই আজ। কত ডাক্তার কত কারো হাতে পায়ে ধরলো কেউ আজ সাহায্য করলো না। ঘুরতে ঘুরতে একটা হাসপাতালে একটা সিট পেলো, ছেলেকে আইসিইউতে রাখা হলো। ডাক্তার দেখে বলে অনেক দেরি করে ফেলেছেন। তবে এখনও বেঁচে আছে ১২ঘন্টা আগে কিছু বলতে পারছি না।
আজ মিজান এক ফোঁটা চোখে পানি নেই। সব যেনো শুকিয়ে গেছে। আজ তার খুব আফসোস হচ্ছে। জীবনে সে এতো পড়াশোনা করে কি করলো। এতো বই পড়ে একটু মানুষ হতে পারলো না। আর না একজন বাবা হতে পারলো। সে এতোদিন যা করেছে আজ তার সাথেই তা হচ্ছে। কেনো করলো। এসব ভাবতে ভাবতে পাগলের মতো অবস্থা হয়ে গেলো মিজানের। আজ সে অনুতপ্ত। সবশেষ করে দিয়ে।
মারিহা পিছন থেকে তাকে ঝড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে. ওগো তুমি কিছু বলো না ডাক্তার কি বলছে? আমাদের মানিক নাকি আর নেই, তুমি কিছু করো না, প্লিজ তুমি আমার মানিককে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। মিজান কিছুই বলছে না। আর কান্না ও করছে না। চুপ করে দাঁড়িয়েই আছে। মায়ের আর্তনাদ যেনো কেউ শুনতেই পাচ্ছে না আজ। বাবার কর্মফল আজ এই নিস্পাপ শিশুর জীবন কেড়ে নিলো।
তাই জীবন সাজাতে সব সময় জীবনের মানে খুঁজে বের করে, সঠিকভাবে জীবন সাজাতে হয়। কারো ক্ষতি করে কারো দেখানো পথে হাটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতিটা মানুষের জীবনই মূল্যবান। তাই কারো ক্ষতি করে কখনো সুখে থাকা যায় না। ঘুরে ফিরে সেটা নিজের কাছেই ফিরে আসে। কথায় আছে না থুথু উপরের দিকে ফেললে সেটা নিজের গায়ে এসেই পড়ে। তাই অন্যের ক্ষতি নয়। অন্যের উপকার করতে না পারো কারো ক্ষতি করো না।