প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
ভোর সাড়ে ৪টা, চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে। হঠাৎ বাড়ির এক দাদু ঘরের কাছে এসে বলতেছে তানজিনা ও তানজিনা ‘তার বাপে বইল্লে মরি গেছে!’ এ কথা শুনতেই আমাদের ঘুম ভেঙে গেলো, আমরা পাঁচ ভাই বোন লাফিয়ে উঠে ঘর থেকে বাহিরে এসে আবারও ঐ দাদু কে জিজ্ঞেস করলাম যে কি হইছে, উনি তখনও উত্তর দিলো তোর শাহজাহান কাকা কল দি কইছে তোর বাপে বইল্লে এই অন মরি গেছে! এ কথাটা শুনা মাত্রই আমাদের মাথা উপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেলো। আমরা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা আমাদের বাবা আর বেঁচে নেই।
এর আগে বাবা শুক্রবার সকালে স্ট্রোক করলে, বাবা কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সেই টাকা পর্যন্ত ছিলোনা। অসুস্থ বাবা কে ঘরে রেখেই খালার বাড়িতে গিয়ে ৩ হাজার টাকা এনে সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। তখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো,বৃষ্টির মধ্যেই বাবাকে ডাক্তার দেখে কিছু ঔষধ পত্র দিয়ে বললো চাঁদপুর সদর হাসপাতাল নিয়ে যেতে (বাবার একদম পাতলা লিকলিকে শরীর! এই মানুষটিকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন কত মাস কিছু খায়নি)।
চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর অনেকক্ষন জরুরি সেবা রুমে অপেক্ষা করলেও কোনো ডাক্তার পাচ্ছিলাম না। কারন তখন সবাই জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে চলে গেছে। তাই বাবার চিকিৎসার বিলম্ব হচ্ছে। এদিকে বাবা কিছুক্ষণ পর পর বমি করছে,আর মা সেগুলো পরিষ্কার করে দিচ্ছে। জুমার নামাজ শেষে ডাক্তার এসে বাবা কে দেখে হাসপাতালে ভর্তি না দিয়ে ইনজেকশন আর কিছু ঔষধ লিখে দিলো খাওয়ানোর জন্য। সেই সাথে ঢাকা নিয়ে যেতে বললো। ঐ সময় বাবার সাথে আমি আর মা ছাড়া কেউ ছিলোনা, আমি বয়সে ছোট হওয়ায় তেমন কিছু বুঝিনি, আর সেসব নিয়ে আমাকে ভাবতেও হয়নি। তাই কীভাবে কি করতে হবে এসব মা একাই সামলে নিয়েছে, প্রথমেই ছোট কাকার কাছে কল দিয়ে বিষয়টি জানালো। তারপর উনি হাসপাতালে আসলে এম্বুলেন্স ভাড়া করে বাবা কে ঢাকা জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বেজে গেছে, বাবার ঢাকা যাওয়ার সঙ্গী ছিলো মা আর ছোট কাকা (পরের দিন শনিবার আমার অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা থাকায় মা আমাকে চাঁদপুর থেকেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে)।
হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সেখানে আরেক কাকা উপস্থিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সকল কার্যক্রম চূড়ান্ত করে রেখেছে। তাই বাবা কে হাসপাতালে নেওয়ার সাথে সাথেই ওনারা কিছু পরীক্ষা আর ঔষধ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে, নিজের বেডে যেতে বললো, পরীক্ষা রিপোর্ট পরের দিন শনিবার দেওয়ার কথা। হাসপাতালে ঔষধ খাওয়ার পর বাবা যেন আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠছে, সবার সাথে সুন্দর মতো কথা বলছে, চলাফেরা করছে।বাবার এমন উন্নতি দেখে সবাই বাবার পাশে মা কে রেখে বাসায় চলে যায়। ‘কিন্তু হঠাৎ রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাবার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। হাত-পা ব্যথা করছে, বুক ব্যথা করছে, বাবার শরীরে কেমন যেন জ্বালা-পোড়া করছে।’ মা একা মানুষ কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। বাবার এমন অবস্থা দেখে পাশের বেডের কয়েকজন ছুটে আসলো দেখার জন্য। মা বাবার হাত-পা,শরীর টিপে দিচ্ছে, পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই বাবা আর স্বাভাবিক হতে পারছেনা। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎই নিভে গেল প্রদীপ! বাবা আমাদের কে এতিম করে, মায়ের কোলে মাথা রেখে পাড়ি দিলেন অনন্তকালের পথে...