প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
দৈনন্দিন কর্মমুখর জীবন প্রবাহের গতানুগতিকতার মধ্যে এমন কিছু দিন ও মুহূর্ত আসে যেগুলো একটা বিশেষ স্বাতন্ত্র ও রসাঘাদে আমাদের মনের মণিকোঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে, বর্ষণমুখর মেঘাচ্ছন্ন তা এক অবরুপ দৃশ্য যা সহজে ভূলা যায় না। জীবনে কত বসন্ত, কত শরৎ আর কত বর্ষা তার অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কোনো এক কল্পনার জগতে, বর্ষা এনেছে জীবনে রোমান্স। এমনি এক বর্ষণমুখর স্বপ্নময় সন্ধ্যা আমার স্মৃতির জগতে অক্ষয় হয়ে আছে। বর্ষা প্রকৃতি যেন নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার কল্পনাবিলাসী মন মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাখনা মেলে উড়ে চলেছে এক স্বপ্নময় কল্পলোকে।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছিল যেন সন্ধ্যার আঁধার এসেছে ঘনিয়ে। নিত্যদিনের মতো খোলা জানালার পাশে। বই নিয়ে পড়তে বসেছিলাম। একটু পরেই বৃষ্টি নামলো। চারদিক আরও ঘন অন্ধকার হয়ে এল। এমন বাদলা দিনে কি পড়ায় মন বসে? কোন এক স্বপ্নপুরীর কল্পনায় মন ভেসে যেতে চায়, রঙিন স্বপ্নের মালা গেঁথে চলে। চেয়ে আছি দূরের কাজল কালো মেঘের পানে। কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শী আবেগ হৃদয়ে এক অপূর্ব অনুভূতি জাগায়— ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে। ময়ূরের মত নাচেরে।
ভাবনায় হারিয়ে গেলাম সেই ছোট বেলার বর্ষণমুখর দিনে। বৃষ্টি আসার আগ মুহূর্তেই খাপ খেয়ে বসে থাকতাম কখন মেঘ নামবে? গ্রামের সকল বন্ধু বান্ধবীদেরকে নিয়ে একচারা এক টিনের নিচে বসে থাকতাম। আর অপেক্ষা করতাম কখন বৃষ্টি পড়বে কখন ভিজবো? প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে কখনো উপলব্ধি করি নি। কি এই প্রকৃতি? কি তার সৌন্দর্য? কি তার অবয়ব? মুগ্ধতা কখনো পাই নি। তবে এসবের মাঝে ও অনেক মজা করেছি। অনেক আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছি। বুঝি নি তখনো। তবে সবার সাথে যেযে দিনগুলো কেটেছে তা সারা জীবনে ও ভুলার নয়। স্পন্দন হৃদয়ে ও রেখেছি সেসব দিনের প্রতিচ্ছবি। বৃষ্টি নামা মানেই ফুটবলে লাথি দেওয়া। বৃষ্টি নামা মানেই আম কুড়তে যাওয়া।
বৃষ্টি নামা মানেই সকলে এক সাথে হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা। আহ কি অপরূপ সৌন্দর্য কাজ করে তাতে তাই না? বর্ষণমুখর সকালে রাখাল বালকেরা গরুর পাল নিয়ে মাঠে নামতো। গাভী হাম্বা হাম্বা করে বাচ্চা খুঁজে ফিরছে। গ্রাম্যবধূরা কলসি নিয়ে চলেছে নদীর ঘাটে। খোলা জানালার কাছে সারিসারি গাছগুলো বরষার জলধারায় প্রাণভরে স্নান করছে আর পাতা নেড়ে প্রাণের আবেগ প্রকাশ করছে। যেনো পেয়েছে নতুন করে আরেকটি প্রাণ। নতুনত্ব জীবন নিয়ে আবারও নতুন করে বাঁচার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। শালিক পাখিটি ডুমুর গাছের পাতার নিচে বসে একমনে কী যেন ভেবে চলেছে। তাদের বাসাগুলো ও মানুষের বাসার থেকেও সুন্দর করে বানিয়েছে তারা। এমন প্রতিভা মানুষের আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তাদের চাওনি, তাদের না বলা কথা, তাদের পিল পিলিয়ে উড়া যেনো মন কেড়ে নিচ্ছে অনল ভাবে। তাদের ইচ্ছেগুলোর কথা জানতে ইচ্ছে করে খুব। তাদের না বলা কথা শুনতে ইচ্ছে করে।
তাদের চলা ফেলার কথা তাদির দৈনন্দিন জীবনের কথা ও তাদের মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আফসোস দেখা ছাড়া কিছুই শোনা যাবে না। তার ভীতরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক গাছ। যাকে শুধু দেখেই যেতে হয়। তার মূল, কান্ড, লতা, পাতার গল্প জানার ইচ্ছে তাকলে ও জানা হয় নি কোন কাল। এমনই বর্ষণমুখর প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার বাসনা মনের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে। মেঘের কালো ঋপির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল দিনের সূর্য। মেঘের কালো ছায়ায়, বৃষ্টিতে, ঝড়োহাওয়ায়, ঘন ঘন মেঘের গুরু গুরু ডাকে অদ্ভুত ভাবে। আর এই মেঘের কালো ছায়াতেই হারিয়ে যেতাম আমরা সকলেই। হারিয়ে হারিয়ে আম কুড়োতাম আর বৃষ্টির প্রখর মেঘের ডাক শুনতে শুনতে বৃষ্টিতে ভিজতাম। কাচা মিঠা আমের স্বাদে মেঘের অলক বৃষ্টির মাঝে প্রকৃতিতে ডুব দিতাম। এভাবেই বৃষ্টিতে ভিজে মায়ের বকোনি কম খেতে হয় নি সে দিন। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ এক বর্যপাতে হুস আসলো। যে আমি এখন আর ছোট নেই। এখন আর গ্রামে নেই।
বর্ষণমুখর সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টি। সারাদিন পার হয়ে গেল, অথচ বৃষ্টির কমতি বেশি নেই। একইভাবে অশ্রান্ত বর্ষণ। একটা মায়াবী পরিবেশ। গাছের ডালে পাতায় ঝড়োহাওয়া আর বৃষ্টির ফোঁটার চলছিল অবিরাম মাতামাতি। বৃষ্টি বাউল তার একতারা বাজিয়েই চলেছে। আকাশ অঝোর ধারায় কেঁদেই চলেছে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সংগীতে কোথাও ছেদ পড়ে নি। ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে এমনি করে আটকে থাকার বাধ্যবাধকতা চার দেওয়ালের মাঝে বন্দি করে ফেলেছিল মানুষকে।
স্বাভাবিক জীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। মানুষজন সকলেই ঘরের দিকে ত্রস্তপদে রওয়ানা হয়েছে। কেউ ছাতা মাথায়, কেউ পাতার মাথাল মাথায় দিয়ে, কেউবা খালি মাথায় ছুটে চলেছে। সকাল দুপুরে বেরিয়ে আসা গবাদিপশু গোশালায় ফিরেছে। পাখিরা ফিরেছে তাদের নীড়ে। কিন্তু কোনো বিহঙ্গের পাখা বন্ধ হয় নি। কবিরা বর্ষার প্রেমিক, এমনকি প্রাবন্ধিকেরাও এর থেকে পিছিয়ে নেই। আমি নিতান্তই ছাত্র। একটানা বৃষ্টি আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়। তবে আমি ও একজন বৃষ্টি প্রেমি। দিনভর বৃষ্টি মানেই দুপুরে ভুনা খিচুড়ি, পড়শীর বাড়ি যেতে হাঁটু কাদা জল, পদে পদে পিছল পথের হুমকি, আর সবচেয়ে নিদারুণভাবে বিকেলে খেলার মাঠে ফুটবল খেলার ইতি। অতএব, সবকিছুর আশা ছেড়ে দিয়ে আগে থেকেই জানালার পাশে বসেছিলাম। পড়ুয়া ছাত্ররা বলে, বৃষ্টির দিনে নাকি অঙ্ক কষে সুখ; সে চেষ্টাও ও একবার করেছিলাম।
এক কাপ চা আর ডাইরিটা নিয়ে বসলাম। মাঝে মাঝে অঙ্কটা মিলাতে চেষ্টা করছি। তবে ঐযে বৃষ্টি প্রেমি বৃষ্টি হচ্ছে তাই তার দিখ থেকে মুখ ঘুরিয়ে অঙ্ক করা আমার সেই অঙ্ক কখনোই হবে না। তো কেবল মস্তিষ্কেরই ব্যাপার নয়, মনও লাগে। বৃষ্টির অবয়ব সৌন্দর্যে মনটা এমনই খুশিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে যে, কোনো অঙ্কই মিলবার সম্ভাবনা দেখা গেল না। সুতরাং জানালার ধারে বসে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শোনা আর সাথে চা ডাইরি তো আছেই আর কি লাগে। আমার আর এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বৃষ্টির জন্য দৃষ্টি বেশিদূর প্রসারিত করা গেল না। তবে যতদূর চোখ গেছে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো অনবরত পরতেই ছিলো। যা আমার কাছে সেই শৈশব কে টেনে আনে। চোখের ঠিক সামনেই টপটপ করে পানির বড় বড় ফোঁটা পড়ছে চাল গড়িয়ে। আর তার থেকে কিছু দূরেই অঝোর ধারায় সূক্ষ্ম জলকণার বর্ষণ। আমাকে কিন্তু প্রথম ব্যাপারটিই আকৃষ্ট করল বেশি।
প্রাকৃতিক বর্ষণের তুলনায় এ পতনের বেশ একটা ছন্দ আছে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক একটা ফোটার পতন। দূরে গাছপালাগুলো ঝাপসা হয়ে আছে। সতেজ, সবুজ গাছগুলো কালচে, ধূসর দেখাচ্ছে, এমনকি পাশের বাড়িটিও দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। দুএকজন লোক হাঁটছে। মাথায় টোপর, সাবধানী লঘু পদক্ষেপ, বৃষ্টির পর্দার আড়ালে চেহারা চিনবার উপায় নেই কারো। বোধ হয় এসব কিছুই বর্ষণমুখর দিনের সৌন্দর্য। কিন্তু আমি তা গ্রহণে এবং আস্বাদনে অক্ষম। জানালার ধারে কোনো কদম তরুর দোলায়মান শাখাও নেই। তবে ভাবনার জগতে এই বৃষ্টির রিমঝিম শব্দেও তোমাকে খুজেছি। তোমার পথ চেয়ে বসে বসে ভাবছি আর ভাবছি আমি ও ছোট বেলায় কতই না ভিজতাম। মনের ভেতরে তাই কবি কবি ভাব জাগল আজ। তবু মনবিহঙ্গ পাখা মেলল কল্পনার আকাশে। যদি ফুটবল খেলা যেত মাঠে গিয়ে কিংবা হা-ডু-ডু।
সূর্যের মুখ দেখা যায় নি সারাদিন। পুরো দিনটাতেই ছিল সন্ধ্যার আমেজ। ধীরে ধীরে বৃষ্টির ফোঁটা মিলিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। কেবল শব্দ শোনা যেতে লাগল একটানা জল পতনের। সন্ধ্যার অবসান হচ্ছে। পাশের ডােবা থেকে ব্যাঙের প্রমত্ত ডাক শোনা যাচ্ছে। সে যেন এক কনসার্ট। দূরে দেখলাম একটা জোনাকি জ্বলে ওঠল। কিন্তু বৃষ্টির দিনে তো জোনাকি জ্বলে না। তবে কী? না, লণ্ঠন হাতে কে যেন গোয়ালে গরু বাঁধছে। যারা বাইরে ছিল তারা সকলেই ভেজা দেহে গৃহের অভিমুখে ফিরছে। সমস্ত আকাশ জুড়ে এমনই কালো মেঘ যেন এক্ষুণি একটা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। বর্ষণধারা আরও বাড়ল।
সেই সঙ্গে বিদ্যুতের আলোকে যেন ত্রিনয়নের আগুন জ্বলে ওঠছে। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার তীব্র গতিতে গাছপালাদের উন্মত্ত ঝাঁকুনি, এমনকি বাড়িটাও যেন কেঁপে ওঠল। প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ার শব্দে আতঙ্কিত নৃত্য শুরু হলো। ঝড় থেমেছে কিন্তু তখনো বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো আলোর ঝিলিক, গুরু গুরু মেঘের গর্জন, চারদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক। মন মুগ্ধকরা এ এক মোহময় পরিবেশ। এহেন বর্ষণমুখর দিনের অনুভবের আঘাত প্রাণ ভরে গ্রহণ করা যায় মনের মণিকোঠায়, স্মৃতির বাসরে স্মরণীয় করে রাখা যায়, কিন্তু স্বরূপটিকে ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কবির ভাষায় এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়।
ক্রমেই অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে এল। এখন আর কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে সব একাকার। কেবল পাশের বাড়ির রহমান মিয়ার, আজানের শব্দ শোনা যায়। মা এসে হারিকেনটি ধরিয়ে দিলেন এবং যাবার সময় ঘরের জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলেন।
বর্ষণমুখর সন্ধ্যার একটা নিজস্ব রূপ আছে। তা একান্তে অনুভব না করলে তার মহিমা বোঝা যায় না। হৃদয়ের বেদনা স্মৃতিমুখর সন্ধ্যায় বুক ভরে জেগে থাকে। হৃদয় এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। বিরহী বকুল হৃদয় শাখায় সুবাস ছড়ায়; একটা অলস অতলতা মনের গভীরে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। সে যে কী অনুভূতি, কী যন্ত্রণা বলে বোঝানো যায় না।