প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
চারটা বেড়ালছানা ঘরটাকে মাতিয়ে রাখে সারাদিন। গৃহকর্ত্রীর দিন কাটে তাদের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে। তাদের শরীর এখনো ভালোমতো শক্তপোক্ত হয়নি। তবু তারা চারজনে মিলে দৌড়ে যায় অন্য একটা বড় বেড়ালকে তাড়াতে। চারটে বেড়াল ছানারই আলাদা আলাদা নাম। যেটা বুকে সাদা আর পিঠে ধূসর সেটা জবা। যেটা মাথার সামনে লালচে সেটা হলো লাল। যেটার গায়ে কোন নকশা নেই সেটা ফুলটুসি। আর হাতেপায়ে নকশাদারটা ঝিন্টি। এই বেড়ালছানাগুলো সব মাছ খায় না। তারা খায় তাজা তেলাপিয়া। মাঝে মাঝে ক্যাটফুডও খায়। তবে ভাত-রুটি কিছুই খায় না। তাই তাদের নানী মানে গৃহকর্ত্রী বড়ো বেকায়দায়। চারটা বেড়াল ছানাকে মাছ আর কয়বেলা দেওয়া যায়? তবে তাদের দুরন্তপনার অন্ত নেই। তারা কেউ ঘুমায় ওভেনের ওপর, কেউ ঘুমায় ডাইনিং টেবিলে এবং কেউ ঘুমায় কার্নিশে। ঔষধের অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের আওয়াজ পেলে শুরু হয়ে যায় ওদের বিশ্বকাপ। পায়ে পায়ে বাড়ি দিয়ে ফয়েলটাকে বানিয়ে নেয় ব্রাজুকা বলের মতো। তাদের আরেকটি প্রিয় খেলনা হলো গৃহকর্ত্রীর পায়ের স্যান্ডেল। মাঝে মাঝে পা থেকে তা কেড়ে নেয়ার মতোই হয়। তাদের থালায় খাবার দিলেও তা মেঝেতে নামিয়েই খায়।
সারা পাড়া ঘুরে এসে বেড়াল ছানারা পী করে ঘরে এসে। মহা মুসিবদ। তারা মনে করে এ ঘরটাই তাদের জল বিয়োজনের কেন্দ্র। প্রথম প্রথম মা বেড়ালটা যখন বাচ্চা জন্ম দিবে তখন সে বেশ কয়েকটা জায়গা নির্বাচন করে। আমরা মনে করলাম বোধ হয় খাটের তলায় সে তার প্রসব-কক্ষ বানাবে। কিন্তু ওমা! যখন প্রসবের সময় হলো তখন মা বেড়াল যাকে আমরা মিনি বলে ডাকি সে সামনের ড্রইং রুমে সোফার পাশে কর্নারের ফাঁকে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলল। আমরা তো তাকে খুঁজে পাই না।
টানা দুদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে মিনি মা হয়ে গেল চারটা বাচ্চার। এই দুইদিন মিনিকে কিচ্ছু খেতে দেখা গেল না। তৃতীয়দিন রাতে সব লাইট নিভিয়ে যখন ডিম লাইট জ্বলে উঠলো তখন দেখা গেল, অতি সন্তর্পণে মিনি খাবার খেতে ঢুকছে রান্নাঘরে যেখানে গৃহকর্ত্রী তার জন্যে খাবার রাখে। বাড়ির সবাই তখন জানলাম, বাড়িতে নতুন অতিথির উদয় হয়েছে। সবাই একটু একটু উঁকি মেরে দেখি বাচ্চা আসলে কয়টা এবং রঙ কেমন। দুইদিন যাওয়ার পর আর কর্নারের ফাঁকে তাদের দেখা গেল না। কই গেল কই গেল! হুম!খোঁজ পাওয়া গেল, খোঁজ পাওয়া গেল। মিনি তার বাচ্চাগুলো পড়ার টেবিলের নিচে পরিত্যক্ত কাগজের ফাঁকে লুকিয়ে রাখলো। গৃহকর্ত্রী এবার নিষেধাজ্ঞা দিল। কেউ বেড়াল বাচ্চা দেখতে পারবে না যতদিন না পর্যন্ত তারা বের হয়ে না আসে।
দিন যায়। ধীরে ধীরে তাদের গলার ক্ষীণ আওয়াজ কানে আসে। মিনি সারাদিন তাদের পাহারা দেয় আর রাত হলে নিজে বের হয়ে এসে খাবার খায়। বেড়াল ছানাদের ম্যাও ম্যাও ডাক ক্রমশ: কানে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে। সবাই যত শুনি তত আরও শোনার জন্যে উদগ্রীব থাকি। অবশেষে বেড়াল ছানাদের মা মিনি আর সামলে রাখতে পারে না। তারা সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। তেলাপোকাণ্ডটিকটিকি চোখে পড়লেই তাদের কৌতূহল বাড়ে। তারা পিছে পিছে ছুটে যায়। একদিন দেখি, একটা তেলাপোকা চিৎ হয়ে তাদের খেলার সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। বেড়াল ছানাদের এই কৃতিত্বে গৃহকর্ত্রীর মুখে ঈদের চাঁদ হেসে উঠে।
তিনি এখন বেড়াল ছানাদের প্রতি সহমর্মিতায় তেলাপিয়া ছাড়া আর কোন মাছে আসক্তি দেখান না। বেড়াল ছানারা কী খাবে সেই চিন্তায় গৃহকর্ত্রী আজকাল আর বাপের বাড়ি যাওয়ারও নাম নেয় না। এতদিন তার ছেলেরাও কেউ যদি ঘর একটুও ময়লা করতো তবে আর রক্ষে ছিল না। খবরটা সিএনএন-বিবিসি না পৌঁছানো অবধি তার শান্তি হতো না। কিন্তু আজকাল বেড়াল ছানারা এঁটোমুখে তার বিছানায় উঠলেও কেমন জানি তার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। জীবন যে এক বড় মায়ার চক্র তা তাকে দেখে বুঝা সহজ।
সময় ধীরে ধীরে গড়িয়ে যায়। লাল-ঝিন্টি-ফুলটুসি-জবারা ধীরে ধীরে লাফ দিয়ে দেয়ালে চড়তে শিখে গেছে। পাঁচ মাস না যেতেই মা মিনি বাচ্চাদের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। বুঝা গেছে ধীরে ধীরে, মিনির আবারো লুকোনোর জায়গা প্রয়োজন। মাঝে মাঝে রাতে বেড়াল ছানারা রান্নাঘরের মিটসেফের পাশে তন্ময় হয়ে বসে থাকে। এমনভাবে বসে যেন তাদের তীর্থ হচ্ছে মিটসেফ আর তারা তপস্বী। তাদের এ অবস্থায় দেখলে যে কেউই বুঝতে অসুবিধে হওয়ায় কথা নয়, বাংলা বাগধারায় বেড়াল তপস্বী কথাটা কেন এসেছে। প্রথম প্রথম গৃহকর্ত্রী মনে করতেন, বোধ হয় মিটসেফে রাখা খাবারের আশায় তারা পাহারা বসিয়েছে। আসলে মোটেই তা নয়। একটা ইঁদুর আটকে পড়েছিল মিটসেফের ভিতরে। বেড়াল ছানাদের সিসি ক্যামেরার চোখে ধরা পড়ে গেছে ইঁদুরের লুকোচুরি। ব্যস্! ইঁদুর ধরে হ্যান্ডবল না খেলা পর্যন্ত তাদের ঘুম ছিল না।
একদিন গভীর রাতে সবাই ভয় পেয়ে জেগে উঠে গেছে। ঘটনা কী? গৃহকর্ত্রীর কান্নায় ঘরের আর সব সদস্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। ঘটনা বিশেষ কিছু নয়, একটা বেড়াল ছানা নিখোঁজ। কোথায় যেতে পারে? সবাই খোঁজ লাগায়। কেউ জানালার বাইরে তাকায়, কেউ টয়লেটের প্যানে দেখে, কেউ দেখে কার্নিশে। না, কোথাও নেই। ঘরের বড় ছেলের আবার এ বিষয়ে মাথা পরিষ্কার। সে ফ্রিজকে ঠেলেঠুলে বের করে দেয় লালকে। যে ফাঁকা দিয়ে লালে ঢুকেছিল দেয়ালের কোনায়, সে ফাঁকা জায়গাটা বোতল দিয়ে আটকে যাওয়ায় আর লাল বের হতে পারছিলো না। বড় ছেলে তাকে বের করে আনতেই সে জিভ দিয়ে তার হাত চাটতে শুরু করে দিলো কৃতজ্ঞতায়। আহা! চারটে বেড়াল ছানার দাপাদাপিও যে দেখতে ভালো লাগে তা ঝিন্টি-জবাদের দেখেই বুঝা গেল।