প্রকাশ : ১২ মে ২০২৩, ০০:০০
আমি আকাশ থেকে সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছিলাম। গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাতেও মানব জাতির একটা হাতও আমার জন্য বাড়িয়ে দেয়নি। তাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তো দূরের কথা সেবা যত্ন করে আবাসিক সমস্যাটুকুও সমাধান করার চেষ্টা টুকু ও করে নি। আমার গড়ণের কথা হয়তো কেউ জানতো না। আমার নিরত্তর স্বপ্নোত্থিত চোখও দেখেনি কেউ হয়তো। স্বপ্নে আঁকা কবিতার পাতা শেষ হয়েও হয় নি শেষ তবুও আঁকি স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। আবাবিল পাখির মত নিজের স্বপ্ন গড়ণ করি। চেয়ে দেখি নিজের স্বপ্নগুলো তবুও পেয়েও পাইনি তা। সভ্যতা, সততা, ধৈর্য, সাহস, আত্মত্যাগ নিয়ে বেঁচে থাকা আমি।
পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রাইভেট কলেজে জব করি। দিনশেষে মাস শেষে এখন খুব ভালো টাকা উপার্জন করি। যেখানে এখন আমার দিনকাল খুব ভালোভাবে কেটে যায়। আমি এখন একটি কলেজের খবপঃঁৎবৎ রহ সধঃযবসধঃরপং ফবঢ়ধৎঃসবহঃ. এবং রোবটিক্সের হেড। যেখানে স্বপ্নগুলো কিভাবে সফল হয়েছে? কিভাবে এই জায়গাতে আসা? তা নিয়েই আজ আমার গল্প তোমাদের সাথে শেয়ার করবো।
জীবনটা কত বড় তা ছোটবেলাতেই শিখেছি। আর তার ধায় বায়ও তখন থেকেই নিতে শিখেছি। পড়াশোনা আমার ছোটবেলা থেকে খুব ভালো লাগতো। আমি যেখানেই কোন কিছু শেখার থাকতো সেখান থেকে শিখে নিতাম। আমি শিখতে ভালোবাসতাম তাই শিখার টানে জীবনকে সাদা মাটা একটা জীবন দিয়েছি। কখনো চাহিদা করি কোন কিছুতে। কোন কিছুতে আসক্ত ও হতে পারি নি পরিবার আর নিজের লক্ষ্যের মাঝে। নিজের চাহিদা বলতে শুধু পড়াশোনাই ছিলো। কাজ পড়াশোনা আর ভবিষ্যতের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার টাইম বা সময় কোন টাই ছিলো না আমার জীবনে। জীবনে বাঁচতে হলে অনেক কষ্টের মাঝেও বেঁচে থাকা লাগে যদি পরিবার গরিব হয়। সময় এবং পরিস্থিতি খারাপ হলে আত্মীয়-স্বজন সবাই দূরে সরিয়ে দেয়।
আমি এখন বেশ ছোট ক্লাস ফাইভ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠিলাম। পরিবারের দোয়া আর ভালোবাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেলাম। স্কুলের মধ্যে আমি একমাত্র ছাত্র ছিলাম যে বৃত্তি পেয়েছিলো। আমি পরিবারের বড় ছেলে তাই পরিবারের সুখ দুঃখের ভার আমার উপরও পড়তো। আমি গ্রামে বড় হয়েছি তাই তেমন ভালোভাবে কোনকিছু চিনতামও না জানতামও না। পরিবার আর নিজের পড়াশোনা খরচ চালানো কতটা কষ্টের তা শুধু সেই জানে যেই ছেলেরা সেই পরিস্থিতিতে শুধু তারাই বুঝে। আমার জীবনটা খুব ছোট তবে তার গল্পটা একটু অন্যরকম আর অনেক বড়। আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন আমার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। যার ফলে আমার পড়াশোনাটা বন্ধের পথে চলে যাচ্ছিল।কি করব কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবুও কোন রকম ভাবে স্কুলের লাইফ শেষ করলাম। খেয়ে না খেয়ে হলে ও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি।
গ্রামের বাড়ি তাই তেমন কোনো কাজও নাই। আর এমনিতেও আমি হাই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম তখন। কাজ করতে না পারলে ও টিউশন করিয়ে নিজের পড়াশোনা মোটামুটি চালিয়ে নিতাম। মাস শেষে ১৫০০ টাকা পেতাম। নিজের পড়াশোনা এবং প্রাইভেট আর কিছুটা পরিবারকে দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি অনেক ভালো কাটছিল। এস এস সি পরীক্ষার পর দুই মাস সময় পেয়ে একটা বিকাশের দোকানে ঢুকলাম। মাস শেষে সেখানে পেতাম তিন হাজার টাকা করে। তবে পরিবারের সমস্যা যেন বেড়েই চলেছে। দিন দিন যেন আর্থিক অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হতে যাচ্ছে। পরিবারের আর্থিক এত সমস্যা তা দেখে কিভাবেই বা পড়াশোনা করবো। কাজ শেষে শুধু এগুলোই ভাবতাম। এতকিছু ভাবতে ভাবতে এসএসসি জিপিএ-৫ নিয়ে পার হলাম। এস এস সির ফলাফল দেখে স্কুলের স্যার রা ও বেশ খুশি হলো। তাদের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেলাম। সারাদিন কাজ করে রাতে পড়াশোনা করতাম। জীবনের প্রথম লক্ষ্য ছিল পড়াশোনা করা। তাই সবকিছু এক সাইড করে রেখে হলেও পড়াশোনা ছাড়তাম না।
ইন্টারে উঠার পর যেন নতুন করে আবার জীবন শুরু হলো। আবার নতুন করে কষ্ট কে ফেস করতে হবে। ইন্টারে ভর্তি হলাম কিন্তু ক্লাস করতে পারছিলাম না। প্রথম প্রথম ক্লাস করলেও কিন্তু পরে আর করা হয়ে উঠেনি। সকালে দুইটা ব্যাচ পড়িয়ে কাজে যেতাম ৮টায় রাত ৭-৮ অব্দি এই দোকানের মালিকের মেয়েকে পড়াতাম। আমি সকাল ৫টায় ৬-৭ টা , ৭-৮ টা অব্দি টিউশন করাতাম। দোকানদারের মেয়েকে পড়াতাম।আর তার জন্য তিনি আমাকে ৫০০ করে দিতো।আরো দুইটা ব্যাচ পড়াতাম। এখানে ছাত্রছাত্রী ছিল দশ জন মোট ২০০০ টাকা পেতাম।এভাবে টিউশন ও কাজ করে নিজের পড়াশোনা এবং বোনের পড়াশোনা করাতাম। পরিবারকেও কিছু দিতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে রাতে গিয়ে নিজের পড়াশোনা করতাম। ১১ টায় বসতাম ২/৩ টায় পড়া থেকে উঠতাম। প্রতি রাতে সর্বোচ্চ ২-৩ ঘন্টা ঘুমাতাম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পড়াশোনা করেছিলাম। বাবা এর মধ্যে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিতে বলছে। কারণ বাবা তখন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইন্টার মাঝ পথেই বাবা আমাকে বলে পড়াশোনা রেখে বাহিরে চলে যেতে। পরিবারের এই অবস্থা এখন সে ও অসুস্থ এখন পরিবারকে চালাতে হলে আমি যেন বাহিরে চলে যাই। বাবা অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে সবকিছু ঠিক করতে ব্যস্ত আর আমি সেখানে পাত্তা না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বাবা এত অসুস্থ হয়ে পড়ে যে তাকে ঢাকা হসপিটাল ভর্তি করাতে হয়েছিলো। ডাক্তার অনেক টেষ্ট দেয়। যা শোনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম নাহ। ডাক্তার বলে ওনার নাকি ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা না হলে মারা যাবে। যেটা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট কর হয়ে উঠেছিলো। তবুও বাবাকে বাঁচাতে আমরা প্রাণ পনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বাবার সম্পূর্ণভাবে সবটুকু দিয়ে চাচ্ছিল যেন আমি বিদেশে চলে যাই। মা বাবা বারবার বলছিল বাইরে যাওয়ার কথা কিন্তু আমি রাজি হইনি। বাবার এই অবস্থা তার মধ্যে দিয়ে আমি চলে যাবো এটা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। বাবার এই মরার পথেই চেয়েছিলো যেন তার ছয় বোনের বাড়িতে একেক দিন থেকে থেকে চিকিৎসা নেয়। কিন্ত আমার বাবার পোড়া কপালে ও তা জোটে নি। বাবাকে আবার যখন ঢাকা নিয়ে যাই তখন আমার এক ফুলের বাড়িতে নিয়ে যাই। বাবার যখন ইচ্ছে তাই ভেবেছিলাম বাবার ইচ্ছেতেই ফুফুর বাড়িতে থেকেই তার চিকিৎসা করাবো। গেলাম তাদের বাড়িতে কিন্ত তারা ভেবেছিলো এটা ছোয়া ছুই রোগ তাই তারা ভুলভাল বুঝিয়ে আমাদেরকে বের করে দিলো।কোন ফুফুর বাড়িতেই জায়গা হয় নি। সেখান থেকে চলে এলাম। তবে বাবাকে বাঁচাতে পারলাম নাহ। ঠিক মতো চিকিৎসা না পেয়ে সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢেলে পরতে হয় আমার বাবাকে।
বাবার অসুস্থতার মধ্যেই আমার ইন্টার মিডিয়েট কমপ্লিট হয়েছিলো। বাবা অসুস্থ তবে বাবা তখন ভিশন খুশি হয়েছিলো।
বাবার অসুস্থতার মাঝেই আমি যেভাবে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, দোকানের থেকেই দেখা যায় স্কুল। আর আমার দোকানের মালিক থেকে স্কুলের এক শিক্ষক জেনেছে আমি কেমন পড়াই। আমার পড়ার মান ভালো দেখে তিনি বলেন আমার বয়স হয়েছে আমার একটা ব্যাচ পড়াবো না। সে যদি পড়াতে চায় তাহলে তাকে পড়াতে বইলেন। ওই ব্যাচে আছে ৩১ জন। সকাল ৭-৮ টা অব্দি পড়াতে হবে। আমাকে বললো পড়াতে। তো আর কি আমি পড়াতে শুরু করলাম। ৩০ জন বেতন দিতো ১ জনকে ফ্রী পড়াতাম। এভাবেই একটু একটু করে সামনের দিকে আগাচ্ছিলাম। আমি দোকানে ছিলাম আজ আমার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি সেদিন প্রথম আমার বাবার চোখে পানি দেখেছিলাম। আমার রেজাল্ট দেখে বাবা সেদিন বলেছিল বাবা তুই যতটুকু পড়তে চাস পড়। সেদিন বলেছিলে তুই যা করতে চাস কর বাবা। বাবা আমার কষ্ট দেখে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। বাবার অসুস্থতার মাঝেই বাবা বলেছিলো বাবা তোর স্বপ্ন পূরন করতে যত টুকু যেতে হয় তুই যা বাবা। আমি বিভাগের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার অর্জন করেছিলাম। কলেজের গর্ব হয়ে গেলাম। পরে অনার্স পলিট্যাকনিক চান্স পেলাম। সেখানে ভর্তি হতে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসলাম। পৃথিবীর কোন সম্পর্কই টাকা ছাড়া মূল্য নেই। খালামনির বাসায় উঠলাম।যেখানে টাকাই সব সেখানে সম্পর্কের কোনো মানেই হয় না। আমি ছিলাম সেখানে কারন, সব কিছুর জন্য হলেও পড়াশোনা করে বড় হতে হবে আমাকে।
আমার লক্ষ্যে আমাকে পৌছাতে হবে এটাই চাই। অনার্স শেষ করেছি ৪ বছরে। এই ৪ বছরে টিউশন করে নিজে এবং পরিবারকে চালিয়েছি। আমি ছিলাম মায়ের বোনের বাড়ি সম্পর্কে আমার খালা তবে এমনভাবে দেখতে যেন আমি তাদের জন্য বোঝা। তাদের ইচ্ছে ছিল আমি যেন সারাদিন তাদের ছেলেমেয়েকে দেখি পড়াশোনা করাই। কিন্তু আমি সকাল ছয়টায় বের হলে রাত দশটায় বাড়িতে আসতাম। কলেজ, প্রাইভেট, টিউশন করিয়ে আর সময় হতো না। বাসায় এসে রাতে পড়তে বসতাম। ১-২ ঘন্টা ঘুমিয়ে আবার ৬ টায় বের হয়ে যেতাম। খালামণি কখনো আমাকে আমার রুমে দেখতেও যায়নি। আমার রুমটা ছিল একটা টিনের ঘর। যেটা মাটির ছিল তবুও পড়াশোনার জন্য এই ছোট্ট একটা টিনের ঘরে থেকেই ৪ বছর ধরে পড়াশোনা করেছি। খাবারের কোন মান ছিল না। আমি যে আমার খালার বাড়ি আসছি তা আমাকে না দেখলে কেউ বলতে পারবে না।
এভাবে একটু একটু করে আমি আমার পড়াশোনা শেষ করেছি। এখন আমি খুব বড় একজন সম্মানিত মানুষ হয়েছি। বর্তমানে গধঃযবসধঃরপং খধপঃঁৎপধষ এখন আমাকে হাজার হাজার স্টুডেন্ট চিনে। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কষ্টের সময় একমাত্র বিকাশের দোকানদার আমাকে যথেষ্ট পরিমাণ হেল্প করেছে। আর তিনি আমাকে ২য় বারের মতো চেষ্টা করার সুযোগ দিয়ে আমাকে স্বপ্নে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।তবে আজ আমার বাবা নেই। না ফেরার দেশে অনেক আগেই চলে গেছে তিনি। তবে আমাকে এতোটুকুতে আনতে তাদের সাপোর্ট না থাকলেও আমি হয়তো এত দূর আসতে পারতাম না তাদের দোয়া ছাড়া। তবে ওপার থেকে দোয়া কইরো যাতে আমি এভাবেই কাটাতে পারি আমার জীবন।