প্রকাশ : ১২ মে ২০২৩, ০০:০০
খুব চিন্তায় পড়ে গেছে প্রখর। কাল সকালে স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট। বিষয় : রবীন্দ্রনাথ। ক্লাস সেভেনে পড়ে। পাঠ্য বইতে এ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের তালগাছ আর আমাদের ছোট নদী কবিতা দুটি পড়েছে। কোন্ একটা ক্লাসে বীরপুরুষ কবিতাটি ছিল। কিন্তু মাঝখানে করোনা ভ্যাকেশানের কারণে তার আর সেই কবিতা পড়া হয়নি। ক্লাস সেভেনের শুরু থেকেই শিক্ষক-অভিভাবক সবাই ক্ষুব্ধ। তাদের ক্ষোভের কারণ, নতুন বই ও পাঠদান পদ্ধতি পুরোনো নিয়মের সাথে মিল নেই মোটেই। ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা-পাশ নিয়ে অভিভাবকেরা চিন্তিত। অথচ তাদেরকে বার বার বলা হয়েছে, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চলেছি।
ভবিষ্যতের পৃথিবীতে পুরোনো পদ্ধতির পড়াশোনার কোন মূল্য থাকবে না। তাই নূতন সিলেবাসে পড়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। যে যাই বলুক না কেন, নতুন পদ্ধতি প্রখরের খুব ভালো লেগেছে। মুখস্থ করার কিছুই নেই। কেবল চোখে দেখো আর ভাবো। তারপর নিজে করো। এভাবে করলে আর ভুলে যাওয়ার ভয় থাকে না। রবীন্দ্রনাথের ওপর অ্যাসাইনমেন্ট হওয়াতে প্রখর একটু বেশি উত্তেজিত। কারণ তার ছবি আঁকতে অনেক চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর গোঁফ-দাড়ির খাঁজ মিলাতে পারে না। এই ছবি আঁকা নিয়ে প্রখর রবীন্দ্রনাথের ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। এই অ্যাসাইনমেন্ট আবার তাকেই উপস্থাপন করতে হবে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবার সাথে প্রখর আলোচনা শুরু করে দেয়। এতো করে ভেজা মোজা পায়ে দিয়ে খা খা রোদ্দুরে ঘুরেও তার জ্বর হোলো না মোটেই। বাবা ডাক্তার বলেই খুব সহজে প্রখরের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন, আসলে রবীন্দ্রনাথের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ছিল। ঠিক যেমন আমরা বাঙালিদের কোভিডের বিপরীতে ইমিউনিটি গড় মানের চেয়ে বেশি। গল্প করতে করতে বাবা একসময় জানালেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি পছন্দ করতেন। তিনি কাটা-ছেঁড়া পছন্দ করতেন না। খাবার পরিবেশন করতে করতে বাবা-ছেলের কথার মাঝখানে মা ঢুকে গেলেন। তিনি বললেন, আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ রেলিংগুলোকে মারতো কেন? প্রখর বলে ওঠে মাকে, এটা আমি জানি। তিনি স্কুলে যা দেখতেন তাই-ই এসে নিজে করতেন। তিনি বেত হাতে নিয়ে স্যার হতেন আর সিঁড়ির রেলিংগুলো হতো ছাত্র-ছাত্রী। পড়া না পারলে তাদের সপাং সপাং পিটাতেন। এই-ই ছিলো রবির খেলা।
ভাত খাওয়ার পর প্রখর তার অ্যাসাইনমেন্ট টেবিলে রেখে অতৃপ্ত মনে ঘুমুতে যায়। কিন্তু ঘুম আসে না। তারপরও আলো নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
চোখে তার ঘুম প্রায় লেগে এসেছে। এমন সময় তার চোখ যায় পড়ার ঘরে। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বলে ওঠে।
প্রখর এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে। উঁকি মেরে দ্যাখে তার পড়ার ঘরে কে এসেছে। সে এমনিতেই সাহসী ছেলে। ভয় না পেয়ে এক সময় সোজা ঢুকেই গেল রুমে। রুমে ঢুকে তো তার চোখ চড়কগাছ! এ কাকে দেখছে! এ যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ! তার রঙ আর তুলি নিয়ে আঁকছে তারই অ্যাসাইনমেন্টের কাগজে। প্রখরকে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলো, তোমাকে সাহায্য করতেই তো এলাম। আমার ছবি তুমি আঁকতে পারছিলে না। আমিই তাই এঁকে দিয়ে গেলাম।
প্রখর চেয়ে দ্যাখে, সত্যিই তো! তার অ্যাসাইনমেন্টের খাতার ঠিক যে স্থানে ছবি থাকার কথা সেখানেই রবীন্দ্রনাথ শোভা পাচ্ছে। ছবিতে ফিনিশিং স্ট্রোক দিতে দিতে রবীন্দ্রনাথ বলতে শুরু করলেন, শোনো প্রখর, শিল্পী ছবি আঁকতে গেলে পোর্ট্রেট হুবহু একই দেখতে হবে তা কিন্তু নয়। শিল্পীরও কিছু স্বাধীনতা আছে। তুমি তোমার চোখে শিল্পের বিষয়টাকে যেভাবে দ্যাখো সেভাবেই আঁকবে। তাহলে তোমার স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে। তুমি কি খেয়াল করেছো যে এক একজনের হাতে পোর্ট্রেট এক এক রকম! সবারটাই সুন্দর কিন্তু যার যারটা আলাদা। এবং সবার আঁকাতেই রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু নাক-মুখণ্ডচোখ তো মিলতে হবে, তাই না। প্রখর বলে ওঠে। হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ঠিক তা ঠিক, জবাব দেয় রবীন্দ্রনাথ। তবে শতভাগ মিলতেই হবে এমন নয়। একটা অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে পারলেই হোলো।
কথার এক পর্যায়ে প্রখর বললো, আপনার কবিতাতে ছোটোরা কেমন জায়গা দখল করেছে? রবীন্দ্রনাথ হেসে দিলেন হো হো করে। বেশ ভালো প্রশ্ন করেছো প্রখর। আগে বলো তো, তোমার এই সুন্দর নাম কে দিয়েছেন? বাবা। প্রখর বললো। বেশ বেশ। তোমার নামের অর্থ কী? তীব্র। হুম। দেখা যাচ্ছে, তোমার নামের সাথে কাজের বেশ মিল আছে। তোমার প্রখর কৌতূহল। আমি তো ছোটোদের জন্যে অনেক অনেক লিখেছি। যেমন ধরো শিশু ভোলানাথ, শিশু ইত্যাদি। তোমাদের জন্যে লেখা কি সহজ! কত ভাবতে হয়। কথা বলতে বলতে তিনি আপনমনে গুনগুনিয়ে বলছেন, 'আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর...।' প্রখর এ কবিতা পারে। তাই সে-ও আবৃত্তি করতে থাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথ প্রখরের পিঠ চাপড়িয়ে দেয় প্রখরের। এমন সময় কারেন্ট চলে যায়। আজকাল কারেন্ট বেশি ঘন ঘন যাচ্ছে এবং একবার গেলে দুঘন্টার আগে আসে না। তবে এবার যাওয়ার সাথে সাথেই আবার কারেন্ট চলে আসে। সবই ঠিকঠাক আছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কোথাও নেই। প্রখর টেবিলের তলে, দরজার পেছনে খোঁজে। কিন্তু কোথাও পায় না। রবীন্দ্রনাথ নেই। মধ্যরাতের লোডশেডিংয়ে প্রখরের রবীন্দ্রনাথ হাওয়া!