শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

কাক ও কোকিলের দ্বন্দ্ব
অনলাইন ডেস্ক

বসবাসের জন্যে সবারই আশ্রয় লাগে। কেউ তাকে বলে ঘর আর কেউ বলে বাসা বা নীড়। পাখিদের আশ্রয় বা আবাসস্থল হলো নীড়। তারা গাছের কোটরে বা ডালে খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। সবচেয়ে সুন্দর বাসা বানায় বাবুই পাখি। তাদের বাসা নির্মাণের ধরনটাই শিল্প। সব পাখি বাসা বানাতে পারে না। বাসা বানাতে অপারগ আজকের পাখিদের মধ্যে কোকিল হলো অগ্রগণ্য। কিন্তু বাসা বানাতে না পারলে তো ছানার জন্ম দেওয়া যায় না। কোকিল তাই কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। এ কারণে কোকিলকে বলে পরভৃৎ। অর্থাৎ যে পরের বাসায় ডিম পাড়ে।

আমরা যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে কাক ও কোকিলের মধ্যে বেশ ভাব ছিল। তারা উভয়ে নিবিড় বন্ধু ছিল। যা কিছু নিজেরা করতো তার সবকিছুই সমঝোতা ও প্রীতির ভিত্তিতে করতো। কোকিল বাসা বানাতে অক্ষম ছিলো বলে কাক তার বাসায় কোকিলের ছানাগুলো পালতো। কোকিলের ছানাগুলো কাকের বাসায় বড় হতে হতে কাককে আপন মাসীর মতোই জানতো। কাকেরও কোকিল ছানাদের প্রতি গভীর মায়া পড়ে যায়। কিন্তু বন্ধু হলেও তাদের মধ্যে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল। তারা একই গুরুর কাছে গান শিখতো। তাদের গুরু সমান ভালোবাসা দিয়ে তাদের গান শেখাতো। কাক ও কোকিল উভয়ের গানের গলা ছিল সুরেলা। গায়ের রঙেও তাদের মিল ছিল। উভয়ের গায়ের বর্ণ কালো। পাখিদের যে কোন সভায় কাক ও কোকিলের গান পরিবেশনের জন্যে আব্দার আসতো। গানের সুমিষ্ট গলার জন্যে পাখিরাজ্যে তাদের যথেষ্ট কদর ছিল। যখন প্রকৃতিতে বসন্ত আসতো তখন কাক ও কোকিলের গানে চারদিক মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। ফুলে ফুলে এই দুই পাখির গান শুনে তৈরি হত শিহরণ। তারা কলি হতে কাক ও কোকিলের গান শুনে দ্রুত ফুল হয়ে ফুটত। কে বেশি গানে দক্ষ তাই নিয়ে পাখিদের মধ্যে তর্কের ঝড় উঠত। চড়ুই, টুনটুনি দোয়েলের ছানারা এই দুই পাখির গান শুনে ঘুমুতে যেত। ময়না, টিয়েরা তাদের গানের সাধনায় ভুল হলে কাক ও কোকিলের দ্বারস্থ হতো।

একদিন পাখিদের রাজ্যে সেরা গায়ক পাখি নির্বাচনের প্রতিযোগিতার ঘোষণা এলো। অনেকদিন ধরে প্রতিযোগিতার নাম নিবন্ধন চললো। যত পাখি ছিল তারা সবাই নাম নিবন্ধন করলো। প্রতিযোগিতায় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে বাজপাখিকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। বাজপাখির চোখ যেন সিসি ক্যামেরা। যারা শৃঙ্খলা মানবে না তাদের ধরে নখরের আঘাতে আহত করার দায়িত্ব পেলো ঈগল। প্রতিযোগিতায় বিচারক হলো দুজন। একজন হলো কাক ও কোকিলের গানের গুরু। আর অন্যজন হলো ফিঙে। প্রতিযোগিতার মিডিয়া পার্টনার হলো বউ কথা কও। পাখিদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনা শুরু হলো। কে হবে সেরা পাখিকণ্ঠ।

পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হলো প্যাঁচা। তাকে বলে পাখিকুলের মন্থরা। মন্থরা হলো একটা পৌরাণিক চরিত্র। সে ছিলো রাজা দশরথের দ্বিতীয় রানী কৈকেয়ীর দাসী। যত প্যাঁচ লাগে এই মন্থরা দাসীর কুবুদ্ধিতে লাগে। তেমনি পাখিকুলে প্যাঁচার জন্যেও এরকম বেশ প্যাঁচ লাগে। প্যাঁচ লাগায় বলেই তার নাম প্যাঁচা। সে হলো বাক্যবাদী। এক পাখির কথা অন্য পাখিকে সে রঙচঙ মাখিয়ে বলে। ফলে পাখিদের মধ্যে সমপ্রীতি নষ্ট হয়। রাতের বেলা সে প্যাঁচবুদ্ধি কষার জন্যে ভাবতে ভাবতে ঘুমুতে পারে না। এজন্যে তার চোখ থাকে কটকটে হলুদ আর টকটকে লালের মাঝামাঝি। দেখলে মনে হয় তার যেন সারাজীবনই জ-িস। রাতে প্যাঁচা কষার কারণে ঘুমুতে পারে না বলেই সে দিনের বেলায় ঝিমোয়। কাক ও কোকিলের মধ্যে বেশ বোঝাপড়া দেখে প্যাঁচার মনে অসহ্য লাগে। সে তাই তক্কে তক্কে থাকে কীভাবে এই দুয়ের ভাবকে ভাঙা যায়। সে অনেকবার চেষ্টা করেছে এর মধ্যে। কিন্তু সফল হয়নি। এবার গানের প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে সে এক মোক্ষম প্যাঁচ কষল। মনে মনে তার প্যাঁচের তারিফ করে সে খুব খুশি হল। এখন অপেক্ষার পালা। প্যাঁচা কাককে প্রথমে তার লক্ষ্যবস্তু বানায়। সে জানে, কাক সহজেই অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়। তাই কাককে বশ করা সহজ হবে। এই ভেবে প্যাঁচা বললো, ভাই কাক, তোমার সাথে আমার কিছু গোপন কথা আছে। প্যাঁচাকে এভাবে কথা বলতে দেখে কাকের আতঙ্ক তৈরি হল। কারণ প্যাঁচা যার বন্ধু হয় তার আর শত্রু লাগে না। ভয়ে ভয়ে কাক প্যাঁচার সাথে আড়ালে এলো গোপন কথা শুনতে। প্যাঁচা একটু গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করল। ভাই কাক, তুমি অনেক বুদ্ধিমতী আর গুণবতী পাখি। আমাদের রাজ্যে তোমার মতো সুরেলা পাখি আর নেই। সেদিন তোমার নামে কোকিল আমার কাছে একদম যা তা বললো। কাক এসব শুনতে আগ্রহী না। তবু বললো, কী বলেছিলো কোকিল? প্যাঁচা বললো, না, ওসব শুনতে যেও না। শুনলে তোমার মন খারাপ করবে। কাক বললো, আচ্ছা তাহলে বলার দরকার নেই। প্যাঁচা কথা কেড়ে নিয়ে বললো, আরে না, দরকার আছে শোনার। আলবাৎ শুনবে। কোকিলের কত্তো বড় সাহস। সে তো আর জানে না, আমি তোমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। তো সে বললো, তুমি নাকি যা তা একটা পাখি। গান তো না যেন কোলা ব্যাঙের ডাক। কী এমন গান গায় সে? এটুকুন বলেই প্যাঁচা কথা বন্ধ করে ফেললো। কারণ একটু দূরেই কোকিলকে আসতে দেখা গেছে। কাকও নিজেকে সামলে নিলো। কোকিল এসে কাক ও প্যাঁচার সাথে হাত মিলিয়ে বললো, কি হে? তোমরা কী গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছো? মনে হচ্ছে কোন একটা কঠিন প্যাঁচ কষছো? প্যাঁচা বললো, না তেমন কিছু নয়। আসলে তোমার কথাই হচ্ছিল। আমার কথা! কোকিল একটু অবাক হলো। তা কী বলছিলে আমার সম্পর্কে তোমরা? কোকিলকে দেখে কাকের মনে কষ্ট হলেও মুখে কিছুই বললো না। প্যাঁচা খুব দ্রুত তার ভোল পাল্টে ফেললো। প্যাঁচা যে এতো মিথ্যে বলতে পারে তা কাক কখনো আঁচ করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যেই প্যাঁচা কথা ঘুরিয়ে বললো, দেখো না ভাই কোকিল, কাক আমাকে নিরালায় ডেকে বললো, তুমি নাকি একটা যাচ্ছে তাই পাখি। তুমি নাকি গান গাও না যেন হেঁড়ে গলায় ষাঁড়ের ডাক ডাকো। প্যাঁচার কথা শুনে কাক বললে, তুমি কী বলছো প্যাঁচাদি? আমি কবে একথা বললাম? বরং তুমিইতো আমাকে একা ডেকে গোপন কথা বলবে বলে এনে কোকিলের নামে খারাপ কথা বললে। প্যাঁচা অবাক হওয়ার ভাণ করে বললো, আমি বলেছি! অসম্ভব। আচ্ছা কোকিল বৌদি, আমি কি একথা বলতে পারি? কোকিল এতো প্যাঁচঘোচ বুঝে না। সে সহজেই প্যাঁচার কথা বিশ্বাস করে ফেললো। কাককে কোকিল আঘাত করে বললো, ঠিক আছে, তুই যখন এতই আমাকে যা তা ভাবিস্ তবে আমার সাথে আর বন্ধুত্ব রাখিস্ না। আমি আর তোর কাছে আমার বাচ্চাদের রাখবো না। তুই আর আমার বাচ্চাদের মাসী হতে পারবি না। কাক কোকিলের হাতে-পায়ে ধরার উপক্রম হলো। অনুনয় করে সে বললো, না সই, এতো কঠিন তুমি হয়ো না। আমি কোন কথা বলিনি তোমাকে নিয়ে। বিশ্বাস করো। বরং প্যাঁচাই কী সব আলতু ফালতু আমাকে বলে যাচ্ছিল। আমি ওর কথা একটুও বিশ্বাস করিনি। কাকের কথা শুনে প্যাঁচা দারুণ অভিনয় শুরু করে দিল। মেকি কান্নার অভিনয় করে মেঝেতে গড়াগড়ি শুরু করে দিলো। শেষকালে আমার কপালে এই ছিল গো! আমাকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে দিল কাক। হায় হায় হায়! আমাকে শেষ করে দিল কাক। তুই যদি কোকিলকে এতই ঘৃণা করিস্ তবে তাকে সোজাসুজি বললি না কেন? আমাকে শোনাতে গেলি কেন রে? আমার এখন কী হবে গো! প্যাঁচার অভিনয় দেখে কাক তো থ! তার মুখে আর কোন কথা নেই। কোকিল এ ঘটনা দেখে আর সেখানে রইল ন। মুখ ভার করে গট গট করে এসে পড়লো নিজের জায়গায়। কোকিলকে রাগ করে চলে যাতে দেখে প্যাঁচা হুট করে উঠে দাঁড়াল। কাকের দিকে তাকিয়ে আহা! বেচারা! বলে সে কাককে ফেলে রেখে চলে গেল।

কিন্তু ঘটনাটা এতো সহজে মিটল না। ঘটনা গড়াতে গড়াতে তাদের গানের গুরু পর্যন্ত চলে গেল। গানের গুরুকে কাক ও কোকিল খুব যমের মতো ভয় পায়। গানের গুরু পরদিন বিকেলে কাক ও কোকিলকে ডেকে পাঠাল নিজের কাছে। এর একটা বিহিত তাকে করতে হবে। কাক ও কোকিল ভয়ে ভয়ে গানের গুরুর কাছে গেল। গানের গুরু দুজনকেই দুই দিকে বসাল। তারপর জিজ্ঞেস করলো আসলে কী হয়েছিল। কাক সবকিছু খুলে বলল। এরপর গুরুজি কোকিলের কাছে তার বক্তব্য জানতে চাইল। কোকিল বললো, গুরুজি, আমার বেয়াদবি নিবেন না। কাককে আমি আমার নিজের প্রাণের অধিক ভালোবাসি এবং ভরসা করি। কিন্তু সে যা করেছে তাতে এর একটা উপযুক্ত বিচার না হলে আমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিব গুরুজি। গুরুজি প্যাঁচাকেও ডাক পাঠালেন। কাক ও কোকিলের এই বিবাদে প্যাঁচাই একমাত্র সাক্ষী। প্যাঁচার দিকে তাকিয়ে গুরুজি বললেন, কি হে প্যাঁচা, বলো দেখিনি সেদিন ঠিক কী হয়েছিল? প্যাঁচা হলো একে তো নাচুনে বুড়ি, তার উপরেএবার ঢাকের বাড়ি। প্যাঁচা মনের মাধুরী মিশিয়ে যা হয়নি তা-ও বলল কাকের নামে। পাশাপাশি কোকিলের নামেও আজেবাজে বলতে ছাড়লো না। সবার বক্তব্য শুনে গুরুজী বললেন, কাক, তুমি কি চাও তোমাদের বন্ধুত্ব আর না থাকুক? না না গুরুজী, কখনো না।

আপনি এভাবে বলবেন না। আমি তাহলে আর বাঁচবোই না। আমি যে কোন ভাবেই কোকিলের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই। গুরুজী এবার কোকিলকে জিজ্ঞেস করলেন, বল কোকিল তুমি কী চাও? কোকিল চরম রেগে বললো, গুরুজী আমি কিন্তু আর ওর মুখ দেখতে চাই না। আমি ওর গান শুনতে চাই না। গুরুজী পড়লেন মহা বিপদে। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে দুদিন সময় দাও। দুদিন পর আমি সিদ্ধান্ত জানাবো।

কাকের দুটো দিন যেন দুই যুগ। সময় তার কাটে না। গুরুজী না জানি কী সিদ্ধান্ত দেন। তার ছানাদের নিয়ে সে খুব চিন্তায় আছে। ওদিকে কোকিলেরও মনে খুব কষ্ট। কাকের মতো এক প্রিয় বন্ধুকে হারানোর কষ্ট। কোকিলের বুকে কষ্টরা পাথর হয়ে চেপে বসে আছে। তার দুদিন নাওয়া খাওয়া নেই। এতোদিনের পুরানো বন্ধুকে হারাতে হবে তাই কোকিল দিশাহারা। এদিকে প্যাঁচার খুশি পেটে আঁটে না। দুই পুরোনো বন্ধুর মধ্যে ফাটল ধরাতে পেরে তার দুদিন ধরে খুশির চোটে খিদে লাগে না। প্যাঁচার ঘুম নেই প্যাঁচ লাগাতে পারার খুশিতে। আর কাকের ঘুম নেই কোকিল ও কোকিলের বাচ্চাদের চিন্তায়। কোকিলের ঘুম নেই প্রিয় বন্ধুর সাথে আসন্ন বিচ্ছেদে। কোনোমতে দুটো দিন কাটলো। এর মধ্যে গানের প্রতিযোগিতার অনুশীলনও অন্যদের থেমে নেই। গুরুজীরও ঘুম নেই। তাঁর প্রিয় দুই শিষ্যের বিবাদের বিচার করতে গিয়ে। দুটো দিন গত হলে সবাই গুরুজীর কাছে এলো। গুরুজী সবাইকে বসতে বলে নিজে বলতে শুরু করলেন, শোনো বাছারা, একটা ভালো বন্ধু পাওয়া সাত জনমের ভাগ্যি। আমি চাইনা তোমাদের মধ্যেকার এই সুন্দর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাক। তোমরা বলো, তোমরা কি তোমাদের এই অমূল্য বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে চাও? কাক ও কোকিল উভয়েই জোর গলায় বললো, না গুরুজি, আমরা আমাদের বন্ধুতা নষ্ট করতে চাই না। গুরুজি বললেন, ঠিক আছে। তাহলে কোকিল, তুমি কাকের বাসায় তোমার ছানাদের বড় করতে দিবে এবং তা করবে বংশ পরম্পরায়। যতদিন এ পৃথিবীতে কোকিল ও কাক থাকবে ততদিন কোকিলের ছানারা কাকের বাসায় বড় হবে। তুমি অন্য কোন পাখিকে এ দায়িত্ব দিতে পারবে না। বিচারের রায়ের প্রথম অংশ শুনে কাক খুব খুশি। আর যাই হোক, কোকিলের সাথে তার সম্পর্ক আর নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। গুরুজী এ অবসরে কোকিলের দিকে ফিরে বললেন, কোকিল, এটা তোমার কাছ থেকে আমার গুরুদক্ষিণা। আশাকরি তুমি আমাকে তোমার গুরুদক্ষিণা দেবে। কোকিল সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললো, আপনার আদেশ শিরোধার্য গুরুজি। এবার কাকের দিকে তাকিয়ে গুরুজি বললেন, শোন কাক, কোকিল তোমার কাছে তার সন্তানদের বড় করতে দিয়ে তোমার সাথে বন্ধুতা রক্ষা করেছে। নিজের সন্তানদের জন্মের পর হতে অন্যের কাছে রাখা যে কোন মায়ের জন্যে বিরাট কষ্টের এবং অসহনীয়। কিন্তু কোকিল তা করতে সম্মত হয়েছে। আশাকরি তুমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কাক সম্মতি জানিয়ে বললো, গুরুজী, আমি অবশ্যই আমার বন্ধু কোকিল ও আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কাকের কথা শুনে গুরুজী বললেন, আজ থেকে তুমি না ঘরে না বাইরে, আর কোনখানেই গান গাইতে পারবে না। তোমার প্রতি এ আমার আদেশ। এটাই তোমার গুরু দক্ষিণা। তোমার কণ্ঠে আর যেন কোনদিন গান শুনতে না পাই। গুরুজীর বিচার শুনে কাক কাঁদতে কাঁদতে সম্মত হলো।

ঘরে এসে কাক তার গানের সকল সরঞ্জাম ফেলে দিলো। সারাদিন সে কেবল মনমরা হয়ে থাকে। কোকিলের মনেও শান্তি নেই। কী সুন্দর গানের গলা ছিল কাকবন্ধুর। কী থেকে যে কী হয়ে গেলো! একটা দীর্ঘশ্বাস কোকিলের বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। যথাসময়ে গানের প্রতিযোগিতা হলো। কিন্তু কাক অংশগ্রহণ করতে না পারায় প্রতিযোগিতা জমল না। কোকিল প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেলো গানের প্রতিযোগিতায়। কিন্তু জিতেও কোকিল উল্লাস করতে পারে না। তার প্রিয়বন্ধু যে আর গাইতে পারবে না কখনো। এভাবে বেশ কয়েকদিন অতীত হলো। না গাইতে না গাইতে কাকের গলা বসে গেল। কাক সঙ্গীতবিদ্যা ভুলে গেল। সারাদিন সে কেবল কা কা করে ডেকে যায়। অন্যদের কাছে তা কেবলই কর্কশ কণ্ঠ বলে মনে হয়। বিচারকার্যের বছর দুয়েক গত হলো। কাকের বাসায় কোকিলের ছানারা বড় হতে থাকে। কাক কা কা রবে সারাদিন খাবার খুঁজে বেড়ায়। কুচক্রী প্যাঁচা বড় একটা অসুখে পড়ে। তার জীবনমরণ সমস্যা দেখা দেয়। সে স্বপ্নে দেখে, তার কৃত কর্মের দায় স্বীকার করলেই তার জীবন বাঁচবে। প্যাঁচা কোকিলকে খবর পাঠায়। কোকিল প্রথমে আসতে চায়নি। কিন্তু দু-চারবার খবর পাঠানোর পর কোকিল প্যাঁচাকে দেখতে যায়। প্যাঁচা তাকে দেখতে পেয়েই তার পা ধরে সকল সত্য স্বীকার করে। সে বলে, কাক ও কোকিলের নিজেদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব তার কাছে অসহ্য। তাই সে দু বন্ধুর মধ্যে ফাটল তৈরি করার জন্যেই মিথ্যে বলে কোকিলের মন বিষিয়ে দিয়েছে। সত্য কথা জানার পর কোকিল অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলো। অনুশোচনায় জ্বলতে জ্বলতে কোকিলের গলা দিয়ে বিরহের সুর বেরিয়ে এলো। ক্রমাগত বিরহের সুর তুলতে তুলতে কোকিল অন্য সুর ভুলে যায়। সেই হতে প্রতি বছর ফাগুন এলে কোকিল বিরহের গান শুনিয়ে যায়। আজও কাক ও কোকিল সেই ঘটনার জের টেনে চলেছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়