প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
শীতের দিন। বেলা ছোট হওয়ায় ক্ষেত খামারে কাজ করতেই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। দিল আলী গাছি দাদুর শীত এলে কাজের মাত্রা বেড়ে যায়। দুপুর পেরুতেই মাঠে ছুটতে হয়। পাটাচোরা তীরধরা মাঠে দিল আলী দাদুর বিশাল খেজুর বাগান। শ’ দুয়েক গাছের মধ্যে পালা করে তিন ভাগে তার কাটতে হয়। জিড়েন কাটা গাছের রস খুব ভালো হয়। দিল আলী দাদু আজ একটু আগে ভাগেই এলেন মাঠে। ভাঁড়গুলো ভালো মত ধুয়ে, শুকনো জায়গায় লম্বা করে মাঝে ধানগাছের পোয়াল বিছিয়ে দু’পাশে সারি করে সাজিয়ে পোয়ালের একপ্রান্তে ম্যাচ ঠুকে আগুন ধরালেন। আগুন এবং আগুনের ফুলকিতে পাজায় দেয়া আগুনের মত সমস্ত ভাঁড়গুলোর ভিতর শুকিয়ে ঝনঝনে কনকনে হলো। হাতে টোকা দিতেই বেজে উঠলো একেকটি ভাঁড়। ভালো মত শুকনো না হলে রস ঘোলা হয়। সবগুলো ভাঁড়ে দড়ির গলান পেঁচিয়ে নিলেন।
এবার দাদু একটি কড়া করে পানে চুন সুপারি মশলা দিয়ে সেজে মুখে দিলো। উঠে দাঁড়িয়ে মাজায় গাছ কাটা দড়িসহ ঠোঙা বেঁধে নিলো। ঠোঙার ভিতর দা হেসো ঢুকিয়ে আঙটায় একটি ভাঁড় বেঁধে নিয়ে গাছের সাথে দড়ি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঠকাস ঠকাস করে ওপরে উঠে পড়লেন। দিন তিনেক পর খেজুর গাছ কাটায় সূর্যের আলোয় গাছের কপাল বা টিকরে বেশ শুকিয়েছে।
এপ্রান্ত ওপ্রান্ত সুন্দর পাতলা করে কপাল কাটতেই নলি বেয়ে রস টপটপ করে পড়তে লাগলো। গাছের একপাশে পোঁতা গোঁজে ভাঁড়ের গলায় দড়ি কায়দা মতন বেঁধে নলি ভাঁড়ের মুখে সেট করে খেজুর গাছের সরপা দিয়ে ভাঁড়ের মুখ ঢেকে দাদু নেমে এলেন। সন্ধ্যা অবধি একের পর এক খেজুর গাছ নলিয়ে রস সংগ্রহে গাছ কাটলেন দাদু।
বাংলার গ্রাম্য মাঠে মাঠে এমন বৈচিত্রময় দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে? রাস্তার ধারে কিংবা নদীর তীরে আর জমির আইলে এমন অপূর্ব খেজুর গাছ কাটার দৃশ্য দু’চোখকে এক অনাবিল ছোঁয়ায় পরশ বিলায়। আবেগ আনন্দঘন অদ্ভুতময় গ্রামীণ বাড়ি সমাজের দৃশ্যায়ন কত যে মধুময়। ভালো লাগা ভালোবাসার সীমাহীন অকৃত্রিম বন্ধন। পারিবারিক হাসি আনন্দ খুশির এক অন্যরকম ফুরসত, যা স্মৃতির চোখে ভাসা অমলিন ছবি।
রাত পেরিয়ে ভোর হলো। মুয়াজ্জিনের আজানে ঘুম ভাঙলো দিল আলী দাদুর। হাত মুখ ধুয়ে অযু করে নামাজ আদায় করে দাদু বাঁক কাঁধে নিয়ে ছুটলেন মাঠে। নগা বাঁধিয়ে একেক করে গাছের রস ভর্তি ভাঁড়গুলো নামালেন। উঁচু গাছগুলোয় তরতর করে উঠে ভাঁড় নামিয়ে আনলেন। সব ভাঁড়ের রস একেক ভাঁড়ে ভর্তেই ভাঁড় বিশেক রসে ভর্তি হলো। বাঁকের দুদিকে দাদু দু’ভাগ করে সাজিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। দুষ্টু নাতি নাতনীদের সবাইকে ডাকলেন। ক’ভাঁড় রস হয়েছে গুনতে বললেন। এক দুই তিন নাতিরা গুনতে লাগলো আর দিল আলী দাদু ভাঁড়ের রস ছাঁকনে ছেঁকে চুলোয় সাজানো জালায় বা টালায় ঢালতে লাগলেন।
জালার আকার মুখে দাদী বসে শুকনো বেগো আর নাড়ার জ্বালে বাইন গনগনে করে তুললেন, রসে টলোমলো জালায় ধীরে ধীরে গাঁদ উঠতে লাগলো। ওড়োং দিয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরে দাদু গাঁদ ফেলতে লাগলেন। দুষ্টু নাতি নাতনীরা কাপে ঢেলে ঠাণ্ডা রস পাটখড়ি পাইপ বানিয়ে চুষে চুষে খেতে খেতে আগুন পোহাতে লাগলো। জালায় জ্বালরত রসগুলো তাত রস পেরিয়ে গুড়ের আকার ধারণ করলো। আচ্ছা মতন ঘুটে জ্বাল নিভিয়ে নিচের একপ্রান্তে দুদিকের হাতল ধরে নামানো হলো জালাসহ গুড়। এবার বিচকাটি দিয়ে মনের মতন গুড়ের বিচ তুলা হলো। নলানো গুড়ে দানা বেঁধে এলো। নাতিদের শুকনো টনটনে ভাঁড় আনতে বলল। ভাঁড়ে গুড় ভর্তি করলো। জালায় অবশিষ্ট লেগে থাকা গুড়গুলো নাতিরা আঙুল, কেউ কেউ চামুচ দিয়ে চেটে চেটে খেলো। এবার দিল আলী দাদু নাতিদের সঙ্গে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ঝাল পেঁয়াজ দিয়ে ভাত ছেনা করে পানতা ভাত খেতে খেতে হেসে উঠলেন। দাদী বললেন, কী ব্যাপার বুড়ো, আজ অতো হাসছো যে?
দিল আলী দাদু বললেন, আজ সব গুড়গুলো হাটে বেচতে যাবো? সমস্ত টাকাগুলো আজ নাতি নাতনীদের শীতের গরম বস্ত্র কিনবো? এমন কথা দাদুর মুখ থেকে শুনা মাত্রই নাতিরা জোরে জোরে হেসে বলল, কী মজা কী মজা, লক্ষ্মী দাদু গুড় বেচে আজকে আমাদের শীতের পোশাক কিনে দেবেন।
একটু বেলা হতেই দাদু নাতি নাতকুড়ি সঙ্গে নিয়ে বাজারে রওয়ানা হলেন এবং গিন্নিকে বললেন, নতুন গুড় দিয়ে নতুন ধানের চালের আটায় বিভিন্ন রকমের পিঠা বানাও? হাট থেকে ফিরে এসে সবাই মিলে মজা করে খাবো।