প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
বছরখানেক আগের কথা। রাস্তায় চলাফেরার সময় বিভিন্ন স্কুল-কলেজমুখী শিক্ষার্থীদের দিকে নিজের অলক্ষ্যে চোখ পড়তেই দেখতাম ছাত্রীদের মুখে বিশেষ কিছু অক্ষর সংবলিত একই রঙ ও নকশার মাস্ক পরা। শুরুতে সেভাবে দৃষ্টিগোচর না হলেও বারবার চোখে পড়ায় সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হয়। প্রত্যেকের মাস্কের রঙ কালো ও বামপাশে সাদা রঙে ইংরেজি হরফে লেখা ‘ইঞঝ’ আর তার ঠিক উপরেই একটি লোগো আঁকা।
একদিন আমি কৌতূহলবশত তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা খিলখিল করে হাসতে শুরু করে যেন এই বিষয়ে জ্ঞান না রেখে আমি মস্ত বড় অন্যায় করে ফেলেছি। পরক্ষণে আমি এর অর্থ উদ্ধারের জন্য গুগলে অনুসন্ধান করে জানতে পারি, ‘বিটিএস’ হলো ৭ সদস্যের দক্ষিণ কোরিয়ান বয় ব্যান্ড যারা মূলত গানবাজনা করে। আর ছাত্রীরা এই মিউজিক ব্যান্ডেরই ‘ডাই-হার্ড ফ্যান’। বিটিএস ভক্তদের বলা হয় ‘বিটিএস আর্মি’।
সময়ের পরিক্রমায় একটু একটু করে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হয়েছে, আর বিটিএস ভক্তদের সংখ্যা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। এখন রাস্তাঘাট, বাজার কিংবা স্কুল-কলেজ সর্বত্র এসব বিটিএস ভক্তদের ছড়াছড়ি। বিশেষত স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের মুখে পরিহিত মাস্ক দেখলেই বলে দেওয়া যায় এরা বিটিএস সদস্যদের আশেকান। ক্লাসের ফাঁকে, দলবেঁধে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার সময় কিংবা বাসায় পড়ার টেবিলে- সবখানেই এদের আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয় ‘বিটিএস’কে ঘিরে।
এই কোমলমতী মেয়েদের যখন পড়ার টেবিল আর বাড়ির আঙিনা হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখার কথা, তখন তারা মোবাইল ফোনের স্ক্রিন দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। বিটিএস গায়কদের অদ্ভুত চেহারা আর পপ গানের প্রেমে পড়ে এই প্রজন্মের মেয়েরা এখন নানান রঙের স্বপ্নে বিভোর। বিটিএস সদস্যদের একান্ত আপন করে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় কেউ কেউ হাতে ট্যাটু আঁকছে, আবার কেউ কেউ অশোভন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে ভিডিও বানিয়ে সেই ভিডিও টিকটক, লাইকি, ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে নিজেদের ভালোবাসার জানান দিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ ‘টিকটক’ ও ভিডিও শেয়ারিং সাইট ‘লাইকি’ এই ক্ষেত্রে নতুন হাওয়া লাগিয়েছে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের মাঝে টিকটক ও লাইকি ভিডিও বানানোর উন্মাদনা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। রাতারাতি ভাইরাল হওয়া কিংবা সেলিব্রিটি বনে যাওয়ার নেশায় তারা বিকৃত ও অশ্লীল সব অঙ্গভঙ্গি করে গান-সংলাপের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছে, অদ্ভুত সব নাচ, পোশাক ও হেয়ার স্টাইল প্রদর্শন করে ভিডিও বানাচ্ছে।
এসব করতে গিয়ে বিশেষত কিশোরেরা হরহামেশাই নানান অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কিশোর গ্যাং-এ জড়িয়ে পড়ছে। আধিপত্য বিস্তার, ইভটিজিং, মাদকগ্রহণ, চাঁদাবাজি ও চুরি-ছিনতাইসহ নানান অপরাধমমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাচ্ছে এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি। বিকালবেলা খেলাধুলা শেষ করে সন্ধ্যা হলেই বাসায় গিয়ে পড়ার টেবিলে বসার কথা ছিল শিশু-কিশোরদের। অথচ এই সময়ে বাজারের মোড়, চা-বিড়ির দোকান ও পাড়ার অলিগলিতে তাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে, মধ্যরাত অবধি চলতে থাকা তাদের আড্ডার কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠছে, ভেঙে পড়ছে সামাজিক শৃঙ্খলা।
করোনা ভাইরাসের চেয়েও বেশি সংক্রামক এই বিটিএস ভক্ত ও টিকটক ব্যবহারকারী কিশোর-কিশোরীরা। করোনা একজন একজন করে আক্রান্ত করলেও এরা আক্রান্ত করছে একটি গোটা প্রজন্মকে। একজন মনোযোগী শিক্ষার্থী যখন তাদের সংস্পর্শে আসছে, সেও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রিডিং রুম থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে, আসক্ত হচ্ছে মোবাইল ফোনে। তাদের চিন্তাজগতের সংকীর্ণতা ও মানসিক দৈন্যতা আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের পথে অন্তরায় ও প্রধান বাঁধা।
শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়াকেই তাদের এই পদস্খলন, দৈন্যদশা ও বিগড়ে যাওয়ার প্রধান ও একমাত্র কারণ বলা যেতে পারে। ছেলেমেয়েদের একটু আবদারেই বাবা-মা তাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছে। ফলস্বরূপ নিজের সন্তানরা যে পথচ্যুত হচ্ছে এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে বিন্দুমাত্র হাপিত্যেশ নেই। নিজ হাতে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও অপার সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করে একটি জাতিকে পঙ্গু করার দায়ভার আমাদের এই অভিভাবকরা এড়াতে পারবে কি? ঔদাসীন্য মনোভাব ও নীরবতা ভেঙে অভিভাবকদের আদৌ বোধোদয় বা চৈতন্য হবে কি? কিংবা এহেন সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দেশের নীতিনির্ধারকগণ কোনো উপায় বাতলে দিবেন কি? আজ এই প্রশ্নই রেখে গেলাম।