প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
২০০৬ সালের কনকনে শীতের কোনো এক মধ্যরাত। একজন অন্তঃসত্ত্বা মা মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স -এর ডেলিভারি ইউনিটে অসহনীয় প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছেন। আর অনাগত সন্তানের বাবা ছুটে গিয়েছেন হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদে, তিনি রাব্বে কারীমের দরবারে সিজদায় অবনত। কায়মনোবাক্যে অনাগত সন্তান ও স্ত্রীর সুস্থতা কামনায় তিনি দোয়া করে চলেছেন নিরন্তর, আর তাঁর ক্লান্ত চোখজোড়া বেয়ে অশ্রুর ফোয়ারা নামছে বৃষ্টি হয়ে। সন্তানসম্ভবা মায়ের আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক অনেক পূর্বেই অনাগত শিশুর ‘ফিজিক্যাল ডিজ্যাবিলিটি’র বিষয়ে আভাস দিয়েছিলেন। অনাগত সন্তানের ব্যাপারে এমন অপ্রত্যাশিত খবর ও স্ত্রীর প্রসব পরবর্তী জটিলতার ব্যাপারে তিনি খুব মুষড়ে পড়েন, কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু মহান রব তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। সকল উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের প্রাচীর ভেঙে তাঁর স্ত্রীর কোল আলোকিত করে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের আগমন ঘটলো।
এমন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মুহূর্তে জন্ম নেওয়া কন্যা শিশুটি স্বয়ং আমি। বাবা আমার নাম রেখেছিলো ‘মেঘলা’। প্রচণ্ড হাড়ভাঙা শীত ও কুয়াশায় ঢাকা রাতের শেষপ্রান্তে আমি পৃথিবীতে এলেও সেদিন রাতের আকাশ আদৌ মেঘলা ছিল কি না সে বিষয়টা আজও অমিমাংসিত রয়ে গেছে। আমার নাম মেঘলা হলেও বাবা আমায় আদর করে ‘মেঘগা’ বলে ডাকেন। শুধুমাত্র বাবা আমাকে এই নামে ডাকলেই আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হই। বাবার নিত্যদিনের সকল অভ্যাসের মধ্যে আমাকে ‘মেঘগা’ নামে ডাক দেওয়াটা সবচেয়ে অগ্রগণ্য। আমরা তিন ভাই-বোন। কিন্তু বাবা আমার ভাইদের চেয়ে আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন, আমাকেই সবচেয়ে বেশি কাছে টেনে নেন।
আমার জন্মের কয়েকদিন পরের কথা। তখন বর্ষকাল। শ্রাবণ মাসের এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা। বাইরে প্রবল বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বাবা দিগ্বেদিক ছুটাছুটি শুরু করেন, তীব্র ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে রাতের অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে তিনি আমার জন্য ঔষধ আনতে বেরিয়ে পড়লেন। ঘন্টাখানেক পরে তিনি ঔষধ নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। তারপর সালাতের ওযু করে তিনি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যান, আল্লাহ্ তায়ালার মুখাপেক্ষী হন। আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে একদিন বাবাকে প্রশ্ন করি, ‘আমার কিছু হলেই তুমি কেন সালাতে দাঁড়িয়ে যাও?’ তখন বাবা আমার প্রশ্নের জবাবে তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘আমি আমার রবকে ডেকেছি কিন্তু তিনি আমাকে কোনোদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন এমনটা ঘটেনি।’
আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা বাড়ির পার্শ্বস্থ একটি স্কুলে সামান্য বেতনে শিক্ষকতা করেন। আর আট-দশটা পরিবারের মতোই আমাদের সাদামাটা সংসার। বাবার স্বল্প আয়, টানাপোড়েন আর প্রাপ্তি নিয়েই এক সুখী পরিবার আমাদের। এক কোরবানি ঈদের ঘটনা। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে অর্থসঙ্কটের কারণে সেবার আমাদের কোরবানি দেওয়া হবে না, আর ঈদের নতুন জামা পাওয়া তো দূরের কথা। বাবার কপালে দুঃশ্চিন্তা ও হতাশার ছাপ স্পষ্ট। ঈদের দিন সকালে বিষণ্ন মনে আমার ঘুম ভাঙলো, খুব মন খারাপ করে বসে আছি। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করতে বললেন, আমি তাই করলাম। পরক্ষণে চোখ মেলে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম, বাবার হাতে আমার জন্য অনেক সুন্দর ও দামী একটি নতুন জামা। তৎক্ষনাৎ জামা পেয়ে আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলাম।
বাবা খুব স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। আমি আমার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যতটা উদাসীন, বিপরীতে আমার স্বাস্থ্যের প্রতি আমার চেয়ে আমার বাবা বেশি যত্নশীল। আমার কখন, কোন পুষ্টির বেশি প্রয়োজন, বাবা বাজার থেকে সেসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারই নিয়ে আসেন ব্যাগ ভর্তি করে। একদিন ডাইনিং টেবিলে ডিনার করার সময় আমার গলায় মাছের কাঁটা বিঁধলে আমি ‘আ’ শব্দ করে উঠি, বাবা আমার কষ্টে এমনভাবে আঁতকে উঠলেন যেন আমার গলায় নয়, বরং তাঁর গলায়ই কাঁটা আটকেছে। আমার জীবনের পরতে পরতে আমার জন্য বাবার এমন উৎকণ্ঠা, এমন ভালোবাসা আমাকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠার পথে পাথেয় হিসেবে কাজ করছে।
ধীরে ধীরে আমি শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করতে লাগলাম। একজন আপাদমস্তক কিশোরী বলতে যা বুঝায় আমিও এই বৃত্তের বাইরে নই। আমার জন্য বাবার ভালোবাসার অবারিত দ্বার দিনদিন হু হু করে প্রশস্ত হতে লাগলো। আমার হাতের চুড়ি লাগবে কি না, আমার মাথার তেল লাগবে কি না কিংবা আমার সাজসজ্জার কোনো উপকরণ বাদ পড়লো কি না -এমন হাজারো ভাবনায় যেন আচ্ছন্ন থাকে বাবার সারাটা ভুবন। বাবা কোনো রাজাও নন কিংবা কোনো রাজার উত্তরসূরিও নন, তবুও আমি তাঁর কাছে রাজকন্যাই বটে। আমার এহেন কোনো আবদার-আহ্লাদ নেই, যেটা তিনি পূরণ করেন নি। বাবার কাছে কোনো জিনিস চেয়ে পাইনি এমনটা আমার জীবনে একবারও ঘটেনি। বাবা আমাকে ঠিক তাঁর মতো সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ করে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত। যেমনটা ফ্রাংক এ ক্লার্ক উচ্চারণ করেছেন, ‘একজন বাবা তাঁর সন্তানকে ততটাই ভালো বানাতে চান, যতটা তিনি হতে চেয়েছিলেন।’
বছরখানেক আগের ঘটনা। আমি একজন পরিণত কিশোরী। হৈ হুল্লোড়, খেলাধুলা ও পড়াশুনায় বিদ্যালয় ও বাড়ির আঙিনা মাতিয়ে রাখি। একদিন আমি পথ চলতে গিয়ে একটি ভুল করে ফেলি। বাবা আমার সাথে কথা বলেন না, আর আমাকে ‘মেঘলা’ বলে ডাকেন না। আমি প্রচণ্ড ভেঙে পড়ি, একাকিত্বকে বরণ করে নিই। এভাবে বছর পেরিয়ে যায়। আমি আমার ভুল বুঝতে পারি, অনুতপ্ত হই। বাবা আমাকে আবার আপন করে নেন, আমাকে বুকে টেনে নেন। কিন্তু এখন আমি ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরছি, বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ‘ভালোবাসি’ বলতে পারি না, বলতে পারি না ‘সরি, বাবা’। তবুও কেমন করে বাবাকে ‘স্যরি’ বলা যায়?