সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

স্মৃতির পরতে শৈশবের শরৎ
অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশের আকাশের সাথে অন্য কোনো দেশের আকাশের মিল নেই। আমাদের আকাশ ওদের চেয়ে বেশি নীল, বেশি সাদা। শৈশবে শরৎ এলেই মনে হতো সে কথা। মাঝে মাঝে মনে হতো যদি এই নীল আকাশটা হাতের কাছে পেতাম তবে স্কুলের সাদা শার্টটা ডুবিয়ে দিতাম তার টলটলে নীল রঙে। উজ্জ্বল সাদা রঙের খাঁজকাটা মেঘ যেনো কুলপি আইসক্রিমের বরফের চূর্ণ-গাদা। ছোটবেলার শরৎকাল ছিলো এই বৃষ্টি, এই রোদ। তাই ছড়া কেটে বলতাম,

রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে

খেঁকশেয়ালের বিয়ে হচ্ছে।

আসলে কী কখনো খেঁকশিয়ালরা বিয়ে করে কি না তা জানতে পারিনি কখনো। আবার রোদণ্ডবৃষ্টির সাথে খেঁকশিয়ালের কী সম্পর্ক তাণ্ডও জানি না। কিন্তু শরতের এই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিকে কেনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বলা হলো তা গবেষণা করতে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়। ইলিশের ডিম রান্নার পর যে রকম গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় তার সাথে শরতের এই বৃষ্টির মিল পাওয়া যায়। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শরতের এই ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে বলেছেন,

‘ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম

ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি দিনের বেলায় হিম’।

জাতীয় কবি কাজী নজরুলও কিন্তু তাঁর ‘বিদ্রোহীর গান’ কবিতায় শরতের এই বৃষ্টিকে ইলশে গুঁড়ির সাথে তুলনা করে বলেছেন,

‘সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরা আবার করবি কাজ!

ফোঁপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ!

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখেই ঘর ছুটিস সব রামছাগল!

যুক্তি তোদের খুব বুঝেছি, দুধকে দুধ আর জলকে জল!

এবার তোরা সত্য বল॥’

পরে বড় হয়ে জানলাম, এই গুঁড়ো গুঁড়ো শরতের বৃষ্টিতে ইলিশ মাছ বেশি ধরা পড়ে।

শরতের এই সৌন্দর্য নিয়ে কিশোর বেলায় জয়নুল আবেদীন অভিভূত হয়ে যেতেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বসে তিনি সারাদিন এই সাদা মেঘের ভেলা, নীলাকাশ আর নদীর তীরের কাশফুলের ছবি আঁকতেন। শরৎ তাঁকে চিত্রকর বানিয়ে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের শরতের শৈশব ছিল আরো মধুর। তিনি স্কুল ফাঁকি দিতে শরতের কড়া রোদে ছাদে বেড়াতেন আর পায়ের মোজা জলে ভিজিয়ে ঘুরতেন। কিন্তু তবু তার জ্বর হতো না। বড় জোর গা গরম হতো। শরৎকে নিয়ে বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ কতো কিছু লিখেছেন! তিনি ‘শরৎ’ কবিতাতে বলেছেন,

‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ

লেগেছে হাওয়ার ’পরে

সকাল বেলায় ঘাসের আগায়

শিশিরের রেখা ধরে।’

আবার দুরন্ত কিশোরের প্রাণের গহীনে মিশে তিনি গেয়ে উঠেছেন অকপটে,

‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই-- লুকোচুরি খেলা॥’

নজরুল ‘শেফালিকা তলে কে বালিকা চলে’ বলে কবিতায় শরৎকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা আজও আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে আছে।

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘জাগবার দিন আজ’ কবিতায় শরতের সৌন্দর্য নিয়ে বলেছেন,

‘শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী

কিন্তু বাঁশরী বৃথা,জমবে না আজ কোন আসরই।’

কিশোরের চোখে শরৎ এক আশ্চর্য জগত। এ যেন ‘পথের পাঁচালী’র ভাই-বোন অপু-দুর্গার গ্রামের বন-বাদাড় আবিস্কারের জগত। ‘পথের পাঁচালী’র কিশোর সংস্করণ ‘আমণ্ডআঁটির ভেঁপু’ উপন্যাসে শরতে বাংলার প্রকৃতি যেভাবে এঁকে তুলপছেন বর্ণনায়, তাতে মনে হয় শরতই ঋতুর রাজা।

জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল শরতের প্রতি এমনই টান অনুভব করেন যে, শরতের বিদায় হলে তিনি আত্মীয়-বিয়োগের মতো কষ্ট অনুভব করেন। কবি কিশোরী বেলায় ফিরে গিয়ে তাঁর সোনালী স্মৃতি রোমন্থন করে 'পল্লী স্মৃতি' কবিতায় বলেন,

“শিশির সিক্ত শেফালী ফুলের ঘন সৌরভে মাতি’

শারদ প্রভাতে সখীগণ সাথে আনিয়াছি মালা গাঁথি।” সেই স্মৃতির মধুর হাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তিনি

‘শরত আবার যেদিন আসিবে’ কবিতায় আক্ষেপ করে বলেন,

“সেই সুন্দর শরত আবার যেদিন আসিবে ফিরে...”।

অনেক অনেক আগেকার দিনে মানুষ শরৎ দিয়েই বছরকে মাপতো। কেননা তখন অগ্রহায়ণ মাস দিয়েই বছর শুরু হতো। তাই হেমন্ত ছিল প্রথম ঋতু আর শরৎ ছিল শেষ ঋতু। কেউ কাউকে আশীর্বাদ করতে হলে বলতো, ‘তুমি আরও একশ শরৎ বেঁচে থাকো।

শরতের সৌন্দর্য বিমোহিত হয়ে মধ্যযুগের কবি বলেছেন,

‘শারদচন্দ পবন মন্দ, বিপিন ভরিল কুসুমগন্ধ’।

এই শরতেই চাঁদের শোভায় বনে-অরণ্যে ফুলের গন্ধে মৌতাত ছড়ায় হাস্না হেনা-কামিনী-শেফালি।

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন শরতে তাঁর শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে বলে ওঠেন,

‘শরৎ সে কবে চ’লে গেছে তার সোনালী মেঘের ছটা,

আজো উড়িতেছে মোর এই খেতে ধরিয়া ধানের জটা।

মাঝে মাঝে এর পাকিয়াছে ধান, কোনখানে পাকে নাই,

সবুজ শাড়ীর অঞ্চলে যেন ছোপ লাগিয়াছে তাই।’

কবির শরতে গ্রামীণ শৈশবের যে মমতা ফুটে উঠেছে, আজকের কিশোরদের কাছে এই মমতা যেন অচেনা। কবি নির্মলেন্দু গুণ আজকের কিশোরদের আবারো শরতের রূপ মনে করিয়ে দেন কবিতায়,

‘সবে তো এই বর্ষা গেল শরৎ এলো মাত্র,

এরই মধ্যে শুভ্র কাশে ভরলো তোমার গাত্র।

ক্ষেতের আলে নদীর কূলে পুকুরের ওই পাড়টায়,

হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে বাঁশবনের ওই ধারটায়।’

শরতের কাশফুল, শিউলিফুল আর শুভ্র মেঘমালার রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু স্বয়ং গেয়ে উঠেছেন-

‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ

আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা

নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে

সাজিয়ে এনেছি ডালা।’

শরতের মধ্যে শিশু-কিশোরদের জীবন্ত দেখতে পান বলেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘শরতের রঙটি প্রাণের রঙ। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড়ো নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা। এইজন্য শরতে নাড়া দেয় আমাদের প্রাণকে,...তাহা এমনি হালকাভাবে আসে এবং যায় যে কোথাও তার পায়ের দাগটুকু পড়ে না, জলের ঢেউয়ের উপরটাতে আলোছায়া ভাইবোনের মতো যেমন কেবলই দুরন্তপনা করে অথচ কোনো চিহ্ন রাখে না।’

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়