প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
-আপু পাঁচটা টিয়া দিবা?
-কী করবা পাঁচ টাকা দিয়ে।
-ভাত খাবো।
-৫ টাকা দিয়ে ভাত হয় নাকি?
-হ্যাঁ হয় আপা। কিন্তু খুব কম দেয়।
-তো ৫ টাকা দিয়ে ভাতের সাথে কী পাও আর কী খাও?
-ভাতের সাথে কিছু দেয় না আপা। শুধু অল্প কয়টা ভাতই দেয় আর যেদিন একটু বেশি টাকা হয় সেদিন বাড়িত নিয়া যাই।
-তোমার এই ৫ টাকা ভাতে পেট ভরে?
-পেট ভরে খেতে গেলে অনেক টাকা লাগবো এত টাকা কই পাবো কন?
-তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
-মা, আমি আর ছোট দুই ভাই-বোন আছে।
-তোমার বাবা কোথায়?
-বাপ নাই আপামণি।
দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলাম। আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস হলো না। মনের ভেতর একটা অন্যরকম কষ্ট অনুভব করলাম। মেয়েটির হাতে একশ’ টাকা দিয়ে বললাম যাও কিছু খেয়ে নিও। আজ বেশি টাকাও ছিলো না। কী আর করার আজ মেয়েটির সাথে কথা বলে বেশ খারাপ লাগছে। পৃথিবীতে কত রকমেরই মানুষের হয় আগে জানতাম না। তা জানা ছিলো না। যত বড় হচ্ছি ততই নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছি। পৃথিবীতে কত বিচিত্রময় মানুষই না বাস করে। আমরা যারা সব কিছু পেয়ে এসেছি তারা সেসবের কিছুই জানি না। সেসবের কিছুই ধারণা নেই আমাদের মধ্যে। অথচ দেখো প্রতিনিয়তই কত মানুষ কতভাবে কত কষ্টে জীবনযাপন করে আসছে। তাদের জীবনে কত যুদ্ধ করে চলছে। তাদের আপনজন শব্দটাই তাদের মধ্যে নেই। আত্মীয়-স্বজন কী তারা তার মানে জানে না। তারা শুধু জানে তাদের মা-বাবা-বোন-ভাই যে তার পাশে থাকবে সেই তার আপনজন সেই তার আত্মীয় আর কেউই তার আত্মীয় নাই। কারোর বাবা আছে, তো কারো মা আছে, কারোর ভাই আছে, তো কারো বোন আছে, আবার কারো কারো মা, বাবা, ভাই, বোন, কিছুই নেই। এভাবেই অনাথ হিসেবে তাদের প্রতিটি জীবনে যুদ্ধ করে কাটছে তাদের জীবন। এই ছোট ছোট মেয়ে-ছেলেদেরকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম এত কিছু। এই ছোট ছোট মেয়েদেরকে না দেখলে আমি হয়তো বুঝতেই পারতাম না। এতকিছু ভাবতে ভাবতেই কালকের সে চাচা ডাক দিলেন আপামনি কুলফি খাবেন কুলফি বেশ ভালো খেতে।
-না চাচা আজ খাব না।
-একটা নেন না আপামণি আজ সকাল থেকে একটাও বিক্রি হয় নাই।
মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল আমি তার দিকে চেয়ে আছি আর জিজ্ঞাসা করলাম,
-কখন বের হয়েছেন চাচা?
-সেই সকাল ৯টায় আপা। কিন্তু আজ কেউ নেয় নাই। আর বিক্রি না হলে পোলাপানের জন্য খাবারও নিতে পারুম না আপা।
-আচ্ছা চাচা আমাকে একটা দিন।
কুলপি খেতে খেতে ভাবছি আহারে সামাজিক ভাবেও মানুষ কত না অসহায়। কতটাই না তাদের যুদ্ধ করে জীবন চালাতে হয়। আমি কুলফি খাচ্ছি আর নদীর দিকে তাকিয়ে আছি। আর কিছুক্ষণ পর পর আশপাশে দেখছি ওই মেয়েটিকে খুঁজে পাই কি না । কিন্তু এত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েও আমার মন কালকের সেই মেয়েটি কে খুঁজছে। মনটা মেয়েটির সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। তার এমন মায়াবী চাহনি আমাকে শুধু ভাবাচ্ছে! শুধুই ভাবাচ্ছে! আমার কুলফিটা প্রায় শেষের দিকে ওমনি একটি মেয়ের কণ্ঠ আমার কানে আসে,
-আপা একটু দাওনা খেতে খুব গরম লাগছে? তোমার থেকে একটু দাও না আপা ।
আমার মুখে কুলফির কাগজটা অমনি মেয়েটি দিকে তাকালাম। ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত খেয়ে গেলাম। কী দেখছি? যেই মেয়েটিকে এত খুজলাম, যার জন্য আমি এখানে এসেছি সে আমার সামনে। আমি তো পুরাই অভাব! মেয়েটি আবারও বলে উঠলো।
-আপা দাও না খেতে একটু।
-এটা তো আমার এটো। তুমি কী করে খাবে?
-খেতে পারব আপা। এরকম তো প্রতিদিনই খাই।
-মানে! তুমি প্রতিদিন মানুষের ফেলে দেয়া খাবার খাও?
-হাঁ আপা। কী করবো কন? গরিব মানুষ খেতে হইবই।
-তোমার নাম কী?
-আমার নাম মুন।
-তোমার বাসা কোথায়?
-ঐ যে রেল স্টেশনটা আছে না ওইখানেই আমরা থাকি।
-ওখানে তো কোন বাড়ি নাই তো কী করে থাকো?
-আমগো কোন বাড়ি নাই আপা। তবে আগে যখন আমি অনেক ছোট ছিলাম তখন নাকি বাসা ভাড়া করে থাকতাম মা বলছিল।
-তো এখন কেন থাকো না?
-কী করে থাকমু আপা? এত টাকা কই পামু? তিন বেলা খেতেই তো পাই না।
-কেন? আর তোমার বাবা কই?
-বাপ নাই আপা। অনেক আগেই যখন আমি খুব ছোট ছিলাম আমার ছোট ভাই হইছে তখন বাপ চলে গেছে আমগোরে ছাইরা। আর আইয়ে নেই।
-কোন সমস্যা হয়েছিল কী?
-নাগো আপা। ছোট ভাই হইছে আর এক রাইত অন্য এক মহিলার সাথে নাকি চলে গেছে আর আসে নাই।
-তখন তোমার বাবা কী করত?
-রিক্সা চালাইতো আপা।
-আরে তুমি উঠে বসো এখানে, উঠে বসে কথা বলো। আমি তোমাকে কুলফি খাওয়াবো ঠিক আছে।
-জানেন আপা অনেক মানুষের কাছে টাকা চাইলে তাড়িয়ে দেয়। তাদের জামা ধরে টেনে তাদের থেকে কিছু চাইলে তারা বলে ফকিন্নিরা কোথা থেকে আসে এসব যা এখান থেকে । আর মা-বাপ নিয়া গালাগালি করতে থাকে। আর তাদের জামা ধরে যে টান দিই না ওইখানে দিয়ে নাকি ময়লা করে ফেলি আমরা।
-ওওও। আচ্ছা তোমার বাবা রিক্সা চালাইলে তো তোমরা মোটামুটি তখন ভালোই ছিলে তাই না।
-মাত্তেন শুনছি আপা। তিনি রিকশা চালাইয়া যত টাকা পাইতো তা দিয়ে তিনি জুয়া খেলে শেষ করে ফেলত আর মা তখন মাইনষের বাইত কাজ করে আমাদের খাওয়াইত।
-এখন তোমার তোমার বাসায় কে কে আছে?
-মা আমি আর ছোট্ট বোন হাসি।
-বাহ খুব মিষ্টি নাম তো তোমাদের। তোমার মা এখন কিছু করে না?
-না আপা, করতে পারে না করতে চায়। মার অনেক অসুখ মায় হাঁটতেই পারে না।
-ও ও তার মানে তুমি পড়াশোনা করো না তাই না?
-করতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু করতে তো অনেক টিয়া লাগবো কই পামু এত টিয়া আপা কন আন্নে?
-সারাদিন তুমি কী কী কর?
-ভিক্ষা করি আপা।
-সংসার কে চালায়?
-আমি আপা। সারাদিন যতটা টিয়া পাই তা দিয়েই প্রতিদিন আমগো তিনজনের চলে যায়। মা ও মাঝেমাঝে প্লেট নিয়ে রেল স্টেশন বসে থাকে কিন্তু মাইনসে এখন ভিক্ষাও দেয় না দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়।
-আচ্ছা তোমাদের বাসাটা ঠিক কোন জায়গাতে?
-ওই যে রেল স্টেশান আছে না প্লাটফর্ম বলে যে ওইখানে মাটিতে থাকি আবার কোন কোন সময় বাস স্টেশন কোন কোন সময় সিম রেজিস্ট্রেশন থাকে আপা।
মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল ওর মনের কথাগুলো শুনে। কুলফি চাচা আবার আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে আর বলছে কুলফি লাগবে কুলফি, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুলফি বেশ মজার কুলফি।
-এই চাচা এখানে আসেন।
-আরেকটা কুলফি কী লাগবে নাকি?
-জ্বি চাচা, তবে একটা না দুজনকে আরো দুইটা দিন।
-এই নেন আপা।
-মুন নাও খাও।
-আপা আন্নে কত্ত ভালা মানুষ।
-আমিতো তোমায় কোন কিছুই দিলাম না। উল্টে কত সময় তোমায় নষ্ট করে দিলাম (একটু হেসে)।
-নাগো আপা। জানেন আপা, আপনি কত সুন্দর করে আমার লগে কথা বললেন। কত সুন্দর কইরা আন্নে আমারে আন্নের লগে বসাইলেন। কত সুন্দর করে কথা কইতাছেন। আর মাইনষে আমার লগে কথাই কয় না। বলে আমরা নাকি ছোটলোক, আমরা নাকি অশিক্ষিত। আচ্ছা আপা আপনেই কন, আমগো যদি টিয়া থাকতো তাইলে তো আমরাও আপনাদের মতন লেখাপড়া করতাম তাই না।
-হ্যাঁ তো অবশ্যই করতে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
-জি¦ আপা কন কি কথা?
-কালকে তুমি আমার দেখে এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?
-সত্যি কথা কইতাম আপা?
-হ্যাঁ বলো।
-আপনারা কতজন কত মজাই না করতে ছিলেন। কত আনন্দ করতেছিলেন। কত সুন্দর করে আপনারা একে অন্য জনকে ডাক দিচ্ছেন। আমার তো কেউ নাই আর আমার আপনাদের মতন এত সুন্দর করে কথাও কইতে জানি না। আন্নেগো মতন আমার কেউ নাই মা বোন ছাড়া তাই আন্নেগোরে দেখছিলাম।
- ও আচ্ছা।
-জানেন আপা মাইনষেগো কত আপন মানুষ আছে আমার কেউ নাই।
-জানো আপা মনি অনেক বাচ্চারা ঘুরতে আসে । আর তারা বড় বড় লোকেদের কত কিছু বলে ডাকে। আর আমার তো বাপই নাই। জানো আপা মনি প্রতিদিন যে কত বাচ্চারা আসে ঘুরতে মা-বাপরে নিয়া। আমারও না খুব ইচ্ছা করে তাগো মতন আমিও আমার মা-বাপের হাত ধইরা ঘুরতাম । আমারও না ইচ্ছা করে খেলতে, ঘুরতে, সবার মতন। সবার বাপ তাদের মেয়েদের খাইয়ে দেয় আমারে কেউ দেয় না (কেঁদে কেঁদে)।
-শোনো আমি তোমায় খাইয়ে দেবো আজ । আর বাসার জন্য কিছু কিনেও দেবো ঠিক আছে।
-না আপা আন্নের অনেক টিয়া যাইবোগা। আর এত টিয়া আন্নে কই পাইবেন। আর আমরা তো গরিব মানুষ।
-আরে পাকা বুড়ি, এত কিছু তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
মুনকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম তাকে কিছুটা খাবার খাইয়ে দিলাম নিজের হাতেই। ও রেস্টুরেন্টে আসতে চাইনি ও বলে, আপা আমারে এক কেজি চাল কিনে দেন। বাসায় গিয়া রান্না করে সবাই মিইলা খামু।
-সে না হয় দিমুনি এখন তুমি খাও। আর কিছু খাবা মুন?
-না আপা আর খামু না, ধন্যবাদ আপা আন্নেরে।
-চলো এবার আমরা কিছু কিনে নেই।
-আচ্ছা আপা।
-দেখতো কোন জামাটা তোমার পছন্দ হয়।
-আপা আমার লাগবো না । আমার ছোট বোনটার জামা নাই ওকে একটা জামা কিনে দেন।
-আচ্ছা দিবো। আমি তার কথা শুনে আবারো অবাক হলাম এই ছোট্ট মেয়েটা নিজের কথা না ভেবে নিজের পরিবারে কথা কত সুন্দর করে চিন্তা করতে পারে।
-আপা এই লাল জামাটা আমার বোনের খুব সুন্দর লাগবো।
-এখানে তো অনেক দামি জামাও ছিল তো তুমি এই কমদামি জামাটা কেন নিলা?
-আন্নে আমারে খাওয়াইলেন আবার চালও কিনে দিবেন কইলেন এখন বেশি দামি টা নিলে আন্নের সব টাকা শেষ হয়ে যাইবো তো।
-এই যে পাকা বুড়ি এত চিন্তা নেই তোমার।
ওর বোন হাসি, মুন ও তার মাকে জামা কিনে দিলাম । আর কিছু বাজার করে দিলাম। হাতে দু হাজার টাকা দিয়ে ওকে ওর জায়গাতে পৌঁছে দিয়ে নিজের গন্তব্যে রওনা হলাম।
অদ্ভুত ভাবে বেড়ে ওঠে ওরা। অল্প বয়সেই জীবনকে বুঝে নিতে শিখে যায়। পথের ধুলায় অদ্ভুতভাবে বেড়ে ওঠার মাঝেও তাদের মধ্যে বিবেকবোধ তৈরি হয়েছে। পাঁচ টাকার ভাত খেয়ে, ৫০ টাকা রোজগার করে বাড়িতে মা-বোনকে নিয়ে দেয়। পুরো সংসার কীভাবে চলবে তার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। মায়ের ঔষধ ছোট বোনের ইচ্ছে এ সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটি জেনে গেছে, কিভাবে কী করতে হবে? আর এই ছোট্ট মেয়েটি সারাদিন বাহিরে ৫ টাকা খেয়ে বাসায় ৫০ টাকা নিয়ে গিয়ে মা-বোনকে নিয়ে খাওয়া বেশি তৃপ্তিদায়ক। সাত বছরের অশিক্ষিত শিশুটির মধ্যে এই বোধটি তৈরি হয়েছে। আমি তাকে তার জামা কিনার কথা বললে, সে বলে তার ছোট বোনের জন্য কিনে দিতে। সে কম দামিটা পছন্দ করলো যেন আমার সব টাকা শেষ না হয়ে যায়। শিক্ষায় শুধু বিবেকবোধ শিখায় না। যে বয়সে বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা সে বয়সে তারা রোজ সংসার চালানোর চিন্তাতেই থাকে। স্কুলে কি টিফিন নিবে? কার পাশে বসবে, কী খেলবে, সেখানে এই ছোট্ট মেয়েটি রোজ সকালে উঠে ভাবে! কোন্ রাস্তায় বসলে দুটো টাকা বেশি ভিক্ষে জুটবে। ঘরে দুটো বেশি খাবার নেওয়া যাবে। ওরা সবাই মিলে একদিন যে টাকা খরচ করে আমাদের সেই টাকা হয়তো একদিনের মোবাইল খরচ। অথচ চেয়ে দেখো একই স্রষ্টার সৃষ্টি আমরা সবাই। কোন না কোন কারো না কারো মা-বাবা সন্তান। স্রষ্টার বিচারে আজ ওরা পথের ভিখারী। পরিবারের জন্য এই শিশুটিকে ভিক্ষা করতে অনেক দূর যেতে হয়। অনেক কষ্ট করে দুটো টাকা রোজগার করতে হয়। অনেক মানুষের বড় বড় মানুষের হাতে পায়ে ধরে দুটো টাকা নিতে হয়। তারা বুঝে গেছে কীভাবে পথ চলতে হবে। তারা বুঝে গেছে জীবনের ধারা কী। তারা জেনে গেছে জীবন কী।