সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২২, ০০:০০

আমাদের লোহা
অনলাইন ডেস্ক

ছেলেটার নাম লোহা। আমাদের স্কুলে পড়ে। লোহা মানে লোকমান হাসান। সংক্ষেপে লোহা। তাকে স্কুলের মাঠে দেখলেই আমরা লোহা লোহা বলে চিৎকার করি। শুধু শুধু আমরা তাকে লোহা ডাকি না। তার শরীরের প্রতিটা অঙ্গ খুব শক্ত। যেন লোহার মতো। এ কারণেই তার নামের সংক্ষেপ লোহা। লোহা নিজেও তার নতুন নামকরণ খুব পছন্দ করেছে। তাকে লোহা নামে ডাকলেও সে রাগে না। বরং খুশি হয়। লোহা যতটুকু শারীরিকভাবে শক্ত, স্বভাবে ঠিক ততটাই নিরীহ। কেউ কখনো তাকে কারও সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেনি। তবু তার কণ্ঠ ছিলো অনেকটাই ধাতব আওয়াজসম্পন্ন। নিরীহ স্বভাবের হলেও তার সাথে কেউ একবার হাত মেলালে আর দ্বিতীয়বার হাত মেলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবেনা। যে একবার মিলিয়েছে হাত সে জানে লোহার হাত কতটুকু লোহার মতো। স্কুলের স্পোর্টসের সময় কেউ তার পাশে দাঁড়াতে চায় না। তার পাশে দাঁড়িয়েছে এবং রেইসে অংশ নিয়েছে এমন কেউ আর আস্ত হাত-পা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি। লোহার বাড়ি খেয়ে তার হাড় ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। এ কারণে লোহার সাথে কেউ কখনো মারামারি তো দূরে থাক ইয়ার্কি করতেও সাহস করে না। লোহাকে নিয়ে আমাদেও গবেষণার অন্ত নেই। লোহার খাদ্য তালিকায় কী কী থাকে তা জানতে আমাদের কৌতূহল ছিল সব সময় তুঙ্গে। লোহারা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। লোহার বাবা সরকারি অফিসের মাঝারি পদের কর্মী। লোহা তাই প্রতিদিন ডিম-দুধ খেতে পায় না। মাঝে মাঝে খায়। যেদিন ভাতের সাথে মাছ থাকে না সেদিনই শুধু ভাত দিয়ে ডিম খায়। পরীক্ষার একদিন আগে থেকেই শুধু সে দুধ খায়। তাণ্ডও পরীক্ষার সময়কাল পর্যন্ত। অর্থাৎ আট-দশদিন। এর বেশি তো নয়ই। তবে লোহা খুব খেলাধূলা করে। ফুটবল তার খুব প্রিয় খেলা। আমাদেও ক্লাসে সে-ই সবচেয়ে ভালো ফুটবল খেলে। তার পায়ে শট খুব জোরালো হয়।

লোহা যখন লোহার মায়ের পেটে আসে তখন লোহার মায়ের উদ্ভট সব ইচ্ছে হতে থাকে। তিনি কেবল লোহার গন্ধ শুঁকতে পছন্দ করতেন। সবসময় লোহার একটা পেরেক গ্লাসে ডুবিয়ে পানি খেতেন। আবার ভাত খেতে গেলে লোহার থালাবাটি ছাড়া মোটেই খেতেন না। এভাবেই লোহার মায়ের প্রসূতিকাল কেটেছে। লোহার জন্ম নয়মাসে হয়নি। মাতৃগর্ভে লোহা পুরোপুরি দশমাস ছিল। তারপরেই সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যতদিন লোহা তার মায়ের পেটেছিলো ততদিন তার মায়ের শরীর থেকে লোহার গন্ধটা আসতো। কিন্তু লোহার জন্মের পর পরই সে গন্ধটা আর পাওয়া যায়নি। এসব অবশ্য লোহাদের প্রতিবেশির কথা।

পড়াশুনায় লোহা খুব খারাপ। বাংলা তার মাথায় ঢোকে না। বাংলা ব্যাকরণের কথা শুনলেই তার গায়ে জ্বও আসে। ইংরেজি সে এখনও বানান করেই রিডিং পড়ে। অথচ ক্লাসের অন্যরা গড়্ গড় ্করে ইংরেজি পড়ে। গণিতের বিষয়ে লোহার মাথা ঠিক ঠিকই লোহার মতো। এতো নিরেট যে কোন সূত্র বা নামতা তার মাথায় ঢুকে না। তবে এতকিছুর পরও লোহা কোন ক্লাসে ফেল করেনি। টেনে টুনে সে সব সময় পাশ করে গেছে। লোহার প্রতি স্যার আর ম্যামদেও একটু বিশেষ পক্ষপাত আছে। কারণ লোহা কোনদিন স্কুল কামাই কওে না। প্রতিদিনই সে স্কুলে আসে। আমরা কখনো লোহার জ্বর কিংবা সর্দিকাশি হতে শুনিনি। তবে লোহার গায়ের তাপ সবসময় অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। কিন্তু সেটা থার্মোমিটারে আসে না। লোহার আরো কয়েকটা গুণ ছিলো। লোহা হাতে ঘুষি দিলেই নারকেল ভেঙে যেত। একবার পিটি স্যার লোহাকে দেয়ালে মাথা ঘষতে বলেছিল। কারণ লোহা সেদিন পিটি ভুল করেছিলো। লোহা স্যারের কথামতো দেয়ালে মাথা ঘষতে গিয়ে ভুলে দেয়ালে মাথা দিয়ে ঢুয়া দিতে শুর ুকরে। ব্যস্! তাতেই দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে। অথচ দেয়ালটা খুব মজবুত ছিলো। সেই থেকে ভয়ে ভয়ে কেউ আর লোহাকে দেয়ালে মাথা ঘষতে বলে না। লোহা প্রতিদিন চারমাইল হেঁটে স্কুলে আসে। তাদের বাসার গলি থেকে কোন স্কুলবাস কোন ছাত্রকে আনে না। তাই লোহা কোন স্কুলবাস পায় না। পাবলিক যানবাহনে দৈনিক কুড়িটাকা করে তার আসতে-যেতে লাগে। লোহা প্রতিদিন এইটুকু পথ হেঁটে স্কুলে আসে। এতে তার যে টাকা সাশ্রয় হয় তা দিয়ে তার দাদীর মাসের ঔষধ খরচটা হয়ে যায়। লোহার আর কোন ভাইবোন নেই। লোহা তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। লোহার বাবা মাঝে মধ্যে লোহাকে নিয়ে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। তখন বাপবেটা মিলে দুটাকার বাদাম খায়। এটাই তার বিনোদন। লোহার কোন প্রাইভেট টিচার নেই। তার বাবাই তাকে পাঠ দেয়। ফলে লোহা কম পড়লেও যা পড়ে তা দিয়েই পাশ নিশ্চিত করে।

লোহার গা দিয়ে লোহা লোহা গন্ধ বের হয়। কখনো কখনো মনে হয় ম্যাচের কাঠি লোহার গায়ে ঘষি। হয়তোআগুন জ্বলে উঠতেও পারে। কিন্তু ভয়েভয়ে সে কাজটাকরতেপারিনা। যদি স্কুলেসত্যি সত্যি আগুন ধরে যায়! ছোটবেলায় লোহাকে সাঁতার শেখানোর জন্যে অনেকবার চেষ্টা করেছিলো তার বাবা। কিন্তু লোহার শরীর অধিকভারী ছিলো বিধায় তার পক্ষে সাঁতার কাটা সম্ভব হয়নি। যতবারই চেষ্টা করেছে ততবারই লোহার দেহ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। লোহা তাই বড় হয়েও সাঁতার শেখেনি।

ঘুম হলো লোহার বড় শত্রু। তাই সে পড়তে বসে ঘুম না পাওয়ার জন্য নিজের মাথায় নিজেই নিজের হাতে তবলা বাজায়। ফলে অসময়ের ঘুম তার লেজতুলে পালিয়ে কূল ছাড়া হয়। স্কুলের সতীর্থদের সাথে খেলার সময় লোহা হেড দিতো খুব জোরে। একদিন এরকম আগুয়ান হয়ে হেড দিতে গেলো লোহা। কিন্তু বিধিবাম। লোহা বলের টাইমিং মিস করে ফেললো। ফলে লোহার মাথার সাথে বাড়ি খেলো প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারের মাথা। লোহার মাথার সাথে বাড়ি খেয়ে সিনিয়র ক্লাসের ঐ ভাইয়ের মাথা ফেটে গেলো। ফাটা মাথা দিয়ে গল গল করেতাজা রক্তের স্রোত বের হতে লাগলো। স্কুলের দারোয়ানরা আহত ছাত্রকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলো। পাঁচটা সেলাই দিয়ে ডাক্তারেরা ফাটা মাথা জোড়া দিলো।

লোহার মাথার সাথে বাড়ি খেয়ে মাথাফাটা ছাত্রটি প্রায় পনরদিন পরে সুস্থ হলো। সুস্থ হয়ে স্কুলে আসার দিন তার গার্ডিয়ান এসে হেডমাস্টারকে লোহার বিষয়ে অভিযোগ দিল। কিন্তু লোহার কোন দোষ ছিল না বিধায় তাকে কোন শাস্তি দেয়া গেল না। কিন্তু লোহাকে নিয়ে কৌতূহলের কারো অন্ত নেই। লোহাকে নিয়ে প্রতিদিন শিক্ষকদের রুমে গবেষণা হয়। সবারই লোহা-গবেষণা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। যে যার মতো করে লোহাকে কিংবদন্তী করে তুলছে। বাড়িতে বা আত্মীয়দের কাছে নিয়মিত লোহা বন্দনা চলছে। স্কুলেও লোহার দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এসব দেখে স্কুলের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো লোহাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে পরীক্ষাকরে দেখবে আসলে ঘটনা কী। লোহার মাথা এতো শক্ত কেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক লোহাকে সরকারি হাসপাতালে নেয়া হলো। সাথে লোহার বাবাও ছিলো। লোহার বাবা-মাও অবশ্য চাইছিল লোহার দেহের এতো কাঠিন্যেও কারণ বের করতে। ডাক্তারেরা লোহাকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করলো। তারা লোহার রক্ত পরীক্ষার জন্যে নিলো। লোহার মাথাকে এক্সরে করা হলো। লোহার রক্তের নমুনা বড় বড় ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হলো। আমাদের লোহা ধীরে ধীরে শহরে পরিচিত হয়ে গেলো।

আমাদের বন্ধু লোহার বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট আসবে সাতদিন পর। এরই মধ্যে আমার মাথায়একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। আমি বাসা থেকে একটা বড় চুম্বক নিয়ে একদিন ক্লাসে গেলাম। তারপর সেই চুম্বকটা সবার অলক্ষ্যে লোহার মাথার সাথে লাগিয়ে দিলাম। ওমা! আমি যা ভেবেছিলাম তাই। আমার চুম্বকটা লোহার মাথার সাথে লেগে রইল। তার মানে লোহার মাথাতে লোহা আছে। তাই চুম্বক লোহার মাথাকে আকর্ষণ করেছে। এরপর একে একে আমি চুম্বক দিয়ে লোহার দেহের বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করলাম। পরীক্ষার ফলাফল একই। অর্থাৎ লোহার দেহে লোহা মানে আয়রন আছে। লোহাকে একদিন আমাদের বাসায় ডেকে আনলাম। তারপর আমার পড়ার ঘরে তাকে ঢুকিয়ে আরও পরীক্ষা করলাম। লোহার বামদিকের বাহুতে চুম্বক ধরে ডানদিকের বাহুতে কিছ আলপিন রাখলাম। দেখা গেলো আলপিন গুলোকে চুম্বক আটকে রেখেছে। অর্থাৎ লোহার দেহ আসলে লোহা দিয়েই তৈরি।

সাতদিন পর লোহার সকল পরীক্ষার রিপোর্ট আসলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে লোহার পরীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করলো। স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হলো। আমিও ছিলাম স্কুলের বন্ধুদের সাথে। লোহার পরীক্ষার রিপোর্টে যা এলো তা আমি আগেই চুম্বক পরীক্ষার সাহায্যে জেনে নিয়েছি। ডাক্তাররা বললেন, লোহার রক্তে ও হাড়ে আয়রনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। তবে লোহার মাথার খুলিতে আয়রন তার চেয়েও বেশি। একারণেই লোহার মাথা লোহার মতো। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় লোহা নাকি একটা বিরল রোগে ভুগছে। এই রোগকে বলে হিমোসাইডেরোসিস। এতে লিভারেও আয়রন সঞ্চিত হয় বেশি। পরদিন সকালে আমাদেও বাসায় পত্রিকায় বড় বড় শিরোনাম দেখলাম। তাতে লেখা আছে, বিরল লৌহবালক লোকমান হাসান। সঙ্গে তার নিরীহ সেই ছবি। এই হলো আমাদের লোহা!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়