প্রকাশ : ১০ জুন ২০২২, ০০:০০
আমার মা। একেবারেই ভীতুর ডিম। একটু খুট করে আওয়াজ হলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। জ্বীন আর ভূতের ভয়ে মা সব সময় তটস্থ থাকে। ওনার মনে ও মাথায় সারাদিন এই বিষয়গুলো কিলবিল করে। কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলে তিনি যুক্তি দিয়ে বিচার করেন না। তাঁর প্রবণতা সব সময় ভূতকেন্দ্রিক চিন্তায়। বাবা মাকে সবসময় বলেন, যদি এক-আধটু বিজ্ঞান পড়তে তাহলে এইসব ভূতটুতে ভয়ও পেতে না আর বিশ্বাসও করতে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই মা ভাবেন, সব তেনাদের কাজ। এই তেনারা যে কারা তা সহজেই অনুমেয়।
আমরা যে শহরে থাকি সে শহরে সে শহরে ভূত থাকার কথা নয়। কেনো না, ভূত তো আলোতে আসে না। কিন্তু আমাদের শহরে সবসময় আলো থাকে। সন্ধ্যা হলেই শহরের রাস্তায় লাল-নীল হরেক রকম আলো জ্বলে ওঠে। এ আলোতে বরং শহরটাকে রহস্যময়ী মনে হয়। যেনো প্রত্ন-সভ্যতা হতে উঠে আসা কোনো প্রাচীন নগরী। এ নগরীতে একসময় নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ ছিলো। ফলে নতুন নতুন বিল্ডিং হলেও গ্যাসের সংযোগ না থাকায় বাড়ি ভাড়া হুট করে বেড়ে গেলো। আমরা যে বাসায় থাকতাম তা ছিলো চারতলায়। বাড়িঅলা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেয়ায় আমরা কম ভাড়ার এক বাসায় উঠলাম। বাসাটা বড় কিন্তু মেঝেতে টাইলস লাগানো ছিল না। কালো সিমেন্ট লাগানো। মনে হয় কালো মেঝের কারণেই এ বাসাতে মশাদের উপদ্রব বেশি। মশার কামড় হতে বাঁচতে তাই না লাগলেও নতুন বাসাতে পাখা চালিয়ে রাখতে হয় সারাদিন। এ বাসাতে আর একটা বিষয় খুব ঝামেলার। নতুন বাসায় সবসময় বৃটিশ আর আমেরিকানদের ঝগড়া-ঝাঁটি লেগেই থাকতো। অর্থাৎ লাইট আর ফ্যানের স্যুইচগুলো ছিলো সব উল্টাপাল্টা। ড্রইংরুমের সব স্যুইচ হলো আমেরিকান পদ্ধতির আর বেডরুমের স্যুইচগুলো সব বৃটিশ পদ্ধতির। নতুন কেউ বাসায় আসলে তাকে বোকা বনে যেতে হয়। মাঝে মাঝে মায়েরও ভুল হয়। স্যুইচ অন করতে গিয়ে অফ করে দেয় কিংবা অফ করতে গিয়ে অন হয়ে যায়।
আমাদের বাসায় আমরা সাকুল্যে চারটা প্রাণি। বাবা-মা, আমি আর ভাই। ভাই মানে ছোটভাই যে পড়ে ক্লাস থ্রিতে। ড্রইং রুমে সে একা একা বসে সন্ধ্যা হতে খেলা দেখে। আমি আর মা মিলে বেডরুমে সিরিয়াল দেখি। আমার আবার ভূতের সিরিয়াল দেখতে মন চায়। কিন্তু মা ভূতের সিরিয়াল দেখতে চায় না। মা চায় পারিবারিক কুটনামির সিরিয়ালগুলো দেখতে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে মা আর আমার মাঝে ঝগড়া হয়। রিমোট নিয়ে যুদ্ধ নিমিষেই কারগিলের যুদ্ধে পরিণত হয়। টিভি দেখতে গিয়ে অনেক সময় চারজনের কমন অনুষ্ঠান পছন্দ হয়ে যায়। তখন ঘর হয়ে যায় যেনো মন্দির। এতো শান্তি, এতো ঐক্য আর কোথাও মনে হয় দেখা যায় না। তবে আমাদের মা-ছেলের ঝগড়া-ঝাটিতে বাবা খুব একটা নাক গলায় না। বাবা কেবল বই পড়ে আর বই পড়ে। বাবাদেরও যে এত বই পড়তে হয় তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমার বাবাকে দেখার পর মনে হলো বইপড়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছুইপৃথিবীতে নেই। বাবা যেমন বেশি বেশি বই পড়ে, তেমনি অনেককেই দেখি কঠিন কঠিন বিষয়ে বাবাকে ফোন করে সমাধান চাইতে। বাবাও খুব বেশি চিন্তা না করে চোখ বন্ধ করে কঠিন বিষয়গুলোর সমাধান দিয়ে দেন। বাবা যে সোফায় বসে বই পড়েন ঠিক সে জায়গায় একটা সিলিং ফ্যান আছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে বাবার সেই পাখাটার বাতাস দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি দিলীপ আঙ্কেলকে বাবা ফোন করে বাসায় আনালেন। তিনি দেখে বললেন, পাখার নাকি কয়েল নষ্টহয়ে গেছে। কয়েল পাল্টালে ভালো চলতেও পারে আবার নাও পারে। বাবা দিলীপ আঙ্কেলের কথা শুনে নতুন একটা সিলিং ফ্যান কিনে আনলেন এবং মা পুরানো পাখাটা আমাদের স্কুলের আয়াকে দিয়ে দিলো। যে আয়াকে পুরানো ফ্যানটা দেয়া হলো সে আয়া স্কুলে আমাদের ভালোই খোঁজ-খবর রাখে।
নতুন ফ্যান লাগানোর পর বাতাসের জোর বাড়লো। কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই বুঝা গেলো বিদ্যুতের বিল বেশি আসছে। অথচ দুদিন আগেও বিদ্যুতের ব্যবহার যা ছিলো এখনও তা-ই আছে। কোনো ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ব্যবহার বাসায় বাড়েনি। প্রিপেইড, মিটারে ঘন ঘন টাকা ভরাতে গিয়ে বাবার মাথা গরম হয়ে গেলো। কিন্তু পাখা বিক্রেতা দোকানদার গ্যারান্টি দিয়ে বলেছে, নতুন পাখার বিদ্যুৎ খরচ কম কিন্তু বাতাস বেশি। যে দোকান থেকে পাখাটা বাবা এনেছিলো সে দোকানদার বাবার পুরানো পরিচিত। কাজেই দোকানদার বাবাকে ভুল বা মিথ্যে বলার কথা নয়। এর মধ্যে আমরা তিনদিনের জন্যে গ্রামে বেড়াতে গেলাম। বেড়িয়ে এসে দেখি আমাদের বাসার ড্রইং রুম আর বাবার পড়ার ঘরের ফ্যান ঘুরছে। আমরা সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম। তালা, দরজার লক, জানালা, গ্রিল সবই ঠিক আছে। এমনকি জিনিষপত্র কিছুই নড়চড় হয়নি। কোন ধুলোবালিও কোথাও নেই। তাহলে পাখাগুলো চালালো কে? এ ঘটনায় মায়ের গলার জোর বেড়ে গেলো। বলেছিলাম না, সব তেনাদের কাজ। তেনারা ছাড়া এ কাজ আর কারও না। বাবাকে চিন্তিত দেখা গেলো। আমরাও ভয় পেতে শুরু করলাম। সত্যিই তো। চোরও আসেনি, ঘর ছিলো বন্ধ। স্যুইচ ছিলো অফ। তাহলে পাখা ছাড়লো কে? বাবা মিটারের ব্যালেন্স চেক করে দেখলেন এই দফায় তিনদিন না থাকার পরও তিনশ’ টাকা বাড়তি বিল কাটা গেছে।
রাতে শোয়ার সময় বাবা নিজের হাতে সব দরজা, জানালা বন্ধ করলো। সব স্যুইচ নিজেই অফ করে তারপর ঘুমুতে গেলো। সকাল বেলা সবার আগে প্রতিদিন বাবাই ঘুম থেকে জাগে। আজ সকালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাবা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে ডাইনিং রুমে হাঁটাহাঁটি করে। পুরো ডাইনিং রুমে একশবার চক্রাকারে হাঁটে। মোট দুই হাজার স্টেপ দিয়ে হাঁটা শেষ করে। কোনো জার্নালে নাকি লিখেছে, কুড়ি স্টেপ হাঁটলে এক ক্যালরি শক্তি খরচ হয়। বাবা তাই গুনে গুনে মোট দুহাজার স্টেপ প্রতিদিন সকালে আর বিকেলে হাঁটে। আজ হাঁটতে গিয়েই বাবার মনে হলো ড্রইং রুমে কিসের যেন আওয়াজ হচ্ছে। বাবা গিয়ে দেখে ও মা! সামনের রুমের পাখাটা নিজে নিজেই ঘুরছে। অথচ গতকাল রাতে বাবা নিজের হাতে সব স্যুইচ বন্ধ করেছে। ঘুম থেকে সবাইকে ডেকে বাবা জেরা করা শুরু করলো, কে রাতে ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমের পাখা ছেড়েছে। কিন্তু সবাই বললো, তারা কেউ পাখাও ছাড়েনি, সামনের রুমেও যায়নি।
এতোসব ঘটনায় বাবার বিজ্ঞানমনষ্কতা যেনো টলে যাচ্ছে। বাবা ধীরে ধীরে তার মত পাল্টাতে শুরু করলো বোধ হয়। কিন্তু তার আগে বাবা আবার একজন ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে আনলো বাসায়। ঘরের সব স্যুইচ পরীক্ষা করা হলো। সবই ঠিক আছে। অর্থাৎ পাখা চালু হওয়ার জন্যে স্যুইচের কোনো ত্রুটি ছিলো না। ধীরে ধীরে বাবা নতুন বাসা দেখতে শুরু করলো। মা প্রতিদিন রাতে তেনাদের কথা স্মরণ করে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। তেনাদের কথা শুনে কোন বুয়া আমাদের বাসায় আর কাজ করতে আসতে চায় না। আমাদের দূরবস্থার কথা শুনে দেখতে আসলো বাড়িঅলা দাদু। বাড়িঅলা দাদু থাকেন আমেরিকায় তার মেয়ের কাছে। বছরে দুইবার দেশে আসেন। এবার এসেছেন দুদিন আগে। বাবার ফোন পেয়ে। তিনিও বাবার মতো বিজ্ঞানমনষ্ক। ঘটে যাওয়া সব ঘটনা তিনি যুক্তি দিয়েই ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করেন। তিনি আমাদের কথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমরা নতুন বাসা দেখছি শুনে একটু মর্মাহত হলেন। দীর্ঘদিন ধরে আমরা তার বাসায় আছি। প্রায় চৌদ্দ বছর। আমার জন্ম হয়েছে এ বাসায়। বাবার মুখে শুনেছি। এ বাসায় আসার দুবছর পর আমার জন্ম। তার তিন বছর পর আমার ছোট ভাইয়ের জন্ম। বাসা পাল্টালে আমাদের বড় হওয়ার স্মৃতিগুলো সব এ বাসায় রয়ে যাবে। কুশলাদি বিনিময়ের পর বাড়িঅলা দাদুর সাথে বাবার বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো। এর মধ্যে বাড়িঅলা দাদুর নাতির রোগের কথাও এলো। বাড়িঅলা দাদুর নাতির বয়স দশ বছর। কিন্তু ঘুমের মধ্যে সে নাকি হাঁটে। সে নিজেও জানে না যে সে ঘুমের মধ্যে হাঁটে। এজন্যে রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের মূল দরজায় তালা লাগিয়ে রাখতে হয় যাতে ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে বের হয়ে না যায়। আমেরিকার চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হলেও ঘুমের মধ্যে হাঁটা রোগীর সংখ্যা সে দেশে কম নয়। কথায় কথায় রাত দশটা বেজে গেলো। মায়ের হাতে বানানো এক কাপ কফি খেয়ে বাড়িঅলা দাদু চলে গেল।
বাড়িঅলা দাদু যাওয়ার পর হতেই বাবাকে আরো চিন্তিত মনে হলো। ডাইনিং রুমে হাঁটতে হাঁটতে বাবাকে আরো বুড়ো মনে হলো। এদিকে আমার অবশ্য তেমন কোনো ভয় নেই। আমি সায়েন্স ক্লাবে জেনেছি, ভূত আদৌ মানুষকে ভয় দেখানোর কৌশল, আসলে কোনভূত নেই। কিন্তু আমাদের ফ্যানগুলো কে ছাড়ে তা দেখার জন্যে আমার মন বড় কৌতূহলী হয়ে উঠলো। বাবানহঠাৎ আমাকে ডেকে নিয়ে বললো, আমি যা চিন্তা করছি তুইও কি তাই চিন্তা করছিস্? আমি মাথা নাড়ালাম। রাতে ঘুমিয়ে গেলাম সবাই। মাঝরাতে বাবা আর আমি উঠে লুকিয়ে রইলাম ড্রইং রুমের বাইরে দরজার ফাঁকে। আমার হাতে একটা লোহার চাবি আর বাবার হাতে ম্যাচ। যদিও আমরা ভূতের কথা মানি না তবুও প্রচলিত ধারণাকে মেনে নিয়ে আমরা অপেক্ষায় রইলাম। কে এসে পাখা চালায় আজ দেখতে হবে। রাত প্রায় তিনটে হবে। দেখি আমার রুম থেকে একটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে ড্রইং রুমের দিকে যাচ্ছে। তারপর ড্রইং রুমে ঢুকে পাখা ছেড়ে বসে পড়লো সোফায়। পাঁচ মিনিট পর পাখা চালু রেখে আবার ছায়ামূর্তিটি যে রুম থেকে এসেছিলো সে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। বাবা আর আমি দুজনেই মুচকি হেসে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সকালে ভূত রহস্যের সমাধান করতে পেরে আমি আর বাবার মনটা ভয়হীন আর ফুরফুরে হয়ে গেলো। বাবা ফোন করে তার বন্ধুকে না করে দিলো যাতে নতুন বাসা না দেখে। তারপর সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে ফোন করে সন্ধ্যাবেলায় রোগী দেখাবার একটা সিরিয়াল নিলো। মা জিজ্ঞেস করলো, কার জন্যে সিরিয়াল নিচ্ছো? বাবা হেসে বললো, ভূতের জন্যে। ভূত আবার কে? মা জিজ্ঞেস করলো। ভূত আবার কে! তোমার ছোট ছেলেই আসল ভূত। ঘুমের মাঝে সে হেঁটে ড্রইং রুমে যায় আর ফ্যান চালায়। আবার ঘুমের মধ্যেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। ওহ্ মা! তা-ই! মায়ের এ অবাক হওয়ায় আমি আর বাবা দুজনেই হেসে দিলাম।