প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
আমার ছোটকাকা। পড়াশোনায় বেশ ভালো। প্রতিটা পরীক্ষায় তিনি ভালো ফলাফল করেই পাস করেছেন। তার সবগুলো সার্টিফিকেটে প্রথম শ্রেণি। এমএ পাস করে গত দুবছর ধরেই তিনি বেকার। তার বন্ধুদের সবার চাকরি হয়ে গেছে। কেউ সরকারি চাকরি পেয়েছে আর কারও জুটেছে বেসরকারি চাকরি। তিনিই ব্যতিক্রম। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার চাকরিটা হচ্ছে না। প্রতিবার লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ভাইবাতে তিনি ঝরে যান। অথচ ভাইবাতে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর তিনি বেশ ভালো দেন। কিন্তু শেষমেষ চাকরি হয় না। প্রতি মাসে তিনি না হলেও দশটার মতো পোস্টাল অর্ডার পাঠান। পোস্টাল অর্ডার বাবদ তার মাসে দুই-তিনহাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। তবু কোনোবারেই তার ভাগ্যে চাকরির শিকে ছিঁড়ে না। পরীক্ষা দিতে দিতে তার বইগুলো সব তুলতুলে নরম হয়ে গেছে। এখন আর পৃষ্ঠাগুলো উল্টানো যায় না। উল্টাতে গেলেই ছিঁড়ে যায়। কিন্তু তবুও বেচারার ভাগ্যে চাকরির গিঁট খোলে না। আমার ঠাকুরমা কত যে মানত করেন তার ছোট ছেলের একটা চাকরি হওয়ার জন্যে। দাদু তো হতাশ হয়ে বলেই ফেললেন, চাকরি না খুঁজে গ্রামের জমি চাষ করতে। তাতেও অনেক উপার্জন। অবশ্য ছোট কাকার শ্রমে কোনো না নেই। যেহেতু এ মুহূর্তে তিনি বেকার, তাই প্রতিদিন সকালে বাজারের দায়িত্ব তার। তিনি বেশ খুশি মনে এ দায়িত্ব পালন করেন। কারণ বাজার করাটা তার জন্যে জরুরি। উপার্জনের একটা ক্ষুদ্র উপায় হলেও যুৎসই। দৈনিক পকেট খরচটা উঠে যায়। তিনি অবশ্য দুটো ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পড়ান। এতে তার বেশ ভালো টাকা আয় হয়। কিন্তু এ টাকার সিংহভাগ খরচ হয় চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে যাতায়াত আর পথ খরচে। মাঝে মধ্যে আমিও ভাগ পাই তার ইনকামের। কখনো কোনো মেলায়-টেলায় গেলে আমার জন্যে দুয়েকটা পরিবর্তন কমিকসের বই আর না হলে মুরলি নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে ঠাকুরমার জন্যে পানও নিয়ে আসে নিজের রোজগার থেকে। ঠাকুরমা তার ছোট ছেলের পয়সায় কেনা দুটাকার পান পেলে যে খুশি হয়, দাদু ভাই হাজার টাকা দিলেও তার সে খুশি আসে না। ঠাকুর মা মাঝে মাঝে আমাকে বলে, তোর ছোটকাকা কবে আসবে।
ছোট কাকাকে নিয়ে আমার ঠাকুরমার গল্পের শেষ নেই। ছোটবেলায় কাকা নাকি স্কুল থেকে এসেমাত্রই ভাত খেতে চাইতো। তাই ঠাকুরমা সবসময় ছোট কাকার ভয়ে তটস্থ থাকতো। দেড়টার দিকে কাকার ভাত চাই। তাই তিনি আগে ভাগে ভাত, মাছ আর ডাল রেঁধে রাখতেন। ছোটকাকার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার নাকি লিভার পেকে গিয়েছিলো। লিভারে পুঁজ হয়ে তার কাঁপিয়ে জ্বর আসতো। যা খেতো তা বমি করে দিতো। লিভারেরপুঁজের কারণে পেট দিয়ে যেনো আগুন ছুটতো। আমার ঠাকুর মার মামা একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি মেডিকেল কলেজে ক্লাস নিতেন। তাঁর ঔষধেই ছোটকাকা ভালো হয়ে যায়। সেই থেকে ছোটকাকার প্রতি মায়ের টানটা একটু বেশি।
ছোট কাকা মনে মনে ঠিক করেছে, এইবার চাকরি না হলে আর ইন্টারভিউ দিবে না। ব্যবসা করবে। যে ব্যবসাই হোক না কেনো। এবারের চাকরির ইন্টারভিউ ছিলো একটা বেসরকারি ব্যাংকের অফিসার পদে। লিখিত পরীক্ষা আর ভাইবা একই দিনে। শহরে তাদের হেড অফিস। পরীক্ষা দিতে ছোট কাকা সেই সকালে বের হয়ে গেছে। আজ সবাই গ্রামে যাবে। গ্রামে নাকি আমার দাদুর এক গোষ্ঠীর বোন মারা গেছে। তার নাম মল্লিকা। তার দাহকর্ম হবে সন্ধ্যায়। ছোট কাকা পরীক্ষা দিয়েই সোজা গ্রামে চলে যাবে। আমরা সবাই সকালে গ্রামে রওনা দিলাম। যিনি মারা গেছেন তিনি ছোটবেলায় ছোট কাকাকে নাকি অনেক কোলে-পিঠে নিয়েছেন। তার প্রতি ওনার অনেক মায়া ছিলো। তারপর শহরে চলে আসার কারণে যোগাযোগ আর সে রকম ছিলো না। দীর্ঘদিন আর তাকে দেখেনি ছোট কাকা। ফলে বুড়ো হওয়ার পর তাকে দেখতে কী রকম তাণ্ডও ছোট কাকার জানা থাকার কথা নয়। তবে ছোট কাকা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে দেখে তাকে জানানো হয়নি, আদতে মল্লিকা ঠাকুরমা মারা গেছেন। দুপুরে গ্রামে শোকার্ত আত্মীয়-স্বজনের সমাগম শুরু হলো। সামাজিক বিধিবিধানের পর তার মরদেহ শ্মশানে নিতে নিতে সন্ধ্যা পার হলো। যারা মরদেহ সৎকার করার দায়িত্বে ছিলেন তারা সবাই রাত দশটার দিকে ফিরে এলেন। সবার চোখমুখে প্রশান্তি। মল্লিকা ঠাকুরমার মরদেহ নাকি তাড়াতাড়ি ভষ্ম হয়েছে। তারা সবাই হাতমুখ ধুয়ে যে যার ঘরে চলে গেছে। এদিকে দশটা বেজে ওঠার পরও ছোট কাকা এসে না পৌঁছাতে সবাই চিন্তা করতে লাগলো। একঘণ্টা আগেও কাকার সাথে ফোনে যোগাযোগ হয়েছিলো। একসাথে নাকি লিখিত পরীক্ষার পর সবার ভাইবা নেয়া হয়েছে। আগামীকাল রেজাল্ট এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে। কাকার পরীক্ষা নাকি ভালো হয়েছে। শহরে ট্রাফিকজ্যাম অত্যধিক বলে তার আসতে সময় লাগছে। ঠাকুরমাকে কাকা জানালো, তার মোবাইলের চার্জ নাকি প্রায় শেষ। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে। কাজেই ঠাকুরমা যেনো চিন্তা না করেন।
দীর্ঘদিনপরে ছোট কাকা গ্রামের বাড়ি আসছে একা একা। রাত প্রায় এগারটা বাজে। শীতের রাতে গ্রামে এগারটা মানে গভীর রাত। কুয়াশার জন্যে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের রাস্তায় এখন আর কোনো গাড়ি নেই। এতো রাতে এখানে গাড়ি থাকে না। রাত নয়টা বাজলেই গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। ছোট কাকা আসতে আসতে চিন্তা করছে আর ভাবছে চাকরির কথা। জনশূন্য রাস্তায় কেবল কাকার পদধ্বনির শব্দ আর বাদুরের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে পাতায় রাতের শিশির পড়ার শব্দ স্বাভাবিকের চেয়ে যেনো শতগুণ বিবর্ধিত হয়ে বেজে উঠছে। এতো ঘন আঁধারের মধ্যেও কিছুটা দূরে কাকার মনে হলো কোনো এক বুড়িমা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন তার আগে আগে। পরনে তার সাদা শাড়ি। বুড়িমাদের গায়ে যেমন থাকে, তেমন। কাকা বুড়িমাকে দেখে মনে সাহস ফিরে পেলো। একটু দ্রুত হেঁটে বুড়িমাকে ধরলো কাকা। বুড়িমা জিজ্ঞেস করলো কাকার নাম ধরে, এতো রাতে তুই কোথা থেকে এলি বাপু? কাকা খুলে বললো সব ঘটনা। বুড়িমা বললো, তুই ভয় পাসনা। আমি আছি। তুই আমার সাথে সাথে আয়। আমাকে চিনলি না! আমি তোর মল্লিকা পিসি রে বোকা। এতো টেনশনে কাকা আর বুড়িমাকে ভালোভাবে ঠাহর করতে পারেনি। কাকার আর কোনো কিছুই মাথায় আসছে না। শুধু নিরাপদে ঘরে ফেরার তাগিদ অনুভব করছে ভয়ার্ত মানুষটি। বুড়িমার নাম জানতে পেরে কাকা যেনো হাতে আকাশের চাঁদ পেলো। এক সময় হাঁটতে হাঁটতে কাকা বুড়িমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলেন? বুড়িমা বললেন, আমি তোদের বাড়ি যাচ্ছি রে। তোর বাবা-মা নাকি আজকে গ্রামে এসেছে। আমি শুনতে পেয়েছি দেরীতে। তাই তাদের এই রাত করে দেখতে যাচ্ছি। কাকা বললো, তাহলে তো ভালোই হলো। তোমার সাথে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারবো। আরে হ্যাঁ, তাই পারবি। বুড়িমা কাকাকে আশ্বস্ত করলো। তারপর কাকাকে বললো, তুই কোনো চিন্তা করিস্ না খোকা। তুই একদিন অনেক বড় হবি। বুড়িমার কথায় কাকা যেনো দম ফিরে পেলো জীবনের। বুড়িমার সাথে একটা পোঁটলা ছিলো। তিনি একহাতে লাঠি ধরে আর অন্য হাতে পোঁটলা নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। দেখে বোঝা যায়, পোঁটলাটা অতো হাল্কা নয়। তারপরও কাকার মনে হচ্ছে বুড়িমার সাথে কাকা হেঁটে পারছে না। অথচ কাকা প্রতিদিন নিয়ম করে মর্নিংওয়াক করে। বুড়িমা একসময় বাড়ির কাছাকাছি আসার পর জিজ্ঞেস করলেন কাকাকে, তুই কী চাস্? কাকা বললেন, একটা চাকরি হলে আমার আর কিছুই চাই না। বুড়িমা বললেন, দূর বোকা! এতো অল্প কেউ চায়? এই বলে বুড়িমা বললেন, ধর, এই পোঁটলাটা রাখ। তোদের বাড়ি তো ঐ দেখা যায়। আমি একটু ঠ্যাং দুটো ধুয়ে আসছি। যা ধুলোবালি লেগেছে না! এই বলে বুড়িমা পুকুরের দিকে গেলো আর কাকা বাড়ির উঠোনে এসে পড়লো। কাকাকে দেখে দাদু জিজ্ঞেস করলেন, তুই কার সাথে কথা বলছিলি? কাকা বললো, পথে মল্লিকা পিসির সাথে দেখা। তিনি নাকি তেমাদের দেখতে আসছে। তার সাথেই আমি কথা বলতে বলতে আসছিলাম। কী! সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো। মল্লিকাকে তো সন্ধ্যায় দাহ করা হলো। তাড়াতাড়ি হারিকেন নিয়ে সবাই পুকুরপাড়ে এসে খুঁজতে লাগলো মল্লিকা ঠাকুরমাকে। কিন্তু কেউ সেখানে নেই। ঘরে ফিরে সবাই দরজা ভালো করে আটকে তারপর ছোট কাকাকে ঘিরে ধরলো। ছোট কাকার হাতে পুঁটলি দেখে ঠাকুরমা বললো, এটা কী? ছোট কাকা সম্বিৎ ফিরে পেয়েই যেনো বললো, এটাই তো মল্লিকা পিসি আমাকে রাখতে বলে নিজে পুকুর ঘাটে ঠ্যাং ধুতে গেলো। এ কথা শুনে সবার মধ্যে একটা কেমন জানি শিহরণ খেলে গেলো। দাদু সাহস করে ছোট কাকার হাত থেকে পুঁটলিটা নিয়ে প্রথমে একটু আগুনে সেঁকলো। তারপর গিঁট খুললো নিজেই। গিঁট খুলেই সবার চক্ষু চড়কগাছ! পুঁটলিতে আছে প্রয়াত মল্লিকা ঠাকুরমার জীবনকালে সঞ্চিত সব সোনার গয়না! সবগুলো চক্ চক করছে হারিকেনের আলোয়।