প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৮
বেড়িয়ে আসুন শতবর্ষী দুর্গাসাগর দীঘি থেকে

বরিশাল জেলার অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণস্থল দুর্গাসাগর দীঘি শুধু একটি বড় জলাধার নয়, বরং ইতিহাস, প্রকৃতি আর মানুষের যাপিত জীবনের মেলবন্ধন। শান্ত পরিবেশ, বিস্তীর্ণ জলরাশি আর মাঝখানের ছোট দ্বীপ মিলিয়ে জায়গাটি দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। যারা ব্যস্ত শহরজীবন থেকে একটু মুক্ত হাওয়া খুঁজছেন, তাদের জন্য দুর্গাসাগর হতে পারে নিখুঁত গন্তব্য।
ইতিহাসের গল্প
দুর্গাসাগর দীঘির ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৭৮০ সালে রাজা জয়নারায়ণ এই বিশাল দীঘিটি খনন করান তার স্ত্রী রানি দুর্গাবতীর নামে। বরিশাল অঞ্চলে তখন পানির সংকট ছিল প্রবল; সেই সংকট দূর করে মানুষের জীবনকে সহজ করার লক্ষ্যেই ছিল এই উদ্যোগ। শুধু পানির উৎস হিসেবেই নয়, বরং সময়ের সঙ্গে দীঘিটি স্থানীয় ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। শতাব্দী ধরে এই জলাধার বরিশালের জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে।
দেখতে কেমন এই দুর্গাসাগর
দুর্গাসাগর দীঘিকে প্রথম দেখলে সবচেয়ে নজর কাড়ে তার বিস্তৃতি। প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিঘার মতো এলাকাজুড়ে বিশাল পানির শরীর। দীঘির চারপাশে গাছপালা আর মাঝখানে সবুজে ঢাকা ছোট একটি দ্বীপ, যেটাকে স্থানীয়রা ‘দোয়েল দ্বীপ’ নামে ডাকে। বর্ষায় পানি যখন টলমল করে, তখন দ্বীপটি ভেসে ওঠে যেন প্রকৃতির মাঝখানে ছোট্ট একটি রাজ্য। বিকেলের আলো পড়ে পানির ওপর, সেদিকে তাকালে মনে হয় পুরো দিনটাই যেন নরম আলোতে ভেসে যাচ্ছে। পানির ওপর ভাসমান পদ্মফুল, শাপলা আর নানা প্রজাতির মাছ- সব মিলে জায়গাটার একটা স্বাভাবিক, পরিচ্ছন্ন সৌন্দর্য আছে। পাখিদের আনাগোনা, বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখির দল, পুরো পরিবেশকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
অবস্থান
দুর্গাসাগর দীঘি বরিশাল সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে, বাবুগঞ্জ-মাধবপাশা এলাকার কাছে অবস্থিত। বরিশাল শহর থেকে রাস্তাটি পুরোপুরি সহজ এবং বছরের যেকোনো মৌসুমেই যাওয়া যায়। দীঘির প্রবেশদ্বার, চারপাশের ওয়াকওয়ে এবং বিশ্রামস্থল সব মিলিয়ে জায়গাটা পর্যটকদের জন্য বেশ সুবিধাজনকভাবে সাজানো।
বেড়াতে গেলে কেমন লাগবে
এককথায় শান্ত, নিরিবিলি আর ছবির মতো সুন্দর। সকালে গেলে পানির ওপরে হালকা কুয়াশা ভাসবে, আর বিকেলে রোদের নরম আলো দীঘিকে সোনালি করে তুলবে। পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে একটু সময় কাটানো বা একা বসে শান্ত বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য জায়গাটা দারুণ। ছবি তুলতে ভালোবাসেন এমন কেউ হলে দুর্গাসাগর আপনাকে হতাশ করবে না। জলরাশির প্রতিফলন, দ্বীপের সবুজ, সূর্যাস্তের কমলা আলো- এসব মিলিয়ে এখানে যেকোনো ক্লিকে আলাদা সৌন্দর্য ধরা পড়ে।
কখন গেলে সবচেয়ে ভালো
শীতকালই সবচেয়ে আদর্শ সময়। তখন বাতাস ঠাণ্ডা থাকে, অতিথি পাখি আসে আর পানির রংটাও স্বচ্ছ লাগে। বর্ষায় পানিতে পরিপূর্ণ দীঘি দেখলে ভালো লাগবে ঠিকই, কিন্তু চারপাশে কাদা হতে পারে। গরমকালে দুপুর এড়িয়ে চলাই ভালো।
কীভাবে যাওয়া যাবে
বরিশাল শহর থেকে শুধু রিকশা-ভ্যান নয়, বরং অটোরিকশা, সিএনজি বা প্রাইভেট গাড়িতে ২০-৩০ মিনিটেই পৌঁছানো যায়। ঢাকা থেকে গেলে প্রথমে বরিশাল শহরে নামতে হবে- লঞ্চ, বাস বা বিমানে। সেখান থেকে খুব সহজেই দুর্গাসাগর পৌঁছানো যায়। যদি কয়েকজন মিলে যান, তাহলে রিজার্ভ অটো সবচেয়ে আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী।
কী কী দেখা যায়
দুর্গাসাগর শুধু একটি দীঘি নয়, বরং এর আশপাশেও কিছু আকর্ষণীয় স্পট আছে।
দোয়েল দ্বীপ: নৌকায় উঠলে দ্বীপের কাছে যাওয়া যায়। সবুজ আর পাখির ডাক মিলিয়ে আলাদা অনুভূতি।
প্রাচীন রাজবাড়ির চিহ্ন: মাধবপাশার পুরোনো রাজবাড়ির কিছু নিদর্শন কাছাকাছিই আছে।
স্থানীয় বাজার: ছোট ছোট দোকান, স্থানীয় খাবার আর মানুষের সরল জীবন দেখতে ভালো লাগবে।
কী খাবেন
দীঘির পাশে বড় রেস্টুরেন্ট নেই, তবে ফেরার পথে বরিশাল শহরে খাবারের প্রচুর অপশন আছে। ইলিশ, ভাপা পিঠা, নারিকেল দুধে বানানো স্থানীয় আইটেম- সবই পেয়ে যাবেন। সকাল-বিকেল চা ও হালকা স্ন্যাকসের জন্য ছোট দোকানও পাওয়া যাবে।
ভ্রমণকারীদের জন্য দরকারি পরামর্শ
দুপুরের রোদ খুব তীব্র হতে পারে, তাই ক্যাপ পরা বা ছাতা নেওয়া ভালো।
যদি নৌকা ভ্রমণ করেন, লাইফ জ্যাকেট আছে কি না দেখে নেবেন।
বর্ষায় পিচ্ছিল রাস্তায় সাবধানে হাঁটুন।
সৌন্দর্য নষ্ট না করতে কোথাও প্লাস্টিক বা আবর্জনা ফেলবেন না।
দ্বীপে গেলে পাখিদের বিরক্ত না করাই ভালো।
পরিবার নিয়ে গেলে শিশুদের হাতের কাছে রাখুন, কারণ দীঘির পানি গভীর।
কেন দুর্গাসাগর বিশেষ
একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে প্রকৃতি- এই দুইয়ের মিলন খুব বেশি জায়গায় দেখা যায় না। দুর্গাসাগর সেই বিরল উদাহরণগুলোর একটি। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় সময় একটু ধীরে বয়ে যায়, আর জীবনটা যেন একটু সহজ হয়ে আসে। বরিশালের মানুষও এই জায়গাটাকে ভীষণ আপন মনে করে, কারণ এটি তাদের ইতিহাস ও পরিচয়ের অংশ।
শেষ কথা
যারা সাদামাটা কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা খুঁজছেন, তাদের জন্য দুর্গাসাগর দীঘি নিখুঁত। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে দুয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেই মনটা হালকা হয়ে যায়। ইতিহাস জানতে চাইলে পাবেন, প্রকৃতি দেখতে চাইলে পাবেনÑদুটোই মিলেমিশে এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
বরিশালের আরও দর্শনীয় স্থান
দুর্গাসাগর দীঘির পাশাপাশি বরিশালে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। যেমন- বেলস পার্ক (বঙ্গবন্ধু উদ্যান), গুঠিয়া মসজিদ, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, মাধবপাশা রাজবাড়ি, কীর্তনখোলা নদীর তীর, রূপাতলী খেয়াঘাট এলাকা, বানারীপাড়া নলচিত্র গ্রাম, বাকেরগঞ্জ চন্দ্রমোহন নদী এলাকা, স্ব-মার্কস ক্যাথেড্রাল চার্চ, বেতাগী চৌমাথা এলাকা, চরবাড়িয়া মাদরাসা মসজিদ, রূপাতলী-সগরদী পুরোনো শহর এলাকা, বরিশাল রূপাতলী প্যারাগন পার্ক, উল্যানা জমিদার বাড়ি ইত্যাদি। চাইলে পরিবার নিয়ে এসব স্থানও ঘুরে দেখতে পারেন।







